• ঢাকা
  • শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

‘সলিল চৌধুরীর ফেলে আসা গানে’


আরাফাত শান্ত
প্রকাশিত: নভেম্বর ১৯, ২০২২, ০৭:১০ পিএম
‘সলিল চৌধুরীর ফেলে আসা গানে’
সলিল চৌধুরী

সলিল চৌধুরীর জীবন নিয়ে ভাবতে গেলে তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনীর দিকে চোখ ফেরাতে হয়। দ্রুত মারা না গেলে আমরা দারুণ একটা আত্মজীবনী পেতাম।  তাঁর বাবা এক বিদেশি সাহেবকে মেরে দু-তিনটে দাঁত ফেলে দিয়েছেন। এক প্রত্যন্ত জঙ্গল ও চা বাগান ঘেরা অঞ্চলে ছিল সেই ডাক্তারের পোস্টিং। একজন বিদেশি সাহেব তাকে গালি দিলেন অযথাই, উনি রাগে মুখে একটা ঘুষি মেরেই নক আউট। আবার যখন স্বদেশি আন্দোলন তুঙ্গে, বিলাতি কাপড় পোড়াচ্ছে সবাই। তাঁর বাবা টাকা দিয়ে কিনে অনেকগুলো কাপড় পুড়িয়েছেন। এই অভাবের দেশে সলিল চৌধুরীর বাবার যে সাহস ছিল, তা অবিশ্বাস্য। এই সাহসের কিছুটা তো সলিল চৌধুরীও পেয়েছেন। তাই তিনি আইপিটিএ করেছেন, কৃষকদের নিয়ে কাজ করেছেন, মুক্তিকামী গান লিখেছেন। বাবার হুট করে মৃত্যু, সংসার চালানোর জন্য তাঁর আইপিটিএ ছাড়তে হয়েছে। হঠকারী সিদ্ধান্ত দেখে দেখে মনে মনে বিরক্ত ছিলেন। দেশের স্বাধীনতাকে তিনি স্বাধীনতা ভাবতেন না, ইরফান নামের এক শ্রমজীবী মানুষের থেবড়ানো লাশ দেখে হিন্দু-মুসলিম সব ধর্মের ওপর বিশ্বাস হারান। সেখানে তাঁর যে হাহাকার, সেটার সঙ্গে মিল পাই মীজানুর রহমানের লেখা বই, ‘কৃষ্ণ ষোলোই’-এর।

সলিল চৌধুরীর রচনাসমগ্রের ভূমিকা লেখা লতা মঙ্গেশকারের। এতেই বোঝা যায় তিনি এদের জীবনে কী ছিলেন। অথচ তিনি বম্বে (মুম্বাই) গিয়েছিলেন রীতিমতো খালি হাতে। অন্য বুদ্ধিজীবীদের মতো কলকাতা নিয়ে এত আদিখ্যেতা ছিল না তার। আসামে বড় হয়েছেন, কখনো মামা, কখনো জ্যাঠার বাড়ি ছিলেন। দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার এক স্কুল থেকে পাশ করেছেন। পড়েছেন বঙ্গবাসী কলেজে। প্রেসিডেন্সি থেকে বাংলায় এমএ ভর্তি হয়ে আর ক্লাস করেননি। আইপিটিএর জন্য কাজ করা, গান লেখা, বিভিন্ন জায়গায় যাওয়া, এসবই ছিল তাঁর কাজ। তাঁর অনেক গণসংগীত দেবব্রত বিশ্বাস ও সমবেত শিল্পীরা গাইতেন। খুব দ্রুত তিনি গান লিখতেন ও সুরও করতেন। ‘আয় বৃষ্টি ঝেঁপে’ সুর করলেও গাওয়াতে পারেননি, কারণ এটা নাকি সামন্তবাদী গান। সলিল চৌধুরী প্রশ্ন, ‘আল্লা মেঘ দেও’-ও একটা নিয়তিবাদী গান। এটা কেন গাওয়ান? এসব তুচ্ছ তুচ্ছ বিষয় নিয়েই দূরত্বের শুরু।

