• ঢাকা
  • শনিবার, ১৮ মে, ২০২৪, ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১,
রাজনৈতিক দল

নতুনের আত্মপ্রকাশ, পুরোনো অভিজ্ঞতা


রাজেকুজ্জামান রতন
প্রকাশিত: অক্টোবর ২৭, ২০২১, ০২:১৭ পিএম
নতুনের আত্মপ্রকাশ, পুরোনো অভিজ্ঞতা

দেশটা যেভাবে চলছে, তাতে কোনো রাজনীতি সচেতন মানুষ স্বস্তিতে নেই। এভাবে দেশ চলতে পারে না। এই কথাটি সম্ভবত বাংলাদেশে যারা রাজনৈতিক দল না করেও রাজনৈতিক মতামত দেন, তাদের মুখ থেকে বহুল উচ্চারিত কথা। রাজনীতিতে নানা কূটকৌশল দেখে প্রায় বীতশ্রদ্ধ মানুষ নতুন কিছু প্রত্যাশা করেন। এ রকম সময়ে নতুন রাজনৈতিক দল হিসেবে বাংলাদেশ গণ অধিকার পরিষদের আত্মপ্রকাশ ঘটল। সাম্প্রতিক সময়ে মানুষের মুক্তি অর্জনের আকাঙ্ক্ষা ও প্রত্যয় ব্যক্ত করে আরও কয়েকটি রাজনৈতিক দল আত্মপ্রকাশ করেছে। সাধারণত রাজনৈতিক দলের ঘোষণা ও আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন থাকে না। প্রত্যাশা থাকে বাস্তবায়নের সক্ষমতা নিয়ে। কারণ, রাজনৈতিক দল অভিষিক্ত হয় জনগণের ভালোবাসায়, শক্তিশালী হয় জনগণের অংশগ্রহণে।   

রাজনীতিতে ধমক, ধাঁধা বা চমক খুবই প্রয়োজনীয় ব্যাপার। সময়মতো ও পরিমাণমতো এর প্রয়োগ হলে সাফল্য আসে বলে রাজনৈতিক মহল মনে করে। কিন্তু নতুন কোনো দল আত্মপ্রকাশ ঘটালে নতুন আলোচনা ও আলোড়নের জন্ম হয়। কথাগুলো নতুন, না কাজটা তারা নতুনভাবে করবেন, এ নিয়ে আশাবাদ ও হতাশা দুটোরই প্রকাশ ঘটতে থাকে। তবে এটা তো ঠিক যে নতুন পথে পুরোনো পথিক, নাকি পুরোনো পথে নতুন পথিক, এই বিতর্কের অবসান তর্কের টেবিলে হবে না, হবে আন্দোলনের রাজপথে।

অর্থনীতিবিদ ড. রেজা কিবরিয়া অর্থনীতিবিদ হিসেবে যতটা পরিচিত, বাংলাদেশের রাজনীতিতে রাজনীতিবিদ হিসেবে ততটাই নতুন। তার রাজনীতিতে আগমন ড. কামাল হোসেনের দলে যোগ দেওয়ার মধ্য দিয়ে। আর  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের সাবেক ভিপি নুরুল হক নুর কোটা সংস্কার আন্দোলন, ডাকসু নির্বাচন এবং পরবর্তীকালে বিভিন্ন আন্দোলনের মাধ্যমে পরিচিত হয়ে উঠেছেন। এই দুইজনের নেতৃত্বে আত্মপ্রকাশ হয়েছে ‘বাংলাদেশ গণ অধিকার পরিষদ’ নামে একটি নতুন রাজনৈতিক দলের। প্রায় দুই বছর ধরে  অনেক ব্যক্তি, দল ও প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আলোচনা করে বৃহত্তর পরিসর ও পরিচিতি নিয়ে দলটির আত্মপ্রকাশ হওয়ার কথা থাকলেও বেশ কয়েকবার পিছিয়ে শেষ পর্যন্ত মঙ্গলবার (২৬ অক্টোবর) পুরানা পল্টনের প্রিতম-জামান ভবনের কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনের মধ্য দিয়ে দলটি আত্মপ্রকাশ করল।

