• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল, ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ শাওয়াল ১৪৪৫

রামদাসের স্বাধীনতা


মানিক মোহাম্মদ রাজ্জাক
প্রকাশিত: ডিসেম্বর ১৪, ২০২৩, ০৩:৫৮ পিএম
রামদাসের স্বাধীনতা

মার্চ জুড়েই হরতাল, অবরোধ ও ধর্মঘট। চারদিকে থমথমে অবস্থা। তারপরও লোকজনের চলাচলের কথা বিবেচনা করে রেল চলাচল চালু রাখা হয়েছে। এই অসহযোগ আন্দোলনে যাত্রী চলাচল অনেকটা হ্রাস পেলেও সেকেন্ড ফায়ারম্যান রামদাসের ব্যস্ততা কমেনি। ডিউটি রোস্টার অনুযায়ী কয়লার ইঞ্জিন এবং মাঝে মাঝে ডিজেল ইঞ্জিন দিয়ে ট্রেন নিয়ে তাকে কুড়িগ্রাম, পার্বতীপুর, শান্তাহার, পাটগ্রাম ও মোগলহাটে চলাচল করতে হচ্ছে। ট্রেন চালাতে চালাতে বিভিন্ন এলাকায় তার নজরে পড়ে মিছিল-সমাবেশ। রামদাস কৌতূহলী চোখে সেদিকে তাকিয়ে থাকে। কোনো কোনো স্টেশনে প্রবেশকালে রেলগেটে সমাবেশ দেখে ইঞ্জিনের ঝুলন্ত তার টেনে একটানা হুইসেল বাজানোর পরও লোকজন না সরায় বিহারি চালক খিস্তি খেউর শুরু করলে, রামদাস কিছুটা ভীতিমিশ্রিত স্বরে মিনমিন করে বলে, ‘ওরা না সরলে আমি কী করব উস্তাদ।’ এ ধরনের কথা শুনলেই চালকের চাঁদি গরম হয়ে যায়। বাঙালিদের জাত তুলে গালাগাল শুরু করে দেয়। গজর গজর করে বলতে থাকে, ‘বাঙালি মাদারচোদ লোগোনে ইয়ে ওয়াতানকো জাহান্নামমে ডাল দেগা।’

মার্চের তৃতীয় সপ্তাহজুড়ে চলতে থাকে এ ধরনের খিস্তি খেউর। যেদিন কোনো বাঙালি চালক দেওয়া হয়, সেদিন রামদাস স্বস্তিতে কাজ করতে পারে। কিন্তু সেই সৌভাগ্য তার খুব বেশি হয় না। বেশিরভাগ ইঞ্জিন চালকই বিহারি। যে কারণে রামদাসকে এসব গালাগাল হজম করেই ডিউটি করতে হয়। বেলচা ভরে বয়লারে কয়লা মারতে হয়। মার্চের ২৫ তারিখ রাতে ২২১ আপ ট্রেন নিয়ে পাটগ্রামে যায় রামদাস। শিডিউল মোতাবেক পরদিন সকাল ১০টায় ট্রেন নিয়ে ফিরে আসার কথা। রাতটা রানিং রুমে কাটিয়ে সকালে স্টেশনে গিয়ে দেখে এলাকার হাজার হাজার মানুষ ট্রেনটিকে ঘিরে রেখেছে। এদিনকার চালক ছিল একজন বাঙালি। দুজন মিলে স্টেশন মাস্টারের রুমে গিয়ে দেখে, সেখানে এলাকার এমপি আবেদ আলী বসে আছেন। কথা বলছেন স্টেশন মাস্টারের সাথে। স্টেশনজুড়ে হাজার হাজার লোক থেকে থেকে ধ্বনি তুলছে, বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর। আলাপকালে জানা যায়, ট্রেনটিকে ফিরতে দেওয়া হবে না। আটকে রাখা হবে। এ এলাকার রেললাইনও উপড়ে ফেলা হবে। হঠাৎ করে পরিস্থিতি এত উত্তপ্ত হয়ে পড়ল কেন, তা নিয়ে রামদাস বেশ ধন্ধে পড়ে যায়। লোকজনের সাথে আলাপ করে জানতে পারে, গত রাতে পাকিস্তানিরা ঢাকায় গণহত্যা শুরু করেছে। ইয়াহিয়া খানের সাথে শেখ সাহেবের আলোচনা ভেঙে গেছে। ইয়াহিয়া খান পাকিস্তান চলে গেছে। শেখ সাহেবকে মেরে ফেলেছে না গ্রেপ্তার করেছে—তা নিয়েও স্টেশনের লোকজনের মধ্যে চলছে এন্তার কানাঘুঁষা। ট্রেন না চললে ফিরবে কীভাবে, জানতে চাইলে এমপি সাহেব সাফ জানিয়ে দেন, পায়ে হেঁটে চলে যান। ট্রেন ছাড়া যাবে না। মহাবিপদ। সড়ক পথও নাই যে কোনো বাহনে যাওয়া যাবে। এতদূর পথ প্রায় ৩০ মাইল। বললেই তো হুট করে হেঁটে যাওয়া যাবে না। অগত্যা যদি অনুমতি মেলে, সেই আশায় দুপুর পর্যন্ত অপেক্ষা করে বুঝতে পারে কোনো আশা নাই। অতঃপর মনস্থ হয়, দুপুরে রানিং রুমে খাওয়া দাওয়ার পর রেললাইন ধরে লালমনিরহাটের দিকে হাঁটা দেবে। খেতে খেতে বাঙালি চালক খবিরের সাথে অনেক কথাই হয়। খবির খুব উদ্বেগের সাথে বলে, শেখ সাহেবকে মেরে ফেললে দেশে রক্তের বন্যা বয়ে যাবে। পাকিস্তান ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে।

