• ঢাকা
  • শুক্রবার, ০৩ মে, ২০২৪, ২০ বৈশাখ ১৪৩১, ২৪ শাওয়াল ১৪৪৫
কানান্তর

তারিফ বোঝা যায় তালির স্থায়িত্ব দিয়ে


বিধান রিবেরু
প্রকাশিত: মে ২৪, ২০২২, ০৫:৩০ পিএম
তারিফ বোঝা যায় তালির স্থায়িত্ব দিয়ে

বড় তারকাকে কাছে পেলে সাধারণ মানুষ নাকি চিমটি কেটে দেখতে চায়। মানে, তারকাও যে রক্ত-মাংসেই গড়া, তা বিশ্বাসই হতে চায় না অনেকের। ঢাকার এফডিসির গেটে এই কিছুদিন আগ পর্যন্তও লোকে ভিড় করে থাকত, এই বুঝি রাজ্জাক বা ববিতা এফডিসির ভেতরে ঢুকবেন। গাড়ির জানালা দিয়ে একনজর দেখতে পেলেই জীবন ধন্য। কানেও একই অবস্থা। এক ভেন্যু থেকে আরেক ভেন্যুতে যাওয়ার সময় এই ভক্ত, অনুরাগী ও পাপারাজ্জিদের যন্ত্রণায় হাঁটাই যায় না। এ জন্য ঘুরপথ বেছে নিতে হয়, এতে সময় বেশি লাগে, হাঁটতেও হয় অনেক। উৎসবের মূল ভবন প্যালে দে ফেস্তিভাল, মেজেস্টিক হোটেল ও ম্যারিয়ট হোটেলের সামনে ভিড় লেগেই থাকে, এফডিসির গেটও ফেল।

তা-ও ভালো সকালে যখন স্ক্রিনিং দেখতে ম্যারিয়ট হোটেল পেরিয়ে পাশের থিয়েত খোয়াসেতে যাই, তখন ভক্তকুল থাকে না, দু-একজন ক্যামেরাম্যান দাঁড়িয়ে থাকে শুধু, আর কালো সুট-বুট-চশমা পরা গোমড়ামুখো গার্ড। সকাল সাড়ে আটটার স্ক্রিনিং ধরা খুবই চ্যালেঞ্জিং কাজ। কারণ, ভ্যালুরির গলফ-জুয়ান বাসস্ট্যান্ডে বাস আসে আধা ঘণ্টা পরপর। কিন্তু সময় নির্দিষ্ট করা নেই। তাই কোনো দিন বাস পাওয়া যায় পৌনে আটটায়, কোনো দিন সোয়া আটটায়। আর কানের বাসস্টেশন থেকে থিয়েত খোয়াসেতে যেতে সময় লাগে পাক্কা তেরো থেকে পনেরো মিনিট। তা-ও ঘাম ঝরানো হাঁটা দিলে। সেই সময় ভিড় ঠেলে যেতে হলে খবরই ছিল। 

উৎসবের সপ্তম দিন সকাল সকাল একটি সুপার ন্যাচারাল, ফ্যান্টাসি মুভি দেখলাম, ছবিটির ফরাসি নাম ‘লে সাঙ্ক ডিয়াবেল’ বা ‘দ্য ফাইভ ডেভিলস’। ডিরেক্টর্স ফোর্টনাইটেই-এর প্রথম প্রদর্শনী হলো। ছবিতে জোয়ান চরিত্রে অভিনয় করেছেন ‘ব্লু ইজ দ্য ওয়ার্মেস্ট কালারে’র অন্যতম অভিনেত্রী অ্যাডেল এক্সারকোপুলস। আর তার মেয়ে ভিকি চরিত্রে স্যালি ড্রামে। লেয়া মাইসিয়ুসের দ্বিতীয় এই কাহিনিচিত্রে ভিকি মেয়েটি বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন। সে গন্ধ শুঁকে বলে দিতে পারে কোন জিনিস কত দূরে আছে। এমনকি ব্যক্তির ব্যবহৃত জিনিস থেকে নির্যাস নিয়ে, অন্য কিছু মিশিয়ে নিজের মতো করে গন্ধ প্রস্তুত করে ওই ব্যক্তির অতীতও জানতে পারে সে। ভিকির পিসি জুলিয়ার সঙ্গে তার মা জোয়ানের সম্পর্ক ছিল। অর্থাৎ জোয়ান বাইসেক্সুয়াল। এই সম্পর্ক ধীরে ধীরে অতীত খুঁড়ে আবিষ্কার করে ভিকি। সে তখন ভাবতে শুরু করে, জুলিয়ার কারণে মা তাকে দূরে সরিয়ে দেবে। অস্তিত্ব সংকটে পড়ে যায় ভিকি। ছবির গল্প বলার ধরনটি চমৎকার লেগেছে, তবে হালকা প্লট। পরিচালক একটি অতিপ্রাকৃত গল্প বলতে চেয়েছেন, এর বেশি কিছু নয়। ছবি শেষে দর্শক বেশ হাততালি দিয়েছে। এই হাততালির বড় কারণ আসলে অভিনেত্রী অ্যাডেল।

