• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ, ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০, ৮ রমাজান ১৪৪৫

এই মৃত্যুর দায় কার?


মোহাম্মদ নূরুল হক
প্রকাশিত: আগস্ট ১৪, ২০২২, ০৭:২৫ পিএম
এই মৃত্যুর দায় কার?

সারা পৃথিবীর মানুষ যখন ব্যক্তিগত তথ্য-অধিকার সুরক্ষায় সচেতন, তখন বাংলাদেশিরা অন্যের বেডরুমের খবর-দৃশ্য প্রকাশে নির্লজ্জ সাধনায় ব্যস্ত। বিশেষত ‘কতিপয় বিকৃত মানসিকতার সাংবাদিক’কে ত্রস্ত-ব্যস্ত হতে বেশি দেখা যায়। যেন অন্যের বেডরুমের সংবাদ সংগ্রহ করতে না পারলে তার সাংবাদিক জীবনের মূল্য কর্পূরের মতো উবে যাবে। তাই তারা ছোটে। তারা ছোটে বন-বাদাড়ে, অলিগলিতে, তারা ছোটে ড্রয়িংরুম থেকে বেডরুমে। খুঁজে বেড়ায় পচাগলা মাংসপিণ্ড-দুর্গন্ধযুক্ত কুকুরের বিষ্টা। আর এসব সংগ্রহ করে এমন উল্লাসে ফেটে পড়ে, যেন মর্ত্যের কোনো তুচ্ছ মানুষ দেবরাজ ইন্দ্রকে পরাস্ত করে স্বর্গের সিংহাসনে আরোহন করার অধিকার পেয়ে গেল। তারা বুঝতেই পারে না, তারা মূলত বোকার স্বর্গে বাস করছে।

এই বোকার স্বর্গে থাকা ব্যক্তিগুলো মানুষের ব্যক্তিগত তথ্য-অধিকার সুরক্ষার পথে উগ্রপন্থীদের মতো বাধা হয়ে দাঁড়ায়। তারা ক্রমাগত মানুষের ছিদ্রান্বেষণে ছোটে। তেমনি একটি ঘৃণ্য ঘটনা ঘটেছে সম্প্রতি। ৪০ বছর বয়সী কলেজশিক্ষক খাইরুন নাহার ও ২২ বছর বয়সী কলেজছাত্র মামুনের বিয়েকে কেন্দ্র করে গণমাধ্যমে সুড়সুড়ি সর্বস্ব সংবাদ প্রচারের হিড়িক পড়ে যায়। এমনকি কেউ কেউ এই দম্পত্তির ভিডিও সাক্ষাৎকার নিতেও উঠেপড়ে লাগে। তাদের পরিচয়, প্রণয়, পরিণয়, দাম্পত্য জীবনের রহস্য ও কারণ; সবই তারা তুলে আনে। এই দম্পত্তিকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে রক্তাক্ত করে তাদের কাছ থেকে তথ্য বের করে নিয়ে আসে। কেবল তথ্যই বের করে আনেনি, সেই তথ্য গণমাধ্যমে প্রকাশের পর সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরালও করায়। এতে টিভি চ্যানেলগুলোর টিআরপি বেড়েছে, অনলাইন নিউজ পোর্টালগুলোর হিট বেড়েছে, প্রিন্ট পত্রিকাগুলোর হয়তো দশ কপি বিক্রি বেশি হয়েছে।

গণমাধ্যমের এই অনৈতিক কর্মকাণ্ডে ফেসবুক সরগরম হয়ে ওঠে। এক শ্রেণীর ফেসবুক বিশেষজ্ঞ এই দম্পত্তির বিয়ের নৈতিকতা-অনৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুললো। কেউ কেউ কনের রুচি নিয়ে প্রশ্ন তুলল, কেউ কেউ বরকে লোভী বলে কটাক্ষ করল। গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের জের ধরে এই দম্পত্তির জীবনকে বিপন্ন করে তোলা হলো মুহূর্তেই। এতে স্ব-স্ব সমাজে উভয় পরিবারের সম্মান নিয়ে ছিনিমিনি খেলার সুযোগ পেল কতিপয় সুযোগসন্ধানী। তারা উঠতে-বসতে হয়তো উভয় পরিবারের সদস্যদের অপদস্ত করল। প্রশ্নের পর প্রশ্নে জর্জরিত করে তুলল। আর কিছু উঠতি সাংবাদিক বর-কনের সাক্ষাৎকার নেওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠল। যেন এই সাক্ষাৎকারই তাদের বেহেশতের টিকিট মিলিয়ে দেবে।