রামদাস কোনোকালেই রাজনীতি বা কোনো ট্রেড ইউনিয়নের সাথে সম্পৃক্ত ছিল না। বাসা আর অফিস ছাড়া তার কোনো জগত নেই। যে কারণে এসব বিষয় নিয়ে তার কোনো কথাও বলার থাকে না। শুধু মুখে ভাত তুলতে তুলতে একবার আপন মনে বলে, ‘শেখ সাহেব-ক মারি ফেলার হিম্মত পাকিস্তানিদের কখনো হবার লয়, এমন হইলে ইয়াহিয়া খানের গদি উল্টি যাইবে।’ স্বভাবগতভাবে রামদাস কম কথা বলে। কেউ কোনো প্রশ্ন করলে উত্তর দেয় নচেৎ নীরবতা। এরপর ট্রেনটি স্টেশন মাস্টারের হাওলায় রেখে রেললাইন ধরে দুজন হাঁটতে থাকে। কাকিনা পর্যন্ত আসতেই সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে। পথে পথে রেললাইন সংলগ্ন বাজার, রেলস্টেশন, রাস্তার মোড়—সর্বত্রই জটলা। সবার মধ্যে অজানা শঙ্কা-উৎকণ্ঠা। কাকিনা স্টেশনের পেছনের একটি চায়ের দোকানে চা খেতে গিয়ে দেখে শ-খানেক লোক দোকানের চারদিকে জটলা করে আছে, কেউ দাঁড়িয়ে, কেউবা বসে। সকলের মুখে উৎকণ্ঠার ছাপ। সবাই বিবিসির খবর শোনার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। খবিরের ইচ্ছে খবরটা শুনে যাবার। রামদাসের ইচ্ছা বাড়ির পথে হাঁটা। তারপরও কী মনে করে দুই কাপ চা আর দুইটা গুলগুল্লা দিতে বলে একটা বেঞ্চের খানিকটা ফাঁকা জায়গায় দু-জনে বসে পড়ে। এরই মধ্যে আকাশবাণী কলকাতার খবর শুরু হলে তারা জানতে পারে, পাকিস্তানিরা বাঙালিদের হত্যা করতে শুরু করেছে। ঢাকায় কারফিউ জারি করা হয়েছে। শেখ সাহেব দেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। দেশে স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। এতটুকু সংবাদ শুনতে শুনতে চা খাওয়া হয়ে গেলে তারা আবার রেললাইন ধরে আগাতে থাকে। এরই মধ্যে রামদাস ঝোলা থেকে তার টর্চলাইটটাও বের করে। আলো ফেলতে ফেলতে তারা হাঁটতে থাকে। খবির ট্রেড ইউনিয়ন করে। মস্কোপন্থী কমিউনিস্ট পার্টির সাথে গোপন যোগসূত্র আছে তার। সে কারণে বিশ্ব রাজনীতির অনেক কিছু সম্পর্কে সে জানে। মাঝে মাঝে পার্টির কার্যালয়ে মিটিংকালে ভিয়েতনামের যুদ্ধ নিয়েও আলোচনা হয়। সে সুবাদে সে জানে, ১৯৪৫ সালের ২ সেপ্টেম্বর স্বাধীনতা ঘোষণা সত্ত্বেও দেশটির স্বাধীনতা মেলেনি। ২৬ বছর ধরে তারা যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। জাপান, ফ্রান্সের পর এখন তারা আমেরিকার বিরুদ্ধে লড়াই করছে। এ কথা মনে হতেই খবির অনেকটা বিচলিত হয়ে পড়ে। বেশ উৎকণ্ঠা নিয়ে বলে, ‘দাদা অবস্থা কিন্তু সুবিধার মনে হচ্ছে না। এই যে শেখ সাহেব স্বাধীনতা ঘোষণা করল, যুদ্ধ শুরু হলো, এ যুদ্ধ কিন্তু সহজে থামবে না, স্বাধীনতা পাওয়া অত সহজ না, ভিয়েতনামিরা ২৬ বছর ধরে যুদ্ধ করতেছে। কিন্তু এখনো কোনো কূল কিনারা করতে পারতেছে না। আমাদের যে কত বছর যুদ্ধ করতে হবে, তার কিন্তু কোনো ঠিক ঠিকানা নাই, ভিয়েতনামিদের চেয়ে বেশি সময়ও লাগতে পারে।’

এ কথা শোনার পর রামদাসের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে। এ সময় বারবার তার মেয়েটার কথা মনে পড়ে। দিপালি, তার একমাত্র মেয়ে। এবারই ১৪-তে পড়ল, এখনো তার কোনো গতি করতে না পারায় রামদাসের মনে দেখা দেয় এন্তার অপরাধবোধ। এরমধ্যে যুদ্ধ ভয়াবহ আকার ধারণ করলে মেয়েটির কী গতি হবে, তা নিয়ে সে অনেকটা বিষণ্ণ হয়ে পড়ে। মেয়েটির আদরমাখা মুখটি বারবার চোখে ভাসতে থাকে। এক পর্যায়ে অনুতাপে তার চোখ ভিজে ওঠে। কথার পিঠে কথা চলতে থাকে। খবির বলতে থাকে, ‘সত্যি সত্যি যুদ্ধ শুরু হলে আমেরিকা পাকিস্তানের পক্ষে দাঁড়াবে। তখন আমাদের টিকে থাকা মুশকিল হয়ে যাবে। ভিয়েতনামের মতো হাজার হাজার বোমা মেরে পুরো দেশকে শ্মশান করে দিবে।’ রামদাসের এসব কথায় কোনো মনোযোগ নাই। তার মাথার মধ্যে একটাই চিন্তা, মেয়েটার কোনো গতি করা গেলে সে মরেও শান্তি পেত। হাঁটতে হাঁটতে শহরের উপকণ্ঠে পৌঁছাবার পর রাত প্রায় একটা বেজে যায়। দোলজোর রেলব্রিজ পার হবার পর তারা ডাইনের কাঁচা রাস্তা ধরে শহরের দিকে হাঁটতে থাকে। একটানা হাঁটার পর কোয়ার্টারে যখন পৌঁছে, তখন রাত দুইটা। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ডাক দেওয়ার সাথে সাথে দিপালি হারিকেন নিয়ে দৌড়ে এসে দরজা খুলে দেয়। হারিকেনের আবছা আলোয় মেয়ের মায়াবী মুখটা দেখে হুহু করে কাঁদতে ইচ্ছে করে রামদাসের। কিন্তু কাঁদতে পারে না। অনেক কষ্টে নিজেকে সংবরণ করে আস্তে করে জিজ্ঞেস করে, ‘ক্যারে মাও কেমন আছু?’ উত্তরে দিপালি বলে, ‘হামরা ভাল আছি বাবা, কিন্তুক তোমার এত দেরি হইল ক্যা?’ এ কথার কোনো উত্তর না দিয়ে ঘটিতে জল দিতে বলে রামদাস জামা-কাপড় বদলাবার জন্য ঘরে ঢোকে। লুঙ্গি পরে কলতলায় হাতমুখ ধুয়ে খেতে বসে। পাশে বসে থাকে স্ত্রী গঙ্গারানি আর কন্যা দিপালি। হেঁটে আসার বিস্তারিত জানাবার পর বলেন, ‘দ্যাশে নাকি যুদ্ধ নাগছে।’ কার সাথে কার যুদ্ধ জিজ্ঞেস করলে রামদাস বলে, ‘শেখ সাহেবের সাথে ইয়াহিয়া খানের যুদ্ধ, মানে বাঙালি আর পাঞ্জাবিদের যুদ্ধ। কী যে হয় ভগবান কবার পারে।’ খাওয়া শেষে দুর্গা দুর্গা বলতে বলতে ক্লান্ত শরীরটা এলিয়ে দেয়ার জন্য রামদাস ঘরের দিকে চলে যায়।

