• ঢাকা
  • রবিবার, ১৯ মে, ২০২৪, ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১,

জননেতা জাতির জনক


মানিক মোহাম্মদ রাজ্জাক
প্রকাশিত: মার্চ ১৭, ২০২২, ০৯:৩৪ এএম
জননেতা জাতির জনক

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কতগুলো অনবদ্য গুণের অধিকারী ছিলেন। যে কারণে তিনি হতে পেরেছেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি—একটি জাতির জাতির পিতা। তিনি যে সময় রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হয়েছিলেন; সে সময় ব্রিটিশ শাসন কাঠামোতে রাজনৈতিক অঙ্গনের পুরোটাই ছিল সামন্ত, জমিদার, ব্যবসায়ী, শিল্পপতিসহ তথাকথিত অভিজাত শ্রেণির নিয়ন্ত্রণাধীনে। বিশেষত মুসলিম লীগে এ প্রবণতা ছিল প্রকটভাবে প্রতিভাত। এহেন অবস্থায় বঙ্গবন্ধু অভিজাততন্ত্রের দেয়াল ভেঙে হয়ে ওঠেন অধিকারবঞ্চিত গণমানুষের নেতা। তিনি যেমন অনলবর্ষী বক্তা ছিলেন, তেমনি ছিলেন নির্ভীক ব্যক্তিত্বের অধিকারী। অধিকন্তু সবকিছু ছাপিয়ে নিজ প্রজ্ঞাগুণে হয়ে ওঠেন সার্থক সংগঠক। তাঁর সফল সাংগঠনিক নেতৃত্বের কারণেই আওয়ামী লীগ হয়ে ওঠে জনগণের প্রাণপ্রিয় সংগঠন। সাংগঠনিক দায়িত্ব ছাড়াও তিনি যখন দুই পর্যায়ে প্রাদেশিক মন্ত্রী ছিলেন এবং পরবর্তী পর্যায়ে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ও প্রেসিডেন্টের চেয়ারে আসীন ছিলেন তখনো জনগণ থেকে দূরে সরে যাননি। জীবনাচারে যেমন ছিলেন একজন সাধারণ মানুষ, রাষ্ট্রাচারের ক্ষেত্রেও ছিলেন সবার মুজিব ভাই বা শেখ সাহেব। 

শৈশবে তিন পর্যায়ে তাঁকে দেখবার সৌভাগ্য হয়েছিল। আগরতলা মামলা হতে মুক্তি লাভের কয়েক মাস পর তিনি পদার্পণ করেছিলেন আমাদের ছোট্ট জনপদে (লালমনিরহাট)। ট্রেন থেকে অবতরণের পর শত শত মানুষের উপস্থিতিতে অতিসাধারণ একজন মানুষের মতো স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে কথা বলেন, কুশল জিজ্ঞেস করেন। এরপর একটি রিকশায় উঠে রওনা দেন সভাস্থলের দিকে। পথিমধ্যে ইচ্ছেমাফিক উৎসুক ছাত্র-জনতা রিকশার পাশে পাশে হেঁটে হেঁটে হাত মেলান। সে সময় ইয়াহিয়া খানের নির্দেশনা মোতাবেক প্রকাশ্য জনসভা নিষিদ্ধ থাকায় থানা আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা আবুল হোসেনের পাটগুদামে তাঁকে কর্মী সভা করতে হয়। দুপুরে খাবার আয়োজন হয় স্থানীয় ব্যবসায়ী আলতু মিয়ার বাড়িতে। শতরঞ্জিতে বসে হাত দিয়েই তিনি খাবার খান। কোনো চেয়ার টেবিল ও কাঁটাচামচের বালাই ছিল না। খাদ্য-খানার বিষয়ে শহীদ সোহরাওয়ার্দীর কথা মনে পড়ছে,  পরিণত বয়সে জেনেছি: বিগত শতকের পঞ্চাশের দশকের গোড়ার দিকে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী কুড়িগ্রাম ভ্রমণকালে নাশতার জন্য মাখন-পাউরুটি ও কাঁটাচামচের প্রয়োজন দেখা দিলে আয়োজকদের মহাসংকটে নিপতিত হতে হয়। অতঃপর লালমনিরহাট রেলস্টেশনের  উচ্চ শ্রেণির ক্যান্টিন হতে সুদূর কুড়িগ্রামে সড়কপথে সেই প্রাতরাশ সরবরাহ করা হয়। খাবারের ক্ষেত্রে শহীদ সাহেবের মতো আরও অনেকের এ ধরনের সাহেবিপনা থাকলেও বঙ্গবন্ধু ছিলেন পুরোমাত্রায় মাছেভাতে বাঙালি।