অথচ এই অতি উৎসাহী সাংবাদিকরা একবারও ভাবলেন না, ‘অসম বয়সীদের’ মধ্যে বিয়ের ঘটনা এই প্রথম নয়। এটি নতুন কোনো ঘটনা নয়। যুগ যুগ ধরে এমন ঘটনা ঘটে এসেছে। ৭০ বছরের বৃদ্ধের সঙ্গে যেমন ১৬ বছরের কিশোরীর বিয়ে হয়েছে, তেমনি ২৫ বছরের যুবকের সঙ্গে ৪০ বছরের প্রৌঢ়ার বিয়ে হয়েছে। মানুষ সেইসব ঘটনা-বিয়ে স্বাভাবিকভাবেই মেনে নিয়েছে। বরং কখনো কখনো এসব ঘটনায় মানবিকতা-সহৃদয়তা-মাহাত্ম্য আবিষ্কার করেছে। বিশেষত ৭০ বছরের বৃদ্ধের সঙ্গে যখন ১৬ বছরের কিশোরীর বিয়ে হয়েছে, তখন সমাজ ধন্য-ধন্য করেছে। ৭০ বছরের বৃদ্ধের মধ্যে মাহাত্ম্য খুঁজে পেয়েছে। তাকে দেবতার আসনে বসিয়েছে। বলেছে, এই বৃদ্ধের দয়ার শরীর। অসহায় মেয়েটিকে বিয়ে করে তার একটা গতি করেছে। বৃদ্ধ আর কদিনই বা বাঁচবে। বৃদ্ধের মৃত্যুর পর ওই মেয়েটি অঢেল সম্পত্তির মালিক হবে। এই দেখা ও মূল্যায়নের ভেতর নারীলোলুপ বৃদ্ধের ভেতর যেমন মহৎ হৃদয় আবিষ্কারের চেষ্টা করা হয়েছে, তেমনি কিশোরীটির ভেতর খোঁজা হয়েছে স্বার্থপরতা-লোভ। অর্থাৎ এখানে পুরুষতন্ত্রের কৌশলই বড় হয়ে উঠেছে।

কিন্তু এতসব ‘অস্বাভাবিক রকমের স্বাভাবিক ঘটনার’ নজির থাকার পরও ‘খায়রুন নাহার-মামুন’ দম্পত্তিকে নিয়ে সমাজের কুরুচিপূর্ণ মন্তব্যের অন্ত ছিল না। তারা ক্রমাগত এই দম্পত্তির চরিত্রহনন থেকে শুরু করে তাদের রুচি-উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলে গেছে। অথচ একবারও তারা ভাবেনি, স্বীকার করেনি, অসম বয়সীদের মধ্যে বিয়ের ক্ষেত্রে ধর্মের বাধা নেই। রাষ্ট্রীয় আইনে নিষেধাজ্ঞা নেই। এমনকি প্রথা ও নৈতিকতাও এই ধরনের বিয়ের বিরোধিতা করে না। তাহলে খাইরুন নাহার-মামুনের বিয়ে নিয়ে বিকৃত মানসিকতার ব্যক্তিদের এমন  কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য-বক্তব্য কেন ফেসবুকের টাইমলাইনে দিনের পর দিন ভেসে বেড়াচ্ছে?