এঁটো থালাবাসন কলতলায় মাজতে মাজতে দিপালি যুদ্ধ নিয়ে ভাবতে থাকে। যুদ্ধ যে কী, সে বিষয়ে খুব বেশি জানে না দিপালি। শুধু ছোট বেলায় একবার যুদ্ধ দেখেছিল সে, ইন্ডিয়া পাকিস্তান যুদ্ধ। সেসময় ইন্ডিয়ার কয়েকটা ফাইটার বিমান শহরের ওপর চক্কর দিয়েছিল, রেল স্টেশনে বোমাও ফেলেছিল, তারপর তো আর যুদ্ধ হয় নাই। ক্ষণকালের সেই যুদ্ধের সামান্য ক্ষয়-ক্ষতি দিপালির মনে কোনো রেখাপাত করে নাই। তার কাছে যুদ্ধ মানেই কয়েকটা বোমা ফেলা, এর বেশি কিছু না। ফলে এ নিয়ে তার তেমন চিন্তা হয়নি।

শরীর একেবারে ভেঙে পড়েছে রামদাসের। একটানা ১২-১৩ ঘণ্টা হাঁটার ফলে পা দুটা কেমন যেন ফুলে ওঠে। গঙ্গারানি পায়ে তেল ডলে দিতে চাইলেও রামদাস রাজি হয়নি। ঘুমানোর চেষ্টা করলেও ঘুম ধরা দেয় না। এন্তার দুশ্চিন্তা রামদাসের মাথা এলোমেলো করে দিতে থাকে। শত শত ‘স্বাধীনতা’ শব্দবোমা যেন মাথায় আছড়ে পড়তে থাকে। মনে পড়ে ছোটবেলার কথা। ২৪ বছর আগের কথা। রামদাস তখন ক্লাস নাইনে পড়ত। হঠাৎ একদিন শোনে পকিস্তান স্বাধীন হয়ে গেছে। এই পাকিস্তান মুসলমানদের পাকিস্তান। হিন্দুদের হিন্দুস্তানে চলে যেতে হবে। সে দিনের কথাগুলো বেশ মনে পড়ে। সকাল দশটার দিকে কয়েক শ লোক বিরাট এক মিছিল নিয়ে নারায়ে তাকবির আল্লাহু আকবর ধ্বনি দিতে দিতে স্কুলে হাজির হয়ে ব্রিটিশ পতাকা নামিয়ে পাকিস্তানি পতাকা উড়িয়ে দেয়। মিছিলকারীদের একজন বেশ উচ্ছ্বসিত হয়ে ব্রিটিশদের ইউনিয়ন জ্যাক পাতাকাটি পুড়িয়ে দেয়। সেদিন আর স্কুল হয়নি; হিন্দু হেডমাস্টার নিবারণ স্যার স্কুল ছুটি দিয়ে দেন।

বাড়ি ফিরে রামদাস দেখে বাবা-মাসহ সকলে মুখ বেজার করে দাওয়ায় বসে আছে। রামদাসের বাবা হরিচরণ দাস বীরগঞ্জ বাজারে একটা হাড়ি পাতিলের দোকান চালাত। সকালে দোকান খোলার পর চারদিকে কানাঘুঁষা শুনে সে অনেকটা বিচলিত হয়ে পড়ে। পাশের দোকানদার আজম আলী আলাপকালে বলছিল, ‘শুনলাম হেন্দুগুলাক এলা দ্যাশ ছাড়িয়া এন্ডিয়াত যাওয়া নাগবে। এটে খালি মুসলমান থাকবে। এটা হইবে মুসলমানের দ্যাশ। তোমরার দ্যাশ এন্ডিয়া।’ এসব কথার একফাঁকে আজম আলী বলেন, ‘এন্ডিয়া যাবার আগ দিয়া দোকানখান বেচি গেইলে মোর কাছত বেচিস হারি দা, ভাল দাম পাবু। তোক মুই ঠকাইম না।’ এসব কথা শোনার পর মনটা ভীষণ বিষণ্ণ হয়ে ওঠে হরিচরণের। এক পর্যায়ে দোকানের ঝাপ ফেলে বাড়িতে চলে আসে। হরিচরণের সম্পদ বলতে তেমন কিছু নাই। ১০ শতক জমির ওপর ছোট দুইখান বসত বাড়ি আর বাজারের দোকানটিই তার সম্বল। ওই আয় দিয়েই টেনেটুনে সংসার চালায়। বাড়িতে ফিরে আম গাছটার ছায়ায় মাচায় বসে হুক্কায় কালো ধোঁয়া ওড়াতে ওড়াতে হুহু করে কাঁদতে থাকে হরিচরণ। স্ত্রী নমিতা রানি তখন পিতলের ঘটিতে করে আঙ্গিনার মাঝ বরাবর তুলসি গাছে পানি ঢালছিল। তা দেখে চোখ দুটা গামছা দিয়ে মুছে করুণ কণ্ঠে হরিচরণ বলে, ‘আর জল ঢালিয়া কী হইবে রামদাসের মাও, হামার বুঝি মাটির মায়া ছাড়া নাগবে। এই দ্যাশ থাকিয়া ভগবান আমার অন্ন তুলি নিছে।’ স্বামীর কথা শুনে অবাক হয়ে তার দিকে ফিরে তাকায় নমিতা রানি। ঘটনার ইতিবৃত্ত শুনে অনেকটা ক্ষোভের সাথে বলে, ‘কইলেই হইলো, হামার সাতপুরুষের ভিটা থুইয়া হামরা কোনোঠে যাবার নই। য্যাটে জম্ম সেটেই হামার মিত্তু হইবে।’