No description available.
দ্য ফাইভ ডেভিলস ছবির অভিনয়শিল্পী ও পরিচালক

উৎসবে ছবি যেমন দেখছি, দর্শকও দেখছি। কানের দর্শক সত্যিই বোদ্ধা দর্শক। তাদের তারিফ বোঝা যায় তালির স্থায়িত্ব দিয়ে। সকালে মাইসিয়ুসের ছবি দেখে লোকে যেমন হাততালি দিয়েছে, তেমনি পরের যে ছবিটি দেখেছি, ক্রিটিকস উইক সেকশনে, ‘তাসাভর’ বা ‘ইমাজিন’, সেটা দেখার পর দর্শক না পারতে দু-চারটে হাততালি দিয়ে বেরিয়ে গেছেন। ইরানি পরিচালক আলি বেহরাদ ছবিটি বানিয়েছেন এক ট্যাক্সিচালক ও এক নারীকে নিয়ে। নারীটি ট্যাক্সিচালকের চেয়ে বয়সে বড়, তাই তাকে প্রেম নিবেদন করতে পারে না। নারীটি তার যাত্রী। কল্পনার ডালপালা মেলতেই থাকে চালকের মনে। কিন্তু সেটি পরিণতি পায় না। ছবির অধিকাংশ সময়েই দেখা যায় রাতের তেহরানে নারীটিকে নিয়ে গন্তব্যের দিকে যাচ্ছে ট্যাক্সি। শেষ পর্যন্ত তাকে বিমানবন্দরে পৌঁছে দিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে চালক। আসলে এই ছবিটির না আছে চিত্রনাট্যের ঠাস বুনোট, না আছে গল্পের ধার। তার ওপর এই ধরনের ট্যাক্সিনির্ভর ছবি তারই দেশের মাস্টার ফিল্মমেকার জাফর পানাহি বানিয়ে ফেলেছেন। সেটার নাম ছিল ‘ট্যাক্সি’ (২০১৫)। পরিচালক ছবি শুরুর আগে কথা বলেছেন, এরপর দর্শকদের সঙ্গে বসেই ছবি দেখেছেন। কিন্তু সমাপ্তি টানার সঙ্গে সঙ্গেই দর্শক প্রেক্ষাগৃহ ছেড়ে যেতে থাকে। পরিচালককে তখন বেশ অসহায় দেখাচ্ছিল। অন্য সব ছবির বেলায় কিন্তু এমনটা হয় না। ভালো ছবি হলে দর্শক দাঁড়িয়ে হাততালি দিয়ে প্রেক্ষাগৃহ কাঁপিয়ে দেয়। কানে ‘ইমাজিন’ দিয়ে মন মাতানোর কল্পনা আর সত্যি হলো না এই পরিচালকের।