দলের খসড়া কর্মসূচিতে যে ২১ দফা যুক্ত করা হয়েছে, তার প্রতিটিই অনেক দিনের পুরোনো আকাঙ্ক্ষা ও প্রতিশ্রুতির অংশ। এই দাবি ও দফাগুলো কোনো না কোনো রাজনৈতিক দলের কর্মসূচিতে উল্লেখ করা আছে। দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকেই দলীয় প্রধান এবং রাষ্ট্রপ্রধানের সম্পর্ক কী হবে, তা নিয়ে আলোচনা করে আসছেন। একজন ব্যক্তি কত দিন রাষ্ট্র ও দলীয় প্রধান পদে থাকতে পারবেন, তা নিয়েও আলোচনা করছেন অনেকেই। বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে খসড়া কর্মসূচির ৫ নম্বর দফার দ্বিতীয় অংশে। বলা হয়েছে— ‘রাষ্ট্রপতি কিংবা সরকারপ্রধান একই সঙ্গে দলীয় প্রধান হতে পারবেন না; কোনো ব্যক্তি দুই মেয়াদের (১০ বছর) অধিক সরকারপ্রধান কিংবা পাঁচ মেয়াদের (১০ বছর) বেশি দলীয় প্রধান বা অন্য কোনো পদ বা একাধিক পদে মিলিতভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারবেন না।’ গণ অধিকার পরিষদ বলছে যে এ বিষয়টি চর্চা হলে দলের মধ্যে গণতন্ত্র চর্চার পরিবেশ উন্মুক্ত হবে।

ঘোষণাপত্রে গণ অধিকার পরিষদ উল্লেখ করেছে, ‘বাংলাদেশ রাষ্ট্র এক দীর্ঘস্থায়ী বিপদে পড়েছে। জনপ্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, বিচার বিভাগ, সশস্ত্র বাহিনীর মতো প্রতিষ্ঠানের দলনিরপেক্ষ বলে যে অবস্থান নেওয়ার কথা ছিল, তা আজ নেই।’

 বাংলাদেশ গণ অধিকার পরিষদ যে ২১ দফা খসড়া কর্মসূচি ঘোষণা করে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছ— গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার। সংগঠনটির খসড়া কর্মসূচিতে এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা হয়েছে—‘গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার পুনরুদ্ধারে সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার’ গঠনের মাধ্যমে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা করা।

নির্বাচনে যাবেন কি না, এ প্রশ্নের উত্তরে দলের আহ্বায়ক ড. রেজা কিবরিয়া সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘যদি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন না হয়, আমরা সেই নির্বাচনে যাব না।’

খসড়া কর্মসূচিতে আরও বাকি যে বিষয়গুলো উল্লেখ করা হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে—ন্যায়বিচার ও সুশাসন, নারী অধিকার, সংখ্যালঘু জাতিসত্তা ও ধর্মাবলম্বী। সংখ্যালঘু জাতিসত্তা ও ধর্মাবলম্বী পর্বে সংগঠনটি উল্লেখ করেছে সহনশীলতার নীতি ও সংস্কৃতিকে সর্বোচ্চ পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া হবে। খসড়া কর্মসূচিতে রয়েছে— ক্ষমতার ভারসাম্য, দুর্নীতি প্রতিরোধ, গণমাধ্যম ও বাকস্বাধীনতা।

খসড়ার পররাষ্ট্রনীতি হিসেবে তারা উল্লেখ করেছেন, বাংলাদেশ বিরোধী ঘৃণা প্রচার ও সীমান্ত হত্যা বন্ধ এবং রোহিঙ্গাদের নিরাপদ প্রত্যাবাসনে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া।

খসড়া কর্মসুচিতে তারা আরও বলেছেন—জনস্বাস্থ্য সেবা, দখল ও দূষণ প্রতিরোধ, খাদ্য ও পুষ্টি ও জ্বালানি, খনিজ ও প্রাকৃতিক সম্পদের বিষয়গুলো তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ।

নতুন দলের ঘোষণাকালে দলটির ২১ দফা খসড়া কর্মসূচির পাশাপাশি চারটি মূলনীতির কথা জানা যাচ্ছে। এগুলো হচ্ছে—গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার, অধিকার এবং জাতীয় স্বার্থ। মূলনীতি হিসেবে খুবই প্রয়োজনীয় কিন্তু বাংলাদেশের রাজনীতিতে এই কথাগুলো ক্ষমতাসীনদের মুখে জনগণ বহুবার শুনেছে এবং শুনছে, কিন্তু বাস্তবায়নের উদ্যোগ ক্ষমতায় গিয়ে কাউকে নিতে দেখেনি। বরং গণতন্ত্র ভূলুণ্ঠিত, ন্যায়বিচার সুদূর পরাহত, অধিকার হাত ছাড়া হয়ে যাওয়া আর জাতীয় স্বার্থ বিসর্জন দেওয়ার প্রতিযোগিতাই দেখেছে জনগণ। ফলে কে, কীভাবে এসব নীতির বাস্তবায়ন করবে, তা মানুষ দেখতে চায়।