বিকেলের দিকে মুসলিম লীগ নেতা জব্বার প্রামাণিক এলাকার লোকদের নিয়ে বিজয় মিছিল করে যাবার সময় হঠাৎ বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে জোর গলায় হাঁক দেয়, হরিচরণ বাড়িত আছিস? ডাক শুনে হরিচরণ বাইরে বেরিয়ে মুখোমুখি দাঁড়াতেই প্রামাণিক প্রশ্ন ছুড়ে দেয়, ‘কী স্থির করলু?’ অবাক হয়ে হরিচরণ যখন এ প্রশ্নের মাজেমা জানতে চায়, তখন প্রামাণিক ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি মেখে বলে, ‘বুঝলু না, এটে থাকপু না এন্ডিয়াত চলি যাবু?’ একরাশ বিস্ময় নিয়ে হরিচরণ বল, ‘দেওয়ানির ব্যাটা হামরা কোনোটে যাবার নই। এটে বাপ দাদার ভিটাত মাটি কামড়ে পড়ি থাকিম। য্যাটে জম্ম-স্যাটেই মিত্তু। বাকিটা ভগবানের হাতত।’ হরিচরণের এ ধরনের উত্তরের জন্য প্রামাণিক মোটেও প্রস্তুত ছিল না। ভেতরে ভেতরে ক্ষুব্ধ হলেও রাগ চেপে কৃত্রিম একটা হাসি দিয়ে বলে, ‘তোর মর্জি, যা ভাল বুজিস তাই কর। দেখ কোটেকার পানি কোটে যায়া ঠেকে।’ এরপর আর সেখানে দাঁড়ায়নি প্রামাণিক। পাকিস্তান জিন্দাবাদ বলতে বলতে বাজারের দিকে যেতে থাকে মিছিল নিয়ে। থানা সদর থেকে বড় নেতা এসেছে, বাজারের মাঠে জনসভা হবে। বিজয় উৎসবের জনসভা। যতক্ষণ চোখের আড়াল না হয় ততক্ষণ মিছিলের দিকে একরাশ প্রশ্ন নিয়ে তাকিয়ে থাকে হরিচরণ। এরপর স্ত্রীকে হুক্কা সাজিয়ে দিতে বলে প্রশ্নের উত্তর মেলাতে থাকে হরিচরণ। পাকিস্তান স্বাধীন হইছে ভাল কথা, তাই বলে বাপ দাদার ভিটামাটি ছেড়ে চলে যেতে হবে কেন? সেই হিসাব সে কিছুতেই মেলাতে পারে না।

পরদিন সকালে জলখাবার খেয়ে বাজারে গিয়ে হরিচরণ দেখে, তার দোকানের ঝাপ ভাঙা। ভেতরে কোনো মালপত্র নেই। কারা যেন তালা ভেঙে সবকিছু লুট করে নিয়ে গেছে। হঠাৎ রায় চরণের কান্নার শব্দ শুনে এগিয়ে গিয়ে দেখে, তার কাঁসা-পিতলের দোকানের সবকিছু লোপাট হয়ে গেছে। অবস্থা দেখে মনে হয়, বীরগঞ্জ বাজারের ওপর দিয়ে ভয়াবহ ঝড় বয়ে গেছে, হিন্দু সম্প্রদায়ের কোনো দোকানই আস্ত নাই। সব লোপাট। অবন্তি বাবুর হোমিওপ্যাথির দোকানও রক্ষা পায়নি। শুধু সুনীল নাউয়ার চুল কাটার দোকনটা অক্ষত আছে। ইতোমধ্যে লীগ নেতা জব্বার প্রামাণিকও বাজারে হাজির হয়। কারা এমন লুটতরাজ চালাল তা নিয়ে সে দু-একজন যুবনেতাকে ধমকাধমকিও করল। কিন্তু কার ইঙ্গিতে এসব লুটতরাজ হলো, তা সবাই বুঝতে পারলেও এ নিয়ে কেউ কোনো উচ্চবাচ্য করল না। ভগবানের ওপর দায় চাপিয়ে কেউ কেউ দোকানের সামনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা যৎসামান্য মালামাল কুড়াতে থাকে। হরিচরণের কুড়ানোর মতো কিছু ছিল না। তাই সে একবুক ব্যথা নিয়ে বাড়ির দিকে হাঁটতে থাকে। যেতে যেতে সে ভাবতে থাকে সবকিছু পাল্টে গেছে। স্বাধীনতা সবকিছু পাল্টে দিয়েছে। এতদিন যে প্রতিবেশীরা সুখে-দুঃখে সঙ্গ দিয়েছে, তারা আজ পর হয়ে গেছে। স্বাধীনতা সকলকে পর করে দিয়েছে। তবে কী স্বাধীনতা মানে মানুষে মানুষে বিভেদ, ঈর্ষা, বিদ্বেষ, হানাহানি? এসব প্রশ্ন মাথায় নিয়ে বাড়িতে ঢোকার পরপরই হরিচরণ জ্ঞান হারায়। জ্ঞান ফেরার পর স্ত্রী নমিতা, কন্যা সুমিতা ও পুত্র রামদাসকে দেখে ‘আমার সব শেষ হয়ে গেছে বলে’ কেঁদে ওঠে হরিচরণ। সেই কান্নার স্রোতে জিন্নাহ, নেহেরু ও গান্ধীর কুরশি না কাঁপলেও স্ত্রী, পুত্র ও কন্যার বুক প্রবল বেগে কেঁপে ওঠে। বিপদ যখন আসে তখন চারদিক থেকেই আসে। সে রাতে পাশের কবিরাজ গ্রামের চিৎকার চেঁচামেচিতে হরিচরণের ঘুম ভেঙে যায়। ঘটনা জানার জন্য রামদাস এগিয়ে যেতে চাইলেও মায়ের বাধায় সে আর সেদিকে যেতে পারেনি। রাতটা তাদের নির্ঘুম কাটিয়ে দিতে হয়। পরদিন সকালে কবিরাজ গ্রামে গিয়ে জানতে পারে, ভাতপুর গ্রামের কুদ্দুস চোরা জগদীশ কবিরাজের গোয়াল ঘর থেকে চারটা গরু চুরি করে নিয়ে যাবার সময় গ্রামের লোকেরা তাকে ধরে বেদম প্রহার করে গরুগুলো ছাড়িয়ে নেয়। এরপর সে গ্রামে গিয়ে ‘হিন্দুরা মুসলমানকে পিটাইছে’ এ কথা ছড়িয়ে দিলে বর্শা-বল্লম-কুড়াল নিয়ে ভাতপুর গ্রামের চোরেরা সব হামলে পড়ে কবিরাজ বাড়িতে। কয়েকজনকে জখম করে জগদীশের বাড়িতে লুটতরাজ চালিয়ে সবকিছু নিয়ে যায়। এ ঘটনার এক সপ্তাহের মধ্যে কবিরাজ বাড়ির শিক্ষিত পরিবারগুলোর সকলেই ঘরবাড়ি ফেলে ইন্ডিয়ায় চলে যায়।

