• ঢাকা
  • রবিবার, ১৯ মে, ২০২৪, ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১,

গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানে নতুন ইসি কতটুকু সক্ষম?


সাইফুর রহমান তপন
প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ২৮, ২০২২, ০৩:৪৭ পিএম
গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানে নতুন ইসি কতটুকু সক্ষম?

রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ আগামী পাঁচ বছরের জন্য নতুন প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও চারজন নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ দিয়েছেন। প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) পদে নিয়োগ পেয়েছেন সাবেক জ্যেষ্ঠ সচিব কাজী হাবিবুল আউয়াল। আর চার কমিশনার হলেন অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ বেগম রাশিদা সুলতানা, অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আহসান হাবীব খান, সাবেক দুই জ্যেষ্ঠ সচিব মো. আলমগীর ও আনিছুর রহমান। ইতিমধ্যে তাঁরা শপথও নিয়েছেন।

এর আগে বৃহস্পতিবার সার্চ কমিটির সদস্যরা রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করে উক্ত পদগুলোর জন্য ১০ জনের নাম প্রস্তাব করেন। সে তালিকা থেকে রাষ্ট্রপতি সিইসিসহ পাঁচজনকে বেছে নিয়েছেন।

 যে পদ্ধতিতে নতুন নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠন করা হয়েছে, তা দৃশ্যত আগের মতোই। আগের মতো মানে যে পদ্ধতিতে বর্তমান সরকারের আমলে গত দুটি ইসি গঠিত হয়েছিল তা। ওই দুবারের মতো এবারও নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে রাষ্ট্রপতি সংলাপ করেছেন। তারপর গঠন করেছেন একটি সার্চ কমিটি। আগের দুবারও সার্চ কমিটি ১০ জনের নাম প্রস্তাব করেছিল, যাদের মধ্য থেকে ৫ জনকে নিয়ে ইসি গঠিত হয়েছিল।

তবে এবার ইসি গঠন প্রক্রিয়ায় নতুন কিছু বিষয় যুক্ত হয়েছে যা উল্লেখ করার মতো। দেশে প্রথমবারের মতো সংবিধানের নির্দেশনা মেনে ইসি গঠনের জন্য একটি আইন তৈরি হয়েছে। সে আইনের অধীনে গঠিত হয়েছে সার্চ কমিটি এবং ইসি। অতীতে দেখা গেছে, ইসি গঠনের সময় হলেই ক্ষমতাসীন দল তাদের খেয়ালখুশিমতো কয়েকজন লোককে সিইসি ও অন্যান্য পদে বসিয়ে দিত। খুব স্বাভাবিকভাবেই বিরোধী দল থেকে এর বিরুদ্ধে আপত্তি উঠত; কখনো কখনো যা সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে প্রবল রাজনৈতিক সংঘাতে রূপ নিত। নির্বাচন কমিশন আইনটি কার্যকর হওয়ার কারণে ব্যক্তি বা দলের খেয়ালমাফিক প্রধান নির্বাচন কমিশনার বা অন্য কমিশনারদেরও নিয়োগের সুযোগ কমে গেছে—এমন কথা এখন বলাই যায়। কারণ আইনটিতে শুধু ইসি সদস্য নয়, সার্চ কমিটির সদস্য কারা হবেন, তা-ও পরিষ্কার করে বলা আছে। যারা বলছেন এ আইনের অধীনেও সরকারের ‘আজ্ঞাবহ’ লোকেরাই ইসিতে জায়গা পাবে, তারা হয়তো ঠিকই বলছেন। তবে আইনে যেহেতু ইসি সদস্যদের গুণাবলি স্পষ্ট করে বলা আছে, ইসি সদস্যদের মানুষ তার মতো করে যাচাই করতে পারবে।

এ কথাও না মানার কোনো কারণ নেই যে, আইনটিকে আরও শক্ত করা যায়, যাতে করে ইসি গঠন প্রক্রিয়াটা আরও স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক হয়। আমাদের ধারণা, আগামীতে এমন চিন্তার পক্ষে জনমত গড়ে উঠবে, যার কারণে আইনটিকে আরও উন্নত করার প্রচেষ্টা নেওয়া হবে।