থিয়েত খোয়াসেতে নির্বাক হোম ভিডিও নিয়ে নির্মিত প্রামাণ্যচিত্র দেখলাম। ফরাসি দেশের প্রখ্যাত লেখিকা অ্যানি এখন্যুর এই ‘লেস্যানি সুপ্যাখ হুইত’ বা ‘দ্য সুপার এইট ইয়ার্স’ ছবিতে ১৯৭২ থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত হ্যান্ডিক্যামে ধারণকৃত পারিবারিক ও বিভিন্ন জায়গায় পর্যটনের ভিডিও রয়েছে। নির্মাণে তার সহযোগী ছিলেন ডেভিড এখন্যু-ব্রিয়ত। অ্যানি ও তার পরিবারের সদস্যরা সেসব ধারণ করেছেন। মূলত অ্যানির স্বামী ফিলিপ। আট মিলিমিটার ক্যামেরায় ধারণ করা এই প্রামাণ্যচিত্রে উঠে এসেছে তৎকালীন জীবনযাপন, সমাজ, ইতিহাস ও রাজনীতি। ছবিটি ব্যক্তিগত জার্নালের মতো, ভিডিও জার্নাল বলা যেতে পারে।

ছবিটি এক ঘণ্টার। শেষ করেই ছুটলাম প্যালে দে ফেস্তিভালের ভেতরে রৌদ্রস্নাত ক্যাফেতে। এই ক্যাফেটি আমার অতি পছন্দের। এর কারণ খাবার নয়, পরিবেশ। মন ভালো হয়ে যায় দেখলে। ওপরে কাচের ছাদ। রোদ এসে পড়ে পুরো মেঝেতে। খুব সুন্দর। এখানে বসে লিখতেই আমার বেশি ভালো লাগে। এক ঘণ্টার ভেতর কানান্তরের সপ্তম কিস্তি লিখে আপ করে দিলাম। হাতে আছে বারো মিনিট। আবার দে ছুট থিয়েত খোয়াসেতের দিকে। ওখানে পৌঁছুতে ও রকম সময়ই লাগে। যে পরিমাণ হাঁটছি রোজ, তাতে ওজন কমে যাওয়ার কথা। অবশ্য ফরাসি দ্রাক্ষারস আর চিজ বোধ হয় সেটি হতে দেবে না।

ঘেমেটেমে হলের ভেতর ঢুকলাম ভেরেনা প্যারাভেল ও লুসিয়েন কাস্টেইং-টেইলর পরিচালিত আরেকটি প্রামাণ্যচিত্র ‘দো হিউমানি কোরপোরাস ফেব্রিকা’ দেখার জন্য। মানুষের শরীরের ভেতরের জগৎ দেখানোই এই ছবির উদ্দেশ্য। পাঁচশ বছর আগে অ্যানাটমিস্ট অদ্রেঁ ভেসাল প্রথমবারের মতো মানুষের শরীর উন্মোচন করেছিলেন বিজ্ঞানের জন্য। আর এই ছবিটি মানুষের শরীরকে, ভেতর থেকে দেখিয়েছে সিনেমার জন্য। রক্ত-মাংসের মানুষের ভেতর অস্তিত্বের বিস্তৃত দিগন্ত উন্মোচনের চেষ্টা স্পষ্ট। অনেকটা বিমূর্ত ও কল্পজগতের মতো মনে হয় মানুষের দেহের ভেতরে থাকা নানাবিধ ক্ষুদ্রাতি ক্ষুদ্র কোষ ও কণা। ভিন্ন ধরনের ছবি। তবে সব দর্শক পুরো ছবিটি না-ও দেখতে পারে। প্রতিযোগিতার বাইরে থাকায় এবং ছবিটি আমার দেখার উপযোগী না হওয়ায়, অন্য অনেকের মতোই আমিও পনেরো মিনিট পর হল থেকে বেরিয়ে আসি। দেখছিলাম, ও রকম অস্ত্রোপচারের দৃশ্য দেখে অনেকেরই অস্বস্তি হচ্ছিল। এক লোকের মস্তিষ্কে ফুটো করে ক্যামেরা ও ছুরি-কাঁচি ঢুকিয়ে অপারশেনের দৃশ্য আসলে দুর্বলচিত্তের মানুষের পক্ষে দেখা কঠিনই বটে। আমার চিত্ত যথেষ্ট দুর্বল। সবল করার জন্য বাইরে বেরিয়ে কোন আইসক্রিম কিনি এবং সেটা খেতে খেতে পা বাড়াই রেলস্টেশনের দিকে।

Link copied!