• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ০২ মে, ২০২৪, ১৯ বৈশাখ ১৪৩১, ২৩ শাওয়াল ১৪৪৫

তিনি চললেন, কাঁদলেন, কাঁদালেন


অঘোর মন্ডল
প্রকাশিত: ডিসেম্বর ১১, ২০২২, ০৩:২২ পিএম
তিনি চললেন, কাঁদলেন, কাঁদালেন

জীবনে অনেক কিছু পেয়েছেন তিনি। তার ক্যাবিনেটে ইউরোপ সেরার ট্রফি। কতগুলো ব্যলন ডি ও‍‍`র। একাধিক চ্যাম্পিয়নস ট্রফি। কিন্তু নেই শুধু বিশ্বকাপ। আগামী বিশ্বকাপ খেলে তিনি পর্তুগালকে চ্যাম্পিয়ন করবেন এই অলীক স্বপ্ন সাইত্রিশ বছরের ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোকে ঘিরে কেউ দেখছেন না। বিশ্বকাপ হয়তো আর কোনদিন হাতে তোলা হবে না তার। কিন্তু চোখের জলে বিশ্বকাপকে বিদায় জানানো রোনালদোকে আপনি ভুলবেন কীভাবে?নেইমারের পর রোনালদোও চোখের জলে খালি হাতে কাতার থেকে বিদায় নিলেন।

রোনালদোও জানলেন বিশ্বকাপ জিততে অনেক কিছু লাগে। প্রতিভা লাগে। পরিশ্রম লাগে। টিম গেমে মোটামুটি ভালো একটা টিমও লাগে। তবে তারকা থেকে বিশ্বকাপ জিতে মহাতারকা হতে লাগে ভাগ্য! আপনি সবাইকে ডজ দিয়ে গোল করতে পারেন। গোল করাতে পারেন। কিন্তু আপনি ভাগ্যকে হারাবেন কীভাবে? আপনি যত বড় ফুটবলারই হন না কেন!

ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোও ভাগ্যকে হারাতে পারলেন না। তাই চোখের জলে বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নিলেন। নিয়তির কি পরিহাস! যে লোকটা দিনের পর দিন, বছরের পর বছর একা কাঁধে বয়ে নিয়েছেন পর্তুগালকে। যিনি পর্তুগালকে ইউরোপ সেরা করেছেন। তিনি নিজের শেষ বিশ্বকাপের শেষ ম্যাচে প্রথম একাদশেই থাকতে পারলেন না! দলকে সেমিফাইনালে তোলার চেষ্টায় মরক্কোর বিপক্ষে পুরো সময় খেলার সুযোগ পেলেন না।

বিশ্বকাপ মঞ্চে কিছু ফুটবলার বরাবরের মতো বঞ্চিত। হতভাগ্য। রোনালদো আপনি জিনিয়াস হয়েও সেই বঞ্চিতদের দলে থাকলেন। বঞ্চিতদের নিয়ে সর্বকালের সেরা টিম গড়লে কোনো ফার্নান্দোস আপনাকে একাদশের বাইরে রাখতে পারবেন না!

বিশ্বকাপ জিততে পারলেন না। কিন্তু ফুটবল নিয়ে আপনার ধ্বংসাত্মক কিন্তু সৃষ্টিশীল ভয়ঙ্কর সুন্দর রোমান্টিক যে ইমেজারি সেটা ডিলিট হয়ে যাবে না। আপনার বিরুদ্ধে উচ্ছৃঙ্খলতার অভিযোগটা নতুন না। কিন্তু উচ্ছৃঙ্খল হয়েও ফুটবল খেলে মানুষকে এতো আনন্দ ক‍‍`জন খেলোয়াড় দিতে পেরেছেন!
আপনার চোখের জল শুকিয়ে যাবে। মানুষও ঐ দৃশ্যটা ভুলে যাবে। কিন্তু ফুটবল সমাজকে মনে রাখতে হবে-- বল পায়ে আপনার ক্ষিপ্র গতির দৌঁড়।  বাকানো কর্নার কিক। গোলার মতো আপনার পা থেকে বেরিয়ে আসা ফ্রি কিক বা পেনাল্টি কিক!