এরপর হিন্দুদের সম্পত্তির ওপর নজর পড়ায় ক্রমে ক্রমে পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যেতে থাকে। এরইমধ্যে এক রাতে আড়াবাড়িতে ঝাড়াফিরা করতে গিয়ে রামদাসের দিদি সুমিতা আর ফিরে আসেনি। জব্বার প্রামাণিকের কাছে অনেক দেন দরবার করেও কন্যাটির আর হদিস মেলেনি। তাকে কে কোথায় নিয়ে গেছে, কেন নিয়ে গেছে তারও কোনো কূল কিনারা খুঁজে পায়নি রামদাস। এ অবস্থায় ভাঙা মন নিয়ে হরিচরণ একরাতে স্ত্রীকে বলে, ‘এই পরিবেশে আর থাকা চলে না রামের মা। কোনোদিন হয়তো হামাক বাড়ির মইধ্যে মারি থুইয়া যাইবে, তার চায়া চল হামড়া এন্ডিয়াত চলি যাই।’ মেয়েকে হারানোর পর ছেলেকেও হারাতে হতে পারে, এ শঙ্কায় নমিতা রানি আর আপত্তি করেনি। পরদিন সকাল সকাল প্রামাণিকের বাড়িতে হাজির হয় হরিচরণ। সকাল সকাল তাকে বাড়িতে দেখে একটুও অবাক হয়নি প্রামাণিক। সে জানে কেন হরিচরণ এসেছে। তারপরও অনেকটা আহ্লাদি কণ্ঠে অগমনের হেতু জিজ্ঞেস করলে হরিচরণ করজোরে বলে, ‘কয়টা টাকা নাগিল হয়।’ টাকা দিয়া কী করবে জানতে চাইলে হরিচরণ বিধ্বস্ত কণ্ঠটায় কোনো রকমে শব্দ তুলে বলে, ‘দেওয়ানির ব্যাটা, তোমার কতাই ঠিক, এই দ্যাশ হামার জন্যি লয়, কইন্যাক হারানু, কোনদিন ফের নিজে হারে যামো, ভাবিয়া দেখনু-তার চায়া হামার এন্ডিয়া চলি যাওয়া ভাল। নেহেরু কাকুর ওটে কপালত জুটলে দুই মুট অন্ন খামু, নইলে না খায়া থাকমু, তাও তো জেবন বাঁচপে, এটেতো ফুটুস করি কাঁয় কোনদিন মারি ফালাইবে, তার তো কোনো ঠিক নাই।’

প্রামাণিক জানত আখেরে এমনটাই হবে। তার চালে কখনো ভুল হয় না। ইদানিং বাড়িতে তার দলিলের স্ট্যাম্প রেডি করাই থাকে। তার এখন বরকতময় সময়। ইশারা করতেই চাকর কদর আলী ঘরের ভিতরে গিয়ে একখান খালি স্ট্যাম্প এনে ধরিয়ে দিলে প্রমাণিক তা হরিচরণের দিকে বাড়িয়ে স্বাক্ষর করার জায়গাটি দেখিয়ে টিপসই দিতে বললে হরিচরণ আমতা আমতা করে টাকার অঙ্ক জানতে চাইলে প্রামাণিক দুইটা ১০০ টাকার নোট বাড়িয়ে দেয়। মাত্র ২০০ টাকা দেখে হরিচরণ বলে, ‘দেওয়ানীর ব্যাটা ১০ শতক জমির দাম মাত্র এত কম ক্যানে?’ একথা শুনে প্রামাণিক কদর আলীকে স্ট্যাম্পটি ঘরে রেখে আসতে বলে অনেকটা কর্কশ স্বরে বলে, ‘ইয়ার চায়া বেশি টাকা দেওয়া সম্ভব না।’ এরপর কী মনে করে আরও ৫০ টাকা জুড়ে আড়াইশ টাকা বাড়িয়ে দিলে হরিচরণ আর কোনো কথা না বলে স্ট্যাম্পে টিপসই দিয়ে প্রণাম জানিয়ে প্রামাণিকের বাড়ি থেকে বেরিয়ে সোজা বাড়িতে চলে আসে। এ সময় আশপাশের ফসলের জমি, মন্দিরের সামনের পুকুর, তিন রাস্তার মোড়ের বটগাছসহ সবকিছুই তার কাছে কেমন যেন অচেনা অচেনা ঠেকে। পথে বাজারের কাপড় ব্যবসায়ী অমলের সাথে দেখা হলে সে তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলে, ‘দাদা ক্ষমা করি দিয়েন। কাইল সকালের ট্রেন ধরি হামরা কুচবিহার চলি যামো। বাঁচি থাকলে ফের দেখা হইবে।’ এ কথা বলেই হরিচরণকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়েই সে জোর কদমে বাজারের দিকে চলে যায়। হরিচরণ অবাক হয়ে তার  দিকে তাকিয়ে থাকে। সেও যে কাল সকালে আসাম মেইল ধরে কুচবিহার জেলায় চলে যাবে, সে কথা আর বলতে পারেনি। বাড়িতে ঢোকার পথে শেষ বারের মতো গাছগাছালির দিকে ভেজা চোখে তাকিয়ে থাকে হরিচরণ। আম গাছটার দিকে চোখ পড়তেই এক অব্যক্ত বেদনায় মনটা ভেঙে পড়ে। সারারাত আর ঘুমাবার সুযোগ মেলেনি। গরু দুইটা আগেই বিক্রি করে দিয়েছিল। কবুতরগুলো বিক্রি করতে মন সায় দেয় নাই, তাই রাতের বেলাতেই ওদের খুপড়ির খিল খুলে রাখে, যেন তারা ইচ্ছেমাফিক কোথাও চলে যেতে পারে।