দ্বিতীয় পর্যায়ে বঙ্গবন্ধুকে দেখেছিলাম স্বাধীনতার পর, ১৯৭৩ সালে কুড়িগ্রামে। সে সভায় লক্ষ লক্ষ মানুষ উপস্থিত ছিলেন তাঁকে একনজর দেখার জন্য। ছিল না কোনো নিরাপত্তা বেষ্টনী। সাধারণ মানুষ ভিড় ঠেলে যারাই সন্নিকটে যেতে পেরেছেন, তারাই তাঁর সান্নিধ্যে ধন্য হয়েছেন। সে সময় সীমান্তের নিয়মকানুন তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে ভারতের কোচবিহার-দিনহাটা ও সীমান্তসংলগ্ন এলাকা হতে হাজার হাজার মানুষ প্রিয় নেতাকে একনজর দেখার জন্য ছুটে এসেছিলেন।

তৃতীয় পর্যায়ে তাঁর দেখা মেলে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ অতিক্রম করার সময়। ফুটপাতে আহত চপ্পল মেরামত করার সময় হঠাৎ চর্মকার আড় চোখে রাস্তার দিকে তাকিয়ে বলেন; মুজিব ভাই আইতেছে। তাঁর কথা শুনে রাস্তার দিকে তাকিয়ে দেখি; সামনে একটি খোলা জিপে কয়েকজন পুলিশ, পেছনে বঙ্গবন্ধুর মোটর কার। কারের কাচ নামানো। তিনি কী যেন পড়ছেন আর পাইপ টানছেন। আজ এত বছর বছরও সেই চর্মকারের ‘মুজিব ভাই’ সম্বোধনটি কানে বাজে। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে কতটা আপন ছিলেন প্রিয় নেতা। ভাবলে আজও বিস্মিত হই।

প্রসঙ্গক্রমে এখানে বঙ্গবন্ধুর সরলতার দুটি ঘটনা উল্লেখ করছি। এর একটি বলেছিলেন রেলওয়ের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. আখতারুজ্জামান। অপরটি বলেছিলেন প্রয়াত রেলওয়ে কর্মকর্ত দীন মোহাম্মদ। আখতারুজ্জামান জানান: ১৯৭৩ সালের দিকে তিনি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেন, তখন প্রায় বিকালে রমনা পার্কে হাঁটতে যেতেন। একদিন বিকালে পুরাতন গণভবনের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় দেখেন গণভবনের গেটের সামনে অনেক লোক দাঁড়িয়ে আছেন। আলাপ করে জানতে পারেন; তারা সবাই বঙ্গবন্ধুকে একনজর দেখার জন্য দাঁড়িয়ে আছেন। অতঃপর তিনিও নেতাকে দেখার জন্য দর্শণার্থীদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে থাকেন। এর কিছুক্ষণ পরই বঙ্গবন্ধু এসে সরাসরি গণভবনে না ঢুকে গাড়ি থেকে নেমে লোকজনের সঙ্গে কুশল বিনিময় করতে থাকেন। একপর্যায়ে আখতারুজ্জামানের পিঠ চাপড়ে অতিচেনা জনের মতো বলেন, ‘কী রে কেমন আছিস?’ সেদিন এক অভূতপূর্ব অনুভূতি নিয়ে তিনি হলে ফিরেছিলেন। আজও সেদিনের স্মৃতি মনে পড়লে তাঁর চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে পড়ে।