এবারের ইসি গঠন প্রক্রিয়ায় আরেকটি বিষয় ছিল চোখে পড়ার মতো। তা হলো, সার্চ কমিটি ইসির জন্য দক্ষ ও গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিদের বাছাই করার লক্ষ্যে শুধু রাজনৈতিক দলগুলোকে আহ্বান জানিয়েই বসে থাকেনি, বিশিষ্ট নাগরিক ও সাংবাদিকদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করেছে। তা ছাড়া, বিভিন্ন মহলের দাবি মেনে সার্চ কমিটি বিভিন্ন রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন এবং ব্যক্তিবর্গের প্রস্তাবের ভিত্তিতে তৈরি প্রাথমিক তালিকাটি জনগণের মতামতের জন্য প্রকাশ করেছিল। এসব উদ্যোগ কিছুটা হলেও ইসি গঠন প্রক্রিয়ায় জনগণের অংশগ্রহণের সুযোগ তৈরি করেছে এবং কারা ইসিতে যাচ্ছেন তাদের সম্পর্কে জনগণকে ধারণা পেতে সহায়তা করেছে।

প্রক্রিয়াটা নিশ্চয় আরও স্বচ্ছ হতো যদি সার্চ কমিটি প্রস্তাবিত ১০ জনেরর নামও জনগণের বিবেচনার জন্য প্রকাশ করা হতো। তবে এ বিষয়ে সার্চ কমিটি যে ব্যাখ্যা দিয়েছে তা-ও ফেলে দেওয়া যাবে না। কমিটি বলেছে, আইন অনুসারে তাদের বাছাইকৃত ১০ জনের নাম ‘জানার অধিকার’ শুধু রাষ্ট্রপতিরই আছে। তাই তারা সেগুলো প্রকাশ করেননি। ভবিষ্যতে আইনটি সংস্কারের মাধ্যমে হয়তো এ বিষয়টিও নিশ্চিত করা হবে।

আমার ধারণা, ন্যূনতম এ স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার চেষ্টার জন্যই নতুন ইসি সদস্যদের নাম প্রকাশিত হওয়ার পর তাঁদের বিরুদ্ধে জনপরিসরে এখনো খুব বেশি নেতিবাচক কথাবার্তা শোনা যায়নি। সরকারি দল আওয়ামী লীগসহ অনেকেই নতুন ইসি সদস্যদের অভিনন্দন জানিয়েছে। কেউ কেউ এ ইসির সাফল্যের ব্যাপারে শর্তযুক্ত হলেও আশাবাদ ব্যক্ত করেছে। বিএনপিকে বিপর্যস্ত করে আওয়ামী লীগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারে, এমন একটা বিকল্প বিরোধী দল তৈরির জন্য গত এক যুগ ধরে সরকার নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করলেও, জেনারেল জিয়া প্রতিষ্ঠিত ডানপন্থিদের আশ্রয়স্থল এ দলটিই এখনো আওয়ামী লীগের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী। দলটি নতুন ইসিকে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেছে। একটা গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রশ্নে বিএনপির এ অবস্থানকে গুরুত্বহীন ভাবার সুযোগ না থাকলেও, নবগঠিত ইসি নিয়ে দলটির এমন প্রতিক্রিয়া অপ্রত্যাশিত ছিল না। কারণ, শুরু থেকেই দলটি নতুন ইসি গঠনের প্রক্রিয়াটি বর্জন করেছে। তারা বরাবরই ইসি গঠনের আগে নির্বাচনকালীন সরকার বিষয়ে আলোচনা চেয়েছে।