গাট্টি বোচকা নিয়ে দুর্গা দুর্গা বলে বাড়ির বাইরে পা রাখতেই প্রতিবেশী পরিবারের সকলে শেষ বিদায় জানাতে ছুটে অসে। প্রতিবেশী ফয়সাল বন্ধু রামদাসকে জড়িয়ে ধরে কান্না জুড়ে দেয়। ফয়সালের মা আঁচল দিয়ে চোখ মোছে। কান্না শেষে ফয়সাল হরিচরণের দিকে তাকিয়ে খেদের সাথে বলে, ‘প্রামাণিক হামারজাদা শেষ পর্যন্ত আপনাদের তাড়িয়েই দিল কাকু?’ পুত্রসম ফয়সালের কথা শুনে এত দুঃখের মধ্যে হরিচরণের হাসি পায়। মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, ‘ভগবানের ওপর কারও হাত নাইরে বাপ। ত্যাঁয় যা ভাল মনে করেন তা-ই করেন। হয়তো হামার দ্যাশ ছাড়ার পেছনোত কোনো কল্যাণ লুকি আছে।’ রামদাসের বাবাকে কাকা বললেও তার মাকে ফয়সাল বরাবরই মাসীমা বলে। মাসীমা বলে এগিয়ে যেতেই তাকে জড়িয়ে কাঁদতে শুরু করে নমিতা রানি। কান্না শেষে ফয়সালের হাতটা ধরে বলে, ‘বাবা হামরা  কুচবিহারের দিনহাটাত গিয়ে উঠমো। স্যাটো একটা আশ্রয় খুঁজি নেমো। যদি সুমিতার কোনো খবর মেলে, কষ্ট করিয়া হামাক একনা জানাইস।’

পাঁচ ক্রোশ পথ হেঁটে ভুতছাড়া স্টেশন থেকে ট্রেন ধরতে হবে, হাতে বেশি সময় নাই, তাই হরিচরণের তাগিদ পেয়ে শেষবারের মতো বাড়িটার দিকে চোখ বুলিয়ে, আলতো করে একমুঠো মাটি তুলে নিয়ে তিন সদস্যের পরিবারটি কাঁচা রাস্তা ধরে হাঁটতে থাকে স্টেশনের দিকে। পেছনে পড়ে থাকে সাতপুরুষের ভিটা। স্টেশনে পৌঁছার পর দেখে, ট্রেন আসার আরও আধঘণ্টা বাকি আছে। তেমন ভিড় নেই। যারা আছে সকলেই আজীবনের জন্য দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার লোকজন। ইতোমধ্যে ১২ আনা দিয়ে তিনটা টিকেটও কাটা হয়। কাঁটায় কাঁটায় ঠিক সাড়ে নয়টায় ট্রেন এলে সকলে মিলে একটা তৃতীয় শ্রেণির কামরায় উঠে পড়ে। যথাসময়ে হুইসেল দিয়ে ট্রেন ছাড়ার সাথে সাথে অঝোরে কান্না শুরু করে নমিতা রানি। মাঝে মাঝে ‘সুমিতারে ...’ বলে ডুকরে ওঠে। হরিচরণের মনে প্রশ্ন জাগে, কোনো কারণ ব্যতিরেকে এ কেমন দেশ ত্যাগ, মাতৃভূমির সাথে সম্পর্ক ছিন্নতা? রামচন্দ্র মাতৃভূমি ছেড়েছিল, পঞ্চপান্ডব মাতৃভূমি ছেড়েছিল, তার কারণও ছিল, তারা আবার মাতৃভূমিতে ফিরেও এসেছিল। কিন্তু তাদেরতো আর ফেরা হবে না। কেন হবে না, সে প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আর মন সায় দেয় না। ধোঁয়া উড়িয়ে ট্রেন চলতে থাকে। কাউনিয়ার পন তিস্তাসেতু হয়ে কু ঝিক ঝিক শব্দ তুলে ট্রেন ছুটতে থাকে উত্তরের দিকে। একঘণ্টা পর ট্রেন থামে লালমনিরহাট জংশনে। ইঞ্জিনে পানি ভরার পর আবার লম্বা হুইসেল বাজিয়ে ছুটতে থাকে ট্রেন। আধাঘণ্টা চলার পর মোগলহাট সীমান্ত পেরিয়ে ধরলা সেতু পার হয়ে ট্রেন থামে গিতালদহে। টিকেট কাটা ছিল দিনহাটা পর্যন্ত। কিন্তু নমিতা রানির শরীর হঠাৎ করে ভীষণ খারাপ হয়ে যাওয়ায় পথে গিতালদহেই তারা নেমে পড়ে। নতুন দেশ, পরিচিত কেউ নাই এ অবস্থায় কোথায় যাবে, কোথায় থাকবে তা নিয়ে মহাচিন্তায় পড়ে যায় হরিচরণ। সেইদিনটা রেলস্টেশনেই কাটিয়ে দেয় তারা। সাথে সম্বল মাত্র বাড়ি বেচা আড়াইশ টাকা, আর গরু বেচা ২০ টাকা। পরদিন খোঁজখবর নেয়ার পর তারা হাজির হয় ট্রানজিট ক্যাম্পে। সেখান থেকে বলা হয়, কয়েকদিনের মধ্যে তাদের আসামের ধুবড়িতে পাঠিয়ে দেয়া হবে। সেখানেই তাদের পুনর্বাসনের জন্য যা যা করা দরকার তা করা হবে। ট্রানজিট ক্যাম্পের অবস্থা অত্যন্ত অসহনীয়। শত শত লোককে কয়েকটা তাঁবুতে গাদাগাদি করে রাখা হয়েছে। কাঁচা পায়খানার দুর্গন্ধে টেকা দায়। নাই পানির সুব্যবস্থা। দূরের এক ইঁদারা থেকে পানি আনতে হবে। নোঙ্গরখানার খাওয়াও গন্ধযুদ্ধ। এই পরিবেশে দুদিন থাকার পরই হরিচরণ ও নমিতা রানি একযোগে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে একেবারে কাবু হয়ে পড়ে। স্বেচ্ছাসেবকরা অনেক চেষ্টা করেও শেষ পর্যন্ত বাঁচাতে পারেনি। চারঘণ্টার ব্যবধানে দুজনেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। যে জীবন রক্ষার জন্য দেশ ছেড়ে পালিয়ে আসা, সেই জীবনের এমন অপমৃত্যুতে রামদাস পুরোপুরি ভেঙে পড়ে। সেদিন রাতেই বাবা-মার সৎকার করার পর রামদাস আর ক্যাম্পে ফিরে যায়নি। রেলস্টেশনে রাতটা কাটিয়ে দেয়। পরদিন স্থির করে, দেশেই ফিরে যাবে। মরলে সেখানেই মরবে। সে মোতাবেক উঠে বসে পার্বতীপুরগামী লোকাল ট্রেনে। ট্রেন লালমনিরহাট স্টেশনে দাঁড়াবার পর হঠাৎ রামদাস দেখে, ফয়সালের বাবা-নোমান কাকা স্টেশনের প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে লোকজনের সাথে কথা বলছে। তাকে দেখেই কামরা থেকে লাফ দিয়ে নেমে তার সামনে দাঁড়ায় রামদাস। আচানক তাকে দেখে অনেকটা অবাক হয় নোমান সাহেব। সবকিছু শোনার পর তাকে নিয়ে অফিসের দিকে হাঁটা দেয়। নোমান সাহেব ছিলেন রেলের বিভাগীয় অফিসের সংস্থাপন শাখার কেরানি। তার অফিসার ছিলেন অ্যাংলো ইন্ডিয়ান রবাটসন। তাকে বলে কয়ে সেদিনই রামদাসের জন্য একটি খালাসির চাকরির ব্যস্থা করে দেন নোমান সাহেব। নিয়োগপত্র স্বাক্ষরের সময় রবাটসন খুব অবাক হয়ে বলে, ‘অফিসের সব হিন্দু কর্মচারী অপশন দিয়ে ইন্ডিয়ায় চলে যাচ্ছে। আর তোমার ক্যানডিডেট ইন্ডিয়া থেকে ফেরত এসে এখানে চাকরি নিচ্ছে, ভেরি মিস্টেরিয়াস! তোমরা ভারতীয়রা কেন যে দেশটা ভাগ করলে, মাথায় ঢোকে না।’ এসব কথার কোনো উত্তর না দিয়ে রবাটসনকে ধন্যবাদ জানিয়ে নিয়োগপত্র নিয়ে রামদাসের হাতে দিয়ে বলে, ‘আজই লোকোশেডে গিয়ে ফোরম্যানের অফিসে জয়েন কর।’ নোমান কাকার কাছে সবকিছু বুঝে নিয়ে সেদিনই রামদাস চাকুরিতে যোগদান করে। এরপর শুরু হয়ে রামদাসের নতুন জীবন।

