• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ৯ শাওয়াল ১৪৪৫

আবু সাঈদ চাঁদের হুমকি কতটা ‘বিচ্ছিন্ন’, কতটা ‘উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’?


কবির য়াহমদ
প্রকাশিত: মে ২৩, ২০২৩, ০৬:৪৪ পিএম
আবু সাঈদ চাঁদের হুমকি কতটা ‘বিচ্ছিন্ন’, কতটা ‘উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’?

প্রধানমন্ত্রীকে ‘কবরস্থানে’ পাঠানোর হুমকি দিয়েছেন রাজশাহী বিএনপির জেলা পর্যায়ের এক শীর্ষ নেতা। রাজশাহী জেলা বিএনপির আহ্বায়ক মো. আবু সাঈদ চাঁদ কেন্দ্র ঘোষিত এক কর্মসূচিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে কবরস্থানে পাঠিয়ে দেওয়ার হুমকি দেন। ওই সভায় উপস্থিত ছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য, সাবেক প্রতিমন্ত্রী সেলিমা রহমান।

গত ১৯ মে বিএনপির কেন্দ্রীয় কর্মসূচির অংশ হিসেবে রাজশাহীর পুঠিয়ার শিবপুরে অনুষ্ঠিত সমাবেশে সভাপতির বক্তব্যে আবু সাঈদ চাঁদ বলেন, “আর ২৭ দফা ১০ দফার মধ্যে আমরা নাই। একদফা—শেখ হাসিনাকে কবরস্থানে পাঠাতে হবে। শেখ হাসিনাকে কবরে পাঠাতে হবে। শেখ হাসিনাকে পদত্যাগ করার জন্য যা যা করার দরকার আমরা করব।” বিএনপির জেলা পর্যায়ের ওই শীর্ষ নেতা যখন প্রধানমন্ত্রীকে হত্যার হুমকি দিচ্ছিলেন, নেতাকর্মীদের উসকে দিচ্ছিলেন, তখন দলটির নেতাকর্মীরা তাতে আওয়াজ তোলে সমর্থন দিচ্ছিল, এবং কেন্দ্রীয় নেত্রী সেলিমা রহমানও এর প্রতিবাদ করেননি, থামতে বলেননি; বরং প্রশ্রয় দিয়েছেন। তার এই প্রশ্রয় সমর্থন কি নয়?

আবু সাঈদ চাঁদ বিএনপির অপরিচিত কোনো নেতা নন। সাংগঠনিকভাবে তিনি জেলা বিএনপির আহ্বায়ক এবং জাতীয় স্থায়ী কমিটির পুরনো সদস্য। তিনি দলের সমর্থনে-মনোনয়নে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে অংশ নিয়ে দুইবার চেয়ারম্যান হয়েছেন। সংসদ নির্বাচনে দলের প্রার্থিতাও পেয়েছিলেন, যদিও সংসদ নির্বাচন করা হয়নি তার। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রাজশাহী-৬ আসন (চারঘাট-বাঘা) থেকে বিএনপির প্রার্থী ছিলেন আবু সাঈদ চাঁদ। নির্বাচনে অংশ নিতে চারঘাট উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যানের পদ থেকে পদত্যাগ করেন তিনি। আইনি জটিলতার কারণে মনোনয়নপত্র যাচাই-বাছাইয়ের দিন তার প্রার্থিতা বাতিল হয় তার। এরপর তিনি নির্বাচন কমিশনে আপিলে মনোনয়ন ফেরত পেলেও সুপ্রিম কোর্ট আবু সাঈদ চাঁদের প্রার্থিতা স্থগিত করেন। ফলে, অংশ নেওয়া হয়নি নির্বাচনে। গত নির্বাচনের সময়ে নাশকতাসহ ২১টি মামলা ছিল তার বিরুদ্ধে।  

সমাবেশে তিনি যে বক্তব্য দিয়েছেন এটা দলের একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতার দিক নির্দেশনাই। তিনি যে পর্যায়ের রাজনীতি করেন, এবং যে পর্যায়ের নেতারা ওই সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন তাতে করে এই বক্তব্য ও সমাবেশকে ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’ ভাবার অবকাশ নেই। একদিকে তিনি যেমন দলকে প্রতিনিধিত্ব করছেন, আরেকদিকে দলটির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের সর্বোচ্চ স্তরের নেত্রীও ছিলেন উপস্থিত। সুতরাং এই বক্তব্যকে হালকাভাবে দেখার অবকাশ নেই, ‘বিচ্ছিন্ন বক্তব্য’ কিংবা ‘স্লিপ অব টাং’ হিসেবে আখ্যা দেওয়ারও সুযোগ নেই।