সলিল চৌধুরী স্কুলে পড়া অবস্থাতেই একটা অর্কেস্ট্রা দলে ঢোকেন। সেটা ছিল তাঁর এক দাদার। তিনি সব বাজাতে শেখার চেষ্টা করেন, আর্কেডিয়ান থেকে বেহালা হয়ে এসরাজ। তাঁর সেই দাদা পরে পাগল হয়ে মারা যান। তিনি শিখিয়েছিলেন, বিভিন্ন যন্ত্রের বিভিন্ন রকম গুরুত্ব। এই মেজাজটা ও গুরুত্বটা বুঝতে হবে। আঙ্গুল ছিল তাঁর ছোট ছোট, পিয়ানো বাজাতে গিয়ে অদ্ভুত এক কায়দা করতেন। তাঁর এই যুতসই কায়দার জন্য সুর হয়েছে আরেক রকম। যাত্রার দলে বাঁশী বাজিয়েছেন, সার্কাসে বাজিয়েছেন, কত নারী তাঁর বাঁশি শুনেই পাগল হতেন। কৈশোর ও যৌবনের শুরুর সময় তিনি নারীসঙ্গকে ভয় পেতেন। ছোটবেলায় আসাম, কুচবিহারে থাকার কারণে তাঁর হিন্দি ছিল ভালো। দো বিগা জমিনের একটা রাফ স্ক্রিপ্ট নিয়ে যান। ভরসা একটাই বিমল রায় তাঁকে চেনেন। মোটামুটি থাকা খাওয়া হলেই হলো। তিনি যে এই ছবির মিউজিক ও স্টোরি লিখে রাতারাতি আইকনে পরিণত হবেন, তা মাথাতেই আসেনি। তিনি ৩০-৪০টা হিন্দির ছবির মিউজিক করেছেন, মালায়লাম ছবিও করেছেন অনেক, ৪০টা বাংলা ছবিতে কাজ করেছেন, হাতে গোনা তামিল তেলেগু আসামি ভাষার ছবিতেও আছে তাঁর কাজ। কিছু বিখ্যাত সিনেমায় তাঁর আছে শুধু ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক।

সলিল চৌধুরী হলো বিরলপ্রজ প্রতিভা, যারা এক সঙ্গে কথা, সুর ও সঙ্গীত সব ভালো বুঝতেন। সব ধরনের রাগ যেমন জানতেন, তেমন জানতেন ওয়েস্টার্ন ক্লাসিক্যাল। বিখ্যাত হওয়ার পরে অনেকে তাঁকে অপছন্দ করতেন। কারণ তিনি সিনেমার গান করতেন বম্বেতে। কিন্তু তিনি যদি না থাকতেন, তবে বিটোভেনের সুর দিয়ে কেউ গাইতো না—ইতনা না মুঝছে তু পিয়ার বারা। তিনি এই মিশ্রণটা খুব ভালো পারতেন। তাই তো আনন্দ ছবিতে সুরটা করতে পেরেছেন-জিন্দেগি ক্যায়সি হ্যায় পেহলি কিংবা ছোটি সি বাতে, না জানে কিউ।

বাংলা গানে তো তিনি শ্রেষ্ঠদের তালিকায় থাকবেন। হেমন্তের কত বিখ্যাত গান তাঁর করা। কবি সুকান্তকে তিনি খুব ভালোবাসতেন। তাই নিজের প্রথম সন্তানের নাম রেখেছেন সুকান্ত। রানার গানটাকে তিনি কিভাবে বাঙালি শ্রমজীবী মানুষের একটা গান বানিয়েছেন। ‘পথ হারাবো বলেই এবার পথে নেমেছি’ হোক কিংবা শ্যামল মিত্রকে দিয়ে ‘যদি কিছু আমারে সুধাও’—কী সব গান। সলিল চৌধুরী বাচ্চাদের গানে যা করেছেন, অন্যদেশে হলে তিনি হতেন স্কুলে পাঠ্য।

সলিল চৌধুরী বাংলাদেশের সিনেমাতেও হয়তো কাজ করতেন। একাত্তরের যীশু ছবির মিউজিক তাঁর করার কথা ছিল। আগেই চলে গেলেন। হিন্দি ছবির গানে একজন বাঙালি হয়ে যেসব চেঞ্জ এনেছেন, সেটার সুফল পেয়েছে সবাই। সলিল দা বলে তিনি সবখানেই শ্রদ্ধার পাত্র। শংকর জয়কিষান হোক আর মদনমোহন হোক, সবাই তাঁকে সম্মান করতেন। জন্মবার্ষিকীতে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।

Link copied!