এসব ভাবতে ভাবতে কখন যে রামদাস ঘুমিয়ে পড়ে টেরও পায়নি। সকালে একটু দেরি করেই ঘুম ভাঙে। শরীরের ব্যথা তখনও যায়নি। সকালের কাজ সেরে জলখাবার খেয়েই রামদাস হাঁটা দেয় লোকো শেডের দিকে। পাড়াজুড়ে তখন থমথমে অবস্থা। ইঞ্জিন ফেলে এভাবে চলে আসায় তাকে দেখেই ফোরম্যান ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। এরই মধ্যে চালক খবির চলে আসায় সেই যাত্রা সে বিহারি ফোরম্যানের গালিগালাজ থেকে রক্ষা পায়। পুরো লোকোশেড নীরব নিস্তব্ধ। ইঞ্জিনের শব্দ আর কর্মচারীদের কোলাহলে মুখরিত লোকোশেডের সব ইঞ্জিন যেন দমবন্ধ করে মরে পড়ে আছে। ওয়ার্কশপ আর অফিসগুলোতে ঝুলছে তালা। সামান্য কয়েকজন কর্মচারী যারা এসেছে, তারাও এদিক সেদিক অলস সময় পার করছে, কথা বলছে এমন ফিসফাস করে; যেন সকলের কণ্ঠনালী মারাত্মক ক্ষতে আক্রান্ত। সকলেরই চোখেমুখে উৎকণ্ঠার ছাপ। 
কিছুক্ষণ অফিসে ঘোরাঘুরির পর বাসার দিকে পা বাড়ায় রামদাস। পথে মেডিকেল কলোনির রাস্তা ধরে হাঁটার সময় তাকে দেখেই হাতের হুক্কা রেখে বাসার সামনে থেকে দৌড়ে আসে নগেন দাস। এ পাড়ায় হিন্দু সম্প্রদায়ের এই দুটি পরিবারই থাকে। নগেন দাস মেডিকেল বিভাগে খালাসির চাকরি করে। বাড়ি নোয়াখালীর রামগঞ্জে। স্ত্রী আর তিন কন্যাকে নিয়ে সে একটা এক রুমের কোয়ার্টারে থাকে। রামদাসের সামনে দাঁড়িয়ে কোনো ভূমিকা ছাড়াই নগেন দাস বলে, ‘কী সিদ্ধান্ত লইলেন দাদা?’ ‘সিদ্ধান্ত! কীসের সিদ্ধান্ত?’ রামদাসের পাল্টা প্রশ্নে খানিকটা হতচকিত হয়ে একটু দম নিয়ে নগেন দাস বলে, ‘না, কইছিলাম যে দ্যাশে তো যুদ্ধ শুরু হই গেল, হাঞ্জাবিরা ঢাকায় হিন্দুগরে মারি নাশ করি দিতাছে, অন এই অবস্থায় ইয়ানো থাইকবেন নাকি মাসীর দ্যাশো চলি যাইবেন, হেই কথা জানতে চাইছিলাম আর কি?’

মাসীর দেশের কথা শুনেই রামদাসের ২৪ বছর আগেকার কথা মনে পড়ে। মনে পড়ে পিতা-মাতার মৃত্যুর কথা। মনটা তার বিষণ্ণ হয়ে পড়ে। এরপর বলে, ‘নগেন দা ভাগবান যার মিত্তু য্যাটে নেকি রাকছে, স্যাটেই তাক মুখাগ্নি নেওয়া নাগবে। মাসীর দ্যাশত যান, আর কাকার দ্যাশত যান, কপালত যা নেকা আছে তা খণ্ডন হবার লয়।’ এ ধরনের প্রতিক্রিয়া নাগেনের অভিপ্রেত ছিল না। সে মনে করেছিল রামদাস সম্মত হলে দুই পরিবার মিলে একত্রে ইন্ডিয়ায় চলে যাবে। কিন্তু রামদাসের কথা শুনে সে অনেকটা হতাশ হয়ে পড়ে। এরপরও নগেন হাল ছাড়ে না। কিছুটা ইতস্তত ভঙ্গিতে বলে, ‘কাইল গেছিলাম চিত্ত বাবুর বাড়িত। হ্যাতেনে তো অনেক বড় লিডার। অনেক খবরাখবর রাখেন। হ্যাতেন কইছেন হিন্দু হাইলে কোনো কতা নাই, হাঞ্জাবিরা ঠাস গুলি করি মারি হালায়, আর কী কইতাম অমনেরে... হ্যাতারা নাকি হিন্দু মাইয়া হাইলেই গনিমতের মাল কইয়া ধরি লই যায় ক্যাম্পে, হিয়ানো লই মাইয়াগুলারে এক্কেরে শ্যাষ করি দেয়, হ্যাতাগো নাকি কোনো দয়া মায়া নাই, হ্যাশে চিত্ত বাবু কইছে হাঞ্জাবি আওনের আগ দি আমরা য্যান মাসীর দ্যাশো চলি যাই। দু-গা মাইয়া অনেকটা ডাগর হইছে, হ্যাতিগোর চিন্তায় আই তো অন ঠিকমতো ঘুমাইতনও হারি না। আমনের দিপালিও তো ডাগর হইছে, অন চিন্তা করি দ্যাখেন কিয়া কইরবেন।’