একথা ভুলে গেছে চলবে না, মানুষ যত মহৎ কাজই করুক, দিনের পর দিন সে কাজের বিরূপ সমালোচনা হতে থাকলে কাজ-সংশ্লিষ্টরা বিভ্রান্তিতে ভোগেন। অনেক সময় ভোগেন অপরাধবোধেও। নিজেদের সমাজে খাপ-না-খাওয়া মানুষ মনে করেন তারা। এতে হয়ে পড়েন একঘরে-নিঃসঙ্গ। একসময় হতাশা-ক্ষোভ তাদের জীবন থেকে সব ধরনের আনন্দ-উচ্ছ্বাস কেড়ে নেয়। অথচ কোনো অপ্রয়োজনীয় কিংবা মন্দ কাজেরও প্রশংসা মিললে মানুষ তখন উৎসাহী হয়ে ওঠে সেই কাজে। আলোচ্য খায়রুন নাহার-মামুনের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটতে দেখেছি আমরা।

গণমাধ্যম-সোশ্যাল মিডিয়াগুলো যেভাবে সংবাদ প্রচার করেছে, দিনের পর দিন ট্রল করেছে, তাতে এই দম্পত্তি একদিকে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছে হয়তো। বিয়ে নিয়ে তারা বিভ্রান্তিতেও পড়েছেন। পরিবারের সিনিয়র-জুনিয়র সদস্যদের কাছে বারবার তাদের জবাবদিহির মুখোমুখি হতে হয়েছে। এক সাক্ষাৎকারে খায়রুন নাহার নিজেই বলেছেন, তার পরিবারের সদস্যরা বিয়েটা স্বাভাবিকভাবে নেননি। আর মামুনও দৃঢ়তার সঙ্গে উচ্চারণ করেছেন, ‘মন্তব্য কখনো গন্তব্য ঠেকাতে পারে না।’ মামুনের এই মন্তব্যকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করার জন্য সমাজের ছিদ্রান্বেষীরা উদগ্র বাসনা নিয়ে ঝাপিয়ে পড়েছে। সেই উদগ্র চুল্লির গনগনে আগুনে গ্যালন গ্যালন ঘি ঢেলেছে গণমাধ্যম। এক ধরনের রুচিহীন গণমাধ্যম রসিয়ে রসিয়ে সেই ঘিমাখা আগুন ছড়িয়ে দিয়েছে ফেসবুকের টাইমলাইনে।

রোববার (১৪ আগস্ট) সকালে খায়রুন নাহারের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এই লাশ উদ্ধারের খবরও একেক গণমাধ্যম একেকভাবে প্রকাশ করেছে। কেউ বলেছে, ‘সেই শিক্ষিকার লাশ উদ্ধার’,  ‘ছাত্রকে বিয়ে করে ভাইরাল সেই শিক্ষিকার আত্মহত্যা’। একথা অস্বীকার করার সুযোগ নেই যে, খায়রুন নাহারের লাশ উদ্ধারের ঘটনা সত্য, কিন্তু তিনি ‘আত্মহত্যা’ করেছেন ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার আগেই গণমাধ্যমগুলো কী করে নিশ্চিত হলো? তবে কি দেশের কোনো কোনো গণমাধ্যম নিজদায়িত্বে ময়নাতদন্তের কাজও করে? না হলে ‘লাশ উদ্ধার’ না লিখে ‘আত্মহত্যা’ করেছেন, লিখছে কিসের ভিত্তিতে? এও কি তথ্য সরবরাহের কৃতিত্ব নেওয়ার ইঁদুর দৌড়ে একধাপ এগিয়ে থাকার প্রচেষ্টা?

এই দীর্ঘ আলোচনার একটিই উদ্দেশ্য। যারা ভালোবেসে বয়স, পেশার কথা ভুলে প্রেম-প্রণয়ে আবদ্ধ হলেন, তাদের একজনের মৃত্যু এভাবে হবে কেন? খায়রুন নাহার আত্মহত্যা করেছেন? না তাকে হত্যা করা হয়েছে? না তার স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে? ঘটনা যা-ই ঘটুক, কলেজশিক্ষক খায়রুন নাহারকে হত্যা-আত্মহত্যা-মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়ার দায় কি গণমাধ্যম এড়িয়ে যেতে পারবে? গণমাধ্যমগুলো কি এই দায় স্বীকার করে জাতির কাছে ক্ষমা চাইবে? না কি একটি প্রশ্নের পরিষ্কার জবাব দেবে, এই মৃত্যুর দায় কার?

লেখক : কবি-প্রাবন্ধিক-সাংবাদিক।

Link copied!