নতুন ঘোষিত দলের নতুনত্ব কী, এ প্রশ্নে নেতৃবৃন্দ জানান, নতুন দলের চারটি বিষয়ই নতুন। বিষয়গুলো নতুন কি না, তা নিয়ে বিতর্ক হবে। রাজনীতিতে সুস্থ বিতর্কই তো কাম্য। কিন্তু সাধারণভাবে বলা যায় এগুলো গণমানুষের দীর্ঘদিনের লালিত ও পুরোনো আকাঙ্ক্ষা। সেই স্বাধীনতার প্রাক্কালে সাম্য, সামাজিক ন্যায়বিচার ও মানবিক মর্যাদার অঙ্গীকার করা হয়েছিল। সুবর্ণজয়ন্তীর পর তার বিবর্ণ চেহারা জনগণ দেখছে। ফলে ঘোষণা গুরুত্বপূর্ণ কিন্ত এসবের বাস্তবায়ন কীভাবে তারা করবেন, সেটাই দেখার বিষয়।  

কেউ কেউ আবার বলছেন, এ হলো ক্ষমতাসীন দলের উদারতা। দেশে গণতন্ত্র না থাকলে কি কেউ আবার ঘটা করে নতুন রাজনৈতিক দল ঘোষণা করতে পারে? আবার কেউ মনে করছেন, এ হচ্ছে বিরোধী শিবিরে নতুন ফ্রন্ট খুলে বিভক্তি ও বিরোধকে বাড়িয়ে তোলা। যে রাজনৈতিক দলগুলো আছে, সেগুলো তেমন কোনো শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারছে না, সে ক্ষেত্রে নতুন দল কথার চমক সৃষ্টি করতে পারলেও আন্দোলনের গমক তৈরি করতে পারবে না। বরং কারা কী করেছে এবং কী করতে পারেনি, তা নিয়ে বাদবিসম্বাদের নতুন সুযোগ তৈরি হবে।

রাজনীতিতে টাকার খেলা, ধর্মের ব্যবহার, সাম্প্রদায়িকতার বিস্তার এবং ব্যবহার, রাজনীতিতে দুর্বৃত্তদের প্রভাব আর দুর্বৃত্তদের রাজনৈতিক ক্ষমতা বৃদ্ধি গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। আজকের দিনে বুর্জোয়া রাজনীতির প্রধান বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছে কথার মারপ্যাঁচে পুঁজিবাদী অর্থনীতিকেই বহাল রাখা। তারা বৈষম্যের বিরুদ্ধে বলবেন কিন্তু বৈষম্য দূর করার পথে হাঁটবেন না। সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে  বলবেন, কিন্তু সাম্প্রদায়িক শক্তির পৃষ্ঠপোষকতা করবেন, কারণ তাদের কাছে ভোট সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। দ্রব্যমূল্য নিয়ে কথা বলবেন, কিন্তু পক্ষে থাকবেন ব্যবসায়ীদের। জাতীয় স্বার্থের কথা বলবেন, কিন্তু জাতীয় সম্পদ তুলে দেবেন দেশি-বিদেশি করপোরেট প্রতিষ্ঠানের হাতে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে বলবেন, কিন্তু দুর্নীতিবাজদের পাশে রাখবেন। এর নাম দাঁড়িয়েছে রাজনৈতিক কৌশল। ক্ষমতায় যাওয়া এবং থাকার জন্য এসব নাকি প্রয়োজনীয় শর্ত। এই অপরাজনীতির অবসান চাইলে এই রাজনৈতিক ধারার বিরুদ্ধে দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে দীর্ঘস্থায়ী লড়াইয়ের মানসিকতা না থাকলে অনেক আশার জন্ম দিয়েও হতাশাই স্থায়ী হয়ে যাবে। লবণ দিয়ে তৈরি বাঁধ সাগরের ঢেউ কি ঠেকাতে পারে? বরং সাগরের লবণাক্ততাই বাড়িয়ে তোলে। পুরোনো পথে নতুনরা যত জোরেই হাঁটুক না কেন, নতুন গন্তব্যে কি যাওয়া যাবে?  

 

লেখক: রাজনীতিবিদ ও কলাম লেখক

Link copied!