উদাসীন প্রকৃতির রামচাদ নগেনের কথাগুলো এক কান দিয়ে শুনে অন্য কান দিয়ে বের করে দেয়। তার কাছে কথাগুলো বাহুল্য মনে হয়।  এরপর সে অনেকটা খেদের সাথেই বলে, ‘শোনেক দাদা, ৪৭ সালে স্বাধীনতাকালের নাড়াই ছেলো হেন্দু আর মুসলমানের। সেবার হেন্দু মুসলমানক মারছে, মুসলমান হেন্দুক মারছে। এবারকার নাড়াই মোসলমান-মোসলমানে। শেখ সাহেব যেমন মোসলমান ইয়াহিয়া খানও তেমন মোসলমান। কাটাকাটি হইবে তামরা তামরায়। হামার ইয়াত কোনোকিছু নাই।”

প্রতুত্তরে নগেন বলে, ‘দাদা কথা খারাপ কন নাই। কিন্তুক হুনলাম; এইবারের যুদ্ধ হাঞ্জাবিগো লগে বাঙালিগো। অন বাঙালিতো তো খালি মোসলমান না, আমরা হিন্দুরা তো বাঙালির মইদ্যো হড়ি, অন হ্যাতারাতো আঙ্গরেও ছাড়ি দিতো ন।’ আলোচনা এ পর্যন্তই শেষ। 
এরপর দেখতে দেখতে চলে আসে ৩ এপ্রিল। প্রতিরোধ যোদ্ধাদের তিস্তা রেলসেতু ও ত্রিমোহনী প্রতিরোধ ভেঙে পড়লে হানাদার সেনারা শহরের অনতিদূরের বিমান ঘাঁটি দখলে নিয়ে নেয়। এরপর গান পাউডার ছিটিয়ে আশপাশের গ্রামগুলিতে আগুন ধরিয়ে দিলে শহর জুড়ে আতঙ্ক দেখা দেয়। পরদিনই হানাদারদের শহরে অনুপ্রবেশের সম্ভাবনা নিশ্চিত হলে আওয়ামী নেতৃবৃন্দসহ শহরের সচেতন লোকেরা সব দলে দলে শহর ছাড়তে থাকে। এরই এক পর্যায়ে রামদাসের বাড়িতে এসে নগেন দাস শহর ছাড়ার তাগিদ দিলেও তা গায়ে মাখেনি রামদাস। অগত্যা সেদিন সন্ধ্যাতেই নগেন দাস তার পালিত গরুগুলো এক প্রতিবেশীর জিম্মায় রেখে শত শত লোকের কাফেলায় তিন কন্যাকে নিয়ে সীমান্তের দিকে রওয়ানা হয়।

পরদিন হানাদার সেনারা শহরে প্রবেশের পর পরই শুরু হয় ইতিহাসের জঘন্যতম গণহত্যা। টানা দুইদিনের হত্যাযজ্ঞে কয়েকশত নিরাপরাধ বাঙালিকে হত্যা করা হয়। এ সময় রামদাসের পরিবার একমাত্র হিন্দু পরিবার হয়েও এ হত্যাযজ্ঞ হতে রক্ষা পায়। ইতোমধ্যে কাজে যোগদানের জন্য মাইকিং করা হলে রাম নাম জপতে জপতে রামদাস হাজির হয়ে লোকোশেডে। তাকে দেখেই জেলেবেগুনে জ্বলে ওঠে বিহারি ফোরম্যান। ক্ষুব্ধকণ্ঠে পাশের সহকর্মীকে বলে, ‘কেয়া বাত, ইয়ে মালাউন আভি তাক জিন্দা হায় ক্যায়সে?’ কয়েকজন উদার সহকর্মীর হস্তক্ষেপে সে যাত্রায় রামদাস রক্ষা পায়। কাজে জয়েন করে বয়লারে কয়লা মেরে কয়েকটি ইঞ্জিন চালু করার পর তার ছুটি মেলে। এরই মধ্যে পুরো শহরটিকে পরিণত করা হয় একটি শ্মশানপুরিতে। ভীত সন্ত্রস্ত পরিবেশে কোয়ার্টারে ফেরার পথে দেখে বিভিন্ন স্থানে পরিচিত লোকজনের ক্ষত-বিক্ষত লাশ পড়ে আছে। এদের কাউকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে, কাউকে বা পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে। বাসায় ফেরার পর দিপালি দৌড়ে এসে কাঁদতে কাঁদতে বলে, ‘বাবা কোনোটে পালে যাও। ওরা দেকলে তোমাক মারি ফেলাইবে। খানিক আগে দারা, মকবুল চাচা আর আলতাফ ভাইওক ধরি নিয়া গেইছে। বিহারিরা কবার নাগছে শহরের সউগ বাঙালিক মারি ফালাইবে।’
 
মেয়ের কথা শেষ হলে রামদাস নির্বাক চোখে দিপালির দিকে তাকিয়ে থাকে। এ সময় নগেনের কথা মনে পড়ে। মনে মনে বলে নগেন তো ঠিকই কইছিল, মেয়ে তো সত্যি সত্যি ডাগর হইছে। এত হত্যাযজ্ঞ দেখার পর রামদাস বুঝতে পারে বড় ভুল হয়ে গেছে। নগেনের কথা শোনা উচিত ছিল। মেয়েটার জন্য তার বুকটা হাহাকার করে ওঠে। কান্না মিশ্রিত কণ্ঠে বলে, ‘মা-রে মোক ক্ষেমা করি দিস। বড় ভুল হয়া গেইছেরে মা। এটে থাকাটা ঠিক হয় নাই। নগেনের নাখান মাসীর দ্যাশোত চলি যাওয়া উচিত আছিলো।’ বাবার কথার কোনো আগামাথা বুঝতে পারে না দিপালি। চোখ মুছতে মুছতে বলে, ‘কলতলাত জল দেওয়া আছে, হাত মুখ ধুয়া এলা একনা খায়া নেন। ভগবান কপালত যা আখছে তাই হইবে। এলা ওগলা নিয়ে চিন্তা করিয়া লাভ নাই।’ প্রচণ্ড ক্ষুধা পেটে খেতে বসেও রামদাস খেতে পারে না। পথে পথে পড়ে থাকা পরিচিতজনদের মরদেহগুলো বারবার চোখের সামনে ভাসতে থাকে। গতকালই ট্যান্ডল আলী আহম