দীন মোহাম্মদ সাহেবের স্মৃতি আরও অনেক বেশি আবেগীয়-উদারতাপূর্ণ। তিনি ছিলেন একজন বীরমুক্তিযোদ্ধা। তাঁর ভাষ্যমতে: যুদ্ধের সময় তিনি পড়তেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। অনার্স পাশ করার পর তাঁর ইচ্ছে ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএ পড়ার। এ জন্য এক বন্ধুসহ ঢাকায় ঘোরাঘুরি করতে থাকেন। অতঃপর ঢাকায় ভর্তি  হতে না পেরে ফিরে যান রাজশাহীতে। সেখানে গিয়ে  জানতে পারেন; ভর্তির সময় শেষ। অনেক অনুরোধ করার পরও সেখানে ভর্তি হতে পারেননি। অগত্যা আবার ঢাকায় ফিরে আসেন। ঢাকায় ফিরে বঙ্গবন্ধুর সহায়তা নেওয়ার চেষ্টা করতে থাকেন। কিন্তু কোনো কূল কিনারা করতে পারছিলেন না। অগত্যা একদিন বিকেলে দু’বন্ধু হাজির হন গণভবনে। সেখানে গিয়ে নিরাপত্তা রক্ষীদের কাছে জানতে পারেন বঙ্গবন্ধু দোতলায় বিশ্রাম নিচ্ছেন। এ তথ্য জানার পর দুই বন্ধু নিরাপত্তা রক্ষীদের বাধা উপেক্ষ করে দৌড় দিয়ে দোতলায় গিয়ে হাজির হন। পেছনে পেছনে নিরাপত্তা রক্ষীরা তাঁদের আটক করার জন্য সেখানে গিয়ে হাজির হন। ওখানে গিয়ে দেখেন বঙ্গবন্ধু একটি ইজিচেয়ারে আরাম করছেন। তাদের ওভাবে রুমে ঢুকে হাপাতে দেখে বঙ্গবন্ধুও কিছুটা বিচলিত হন। তারপর নিরাপত্তা রক্ষীদের বিদায় করেন। তাদের বসতে বলেন। পরিস্থিতি কিছুটা স্থির হবার পর বঙ্গবন্ধু নিজ হাতে বানানো দু’কাপ চা ধরিয়ে দিয়ে এভাবে আগমনের হেতু জানতে চাইলে তারা ভর্তি বিষয়ক সমস্যার কথা তুলে ধরে তাঁর সহায়তা কামনা করেন। সবকিছু শোনার পর তিনি আর কথা না বাড়িয়ে পিএসকে ডেকে তাঁদের দুজনকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ দেওয়ার জন্য ভিসি মোজাফফর সাহেবকে ডিও লেটার লেখার নির্দেশনা দেন এবং তাদের পরদিন ভিসির সঙ্গে দেখা করার কথা বলে পিঠে হাত বুলিয়ে বিদায় দেন। বলা বাহুল্য, দীন মোহাম্মদ স্যার ও তার বন্ধু পরদিন ভিসি মহোদয়ের সাথে সাক্ষাতের পর তাঁদের এমএ-তে ভর্তি করানোর ব্যবস্থা করা হয়।

বঙ্গবন্ধু সব সময় বলতেন ‘আমি আমার জনগণকে খুব বেশি ভালোবাসি।’ কথাটি শুধু কপচানো বুলি ছিল না। বাস্তবেও তিনি প্রাণ দিয়ে ভালোবাসতেন তাঁর দেশের জনগণকে। সেই আত্মবিশ্বাসের কারণেই তিনি মনে করতেন: কোনো বাঙালির পক্ষে তাঁকে হত্যা করা সম্ভব নয়। বাস্তবতাও তাই, কোনো বাঙালি তাঁকে হত্যা করেনি, হত্যা করেছিল বাঙালি নামধারী পাকিস্তানি প্রেতাত্মারা। 

 

লেখক: মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক লেখক          

Link copied!