কিন্তু বিশ্বকাপ মঞ্চ থেকে ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো যেভাবে বেরিয়ে গেলেন সেটাও মনে রাখতে হবে। সি আর সেভেন নামে ফুটবল বিশ্ব যাকে চেনে তিনি কি সেই লোক! তিনি তো পৌরুষদীপ্ত এক পর্তুগিজ। যিনি ফুটবল আর জীবনকে একইভাবে উপভোগ করেন। পেশাদার জীবনে কত উত্থান-পতনের মধ্যে দিয়ে গেছেন। গ্ল্যামার-অর্থ-বিত্ত সবই তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করা লোক তিনি। কিন্তু বিশ্বকাপে শোকের আগুনে পুড়ে সবই তার ভষ্ম হয়ে গেল! বিশ্বকাপ থেকে এর আগে বার চারেক ফাইনালের আগে বিদায় নিয়েছে পর্তুগাল আর গরোনালদো। কিন্তু এভাবে এভাবে কাঁদতে কাঁদতে কি তাকে বেরিয়ে যেতে দেখেছেন? এই কান্না রোনালদোর নামের সঙ্গেও ঠিক যায় না! তার আবেগ উচ্ছ্বাসের। উল্লাসের। উদযাপনের। কিন্তু কাতারে দেখা গেল আবেগের  হিমশৈল হয়ে দাঁড়ানো এক রোনালদোকে! যিনি কাঁদতে কাঁদতে টানেল দিয়ে চলে গেলেন। তিনি হয়তো ভুলে গিয়েছিলেন, লোকে অন্যের দুর্দশা দেখলে খুশি হয়! কাঁদতেই যদি হয়, বাথরুমে গিয়ে কাঁদা ভালো। গোপনে। কারণ এই কান্না বা চোখের জল আপনাকে আর ফিরিয়ে দেবে না বিশ্বকাপের মঞ্চ। আপনি না নিজেই বহুবার বলেছেন, ‍‍`আমি-ই এক নম্বর!‍‍` চ্যাম্পিয়নরা কাঁদে খুশিতে। আনন্দে। উচ্ছ্বাসে। পারিপার্শ্বিকতাকে চূড়ান্ত আন্ডার এস্টিমেট করলেও ভেঙে পড়েন না। কিন্তু আপনি ভেঙে পড়লেন। কারণ ততক্ষণে আপনি নিজেও জেনে গেছেন রেফারির শেষ বাঁশির সঙ্গে সঙ্গে আপনি অতীত। পেছনে থেকে গেলো বিশ্বকাপ জিততে না পারার আক্ষেপ, দীর্ঘশ্বাস আর বেদনার ইতিহাস।

কিন্তু আপনি ছিলেন পর্তুগিজদের ভরসাস্থল। শুধু পর্তুগিজ কেন, বিশ্বজুড়ে অনেক ফুটবলপ্রেমীর ভালোবাসার নাম। কিন্তু আপনার দেশের কোচ ফার্নান্দো স্যান্টোস আপনার উপর ভরসা রাখতে পারলেন না! রাখলে আপনি পর্তুগালকে সেমিফাইনালে টেনে তুলতে পারতেন তারও গ্যারান্টি ছিলো  না। তবে এটা ঠিক বিশ্বের সর্বকালের সেরা ফুটবলারদের একজন ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোকে রিজার্ভ বেঞ্চে প্রথমার্ধে বসিয়ে রেখে তাকে অসম্মানই করা হয়েছে।

ফার্নান্দো স্যান্টোস, আপনি যত যুক্তি-তর্ক দাঁড় করান তার কিছুই মনে রাখবে না ইতিহাস। কিন্ত মহাকাল মনে রাখবে একজন অক্ষমের চোখের জলকে। কারণ তার নাম ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো। আকুল আর্তি নিয়ে মর্মভেদী অপলক চোখে যিনি তাকিয়ে ছিলেন রিজার্ভ বেঞ্চে বসে। আর দ্বিতীয়ার্ধে মাঠে নেমে ম্যাচ শেষে বেরিয়ে গেলেন চোখের জল মুছতে মুছতে। হয়তো আর কোন দিন ফিরবেন না বিশ্বকাপে।

রোনালদো এখন অতীত। এটাই সত্যি। কিন্তু আগামী প্রজন্মের জন্য রেখে গেলেন এমন কিছু যা রবি ঠাকুরের গানের কথাকেই মনে করিয়ে দেয়। ‍‍`দিনের পথিক মনে রেখো /আমি চলেছিলেম রাতে/ সন্ধ্যা প্রদীপ নিয়ে হাতে।‍‍`

এতোটা অপমান, এতোটা অসম্মান,এতোটা অনাদর সত্যি কি প্রাপ্য ছিলো রোনালদোর! ফুটবল এতো নির্দয়, নিষ্ঠুর,নির্মম কেন? চোখের জলে কেন বিশ্বকাপের খাজনা মেটাতে হলো রোনালদোকে!

Link copied!