তারা বলছেন আওয়ামী লীগের পছন্দের লোকদেরই নতুন ইসিতে বসানো হয়েছে, তারা ভুল বলছেন, এমনটি বলা যাবে না। কারণ, ক্ষমতায় আছে আওয়ামী লীগ আর তাদের অপছন্দের লোকজন ইসিতে আধিপত্য চালাবে, এমন দৃশ্য কল্পনা করা যায় না। তবে ইসিতে বিরুদ্ধ মতের লোক তারা একেবারে পছন্দ করে না, তা-ও ঠিক নয়। সদ্যবিদায়ী ইসিই তার প্রমাণ। সেখানে সদস্য হিসেবে বিএনপি-প্রস্তাবিত মাহবুব তালুকদার পাঁচটি বছর নির্বিঘ্নে কাটিয়ে গেলেন, যদিও তিনি এক দিনের জন্যও নির্বাচন বিষয়ে সরকারের জন্য স্বস্তিকর কোনো কথা বলেননি। আর এবারের ইসি যদি সরকারের পছন্দের লোকদের দ্বারাই গঠিত হয়ে থাকে, তাহলে বলতেই হবে যে অন্তত সিইসি প্রশ্নে বিরোধীদের সঙ্গে সরকারের পছন্দ এক হয়ে গেছে। কারণ, নতুন সিইসির নাম শুধু সরকারের বন্ধু রাজনৈতিক দলের তালিকাতেই ছিল না, ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর তালিকায়ও ছিল। কাজী হাবিবুল আউয়ালকে সিইসি পদে বসানোয় ডা. জাফরুল্লাহ শুধু সরকারকে অভিনন্দন জানাননি, বিএনপিসহ সব বিরোধী দলের প্রতি নতুন সিইসিকে মেনে নেওয়ার জন্য আহ্বানও জানিয়েছেন। কে অস্বীকার করতে পারবে, ডা. জাফরুল্লাহ বর্তমান সরকারের একজন কট্টর সমালোচনাকারীই নন, সরকারকে উৎখাত করার জন্য রাজপথে রীতিমতো জোট গঠন করে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন।

এ প্রসঙ্গে অধুনালুপ্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের গঠন প্রক্রিয়াটির কথাও বলা যায়। ওই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান আগে থেকে নির্ধারিত থাকলেও সদস্য কারা হবেন, তা আওয়ামী লীগ-বিএনপির মতো বড় রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে নেওয়া তালিকা থেকে ঠিক হতো। এর ফলে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন পরিচালনায় খুব একটা সমস্যা হয়নি।

আসলে চীনা নেতা দেং জিয়াও পিং-এর ওই কথাটাই সত্য, বিড়াল কালো না সাদা, তা কোনো বিষয় নয়, ইঁদুর মারলেই হলো। তেমনি ইসিতে কার পছন্দের লোক বেশি, তা না খুঁজে আমাদের দেখা দরকার, তারা একটা অবাধ অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানে সক্ষম কি না। এটা অবশ্যই যখন ফল ফলবে, তখনই ঠিকভাবে বলা যাবে। নতুন ইসির সদস্যদের সততা ও দক্ষতার ব্যাপারে খুব একটা বিতর্ক নেই। তবে জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য একটা নির্বাচন অনুষ্ঠানে তাঁরা কতটুকু আন্তরিক, সেটাই হলো বড় কথা। আর মাত্র দুই বছরের কম সময়ের মধ্যে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচনটি অংশগ্রহণমূলক করার জন্য সব রাজনৈতিক দলকে আস্থায় নিতে তাঁরা কী করেন, সেটাই এখন দেখার বিষয়। এটা ঠিক, একা নির্বাচন কমিশনের পক্ষে নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু করা সম্ভব নয়; এজন্য প্রশাসন, রাজনৈতিক দলসহ সব অংশীজনের সহযোগিতা দরকার। কিন্তু এটাও ঠিক যে, একটা সুষ্ঠু, অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত করার প্রশ্নে ইসি যদি দৃঢ় ও আন্তরিক হয়, তাহলে অন্যদের পক্ষে ভিন্ন কিছু ভাবা কঠিন হয়ে পড়ে।

 

লেখক: সাংবাদিক

Link copied!