দীর্ঘদিন ধরে বিএনপি ক্ষমতার বাইরে। এই সময়ে তারা মাঠের আন্দোলনে থাকার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে, নির্বাচনে অংশ নিয়েও ব্যর্থ হয়েছে। ক্ষমতায় থাকাকালে ২১ আগস্টে নারকীয় তাণ্ডব চালিয়ে তারা শেখ হাসিনাকে ‘কবরস্থানে’ পাঠানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে। এতশত ব্যর্থতায় দলটির নেতাকর্মীরা একদিকে যেমন উদভ্রান্ত, অন্যদিকে ভুলে গেছে রাজনৈতিক শিষ্টাচারের সঙ্গে সঙ্গে ব্যক্তি পর্যায়ের নীতি-নৈতিকতাসহ সভ্যতা-ভব্যতা। তা না হলে এমন ন্যক্কারজনক হুমকি কীভাবে দেওয়া?

মাঠের আন্দোলনের ব্যর্থ বিএনপিকে আমরা দেখে আসছি। নানা কর্মসূচির বাইরে বিএনপি নেতাকর্মীদের চিন্তা আর মানসিকতার সঙ্গেও আমরা পরিচিত। এবং অপ্রত্যাশিতভাবে বেশিরভাগেরই মানসিকতা ‘রাতের আঁধারের খুনোখুনিতে’ এখন সীমাবদ্ধ! বেশিরভাগই ‘তৃতীয়’ কাউকে দিয়ে সরকারকে হটাতে আগ্রহীও। এই রাজনৈতিক দৈন্য, মানসিক দৈন্য ক্রমে শক্তিশালী হয়ে ওঠছে। আবু সাঈদ চাঁদ যে হুমকি দিয়েছেন, সেটা বিএনপির অধিকাংশই বর্তমানে ধারণ করে, এবং এটাই তাদের কাছে এখনকার রাজনীতি কিংবা উদ্দেশ্য! এটা যে কেবলই বিএনপির অভ্যন্তরীণ বিচ্ছিন্ন আলাপই নয়, সেলিমা রহমান উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত সমাবেশই তার বড় প্রমাণ।

সরকারকে হটাতে বিএনপির নেতাকর্মীরা কেন তৃতীয় পক্ষ চায়, কেন রাতের আঁধারের আততায়ীর অপেক্ষা করে—প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে বেগ পেতে হয় না। উচ্ছৃঙ্খল সেনা অফিসারের দ্বারা রাতে আঁধারে খুনের ওপর দাঁড়িয়ে যে দলের জন্ম ও রাজনীতি, সেই দলের নেতাকর্মীরা কীভাবে বের হয় ওখান থেকে? সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের পরের পর্যায় বেগম খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের সময় আমরা দেখেছি ২১ আগস্টের নারকীয় গ্রেনেড হামলা, যা প্রকাশ্য-দিবালোকে নজিরবিহীন বটে! তবু আশা ছিল বদলাবে বিএনপি! কিন্তু দুঃখজনক বাস্তবতা হলো তারা বদলায়নি। তার প্রমাণ রাজশাহীর শীর্ষ নেতা আবু সাঈদ চাঁদ ও তার উসকানি।

আবু সাঈদ চাঁদের এমন হুমকির পর আমরা আশা করেছিলাম বিএনপি সাংগঠনিক প্রতিক্রিয়া দেবে, ব্যবস্থা নেবে। কিন্তু সেটা তারা করেনি। অর্থাৎ এমন অনাকাঙ্ক্ষিত বক্তব্যকে দলটি ধারণ করছে। যদিও বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা এবং রাজশাহী সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র ও রাজশাহী সদরের সাবেক এমপি মিজানুর রহমান মিনু এজন্যে দুঃখপ্রকাশ করেছেন। তবে তার এই দুঃখপ্রকাশের ভাষা ও ভঙ্গি যা সেটা স্রেফ তার ব্যক্তিগত প্রতিক্রিয়া। এখানে উচিত ছিল তাৎক্ষণিক সাংগঠনিক ব্যবস্থা, প্রথমে কারণ দর্শানোর চিঠি, এবং অতঃপর বহিষ্কার। এর কিছুই অদ্যাবধি হয়নি।

খুনের রাজনীতিতে ‘আসক্তি’ কি যায়নি এখনো বিএনপির? খুনের ধারাবাহিকতার এই রাজনীতি বিএনপির কালো অধ্যায়ের সঙ্গে নতুন সংযোজন, আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গনের জন্যেও। দেশবাসী এমন রাজনীতি আশা করে না। প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ করে সরাসরি হত্যার হুমকির এই রাজনীতির নিন্দা জানাই, প্রতিবাদ করি, দাবি করি আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের।

আবু সাঈদ চাঁদসহ যারাই এমন ঘৃণ্য রাজনীতির ধারক-বাহক-উপাসক-সমর্থক সেই ব্যক্তিবিশেষের নয়, তাদের রাজনীতির কবর রচিত হোক! 

 

লেখক : সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক

Link copied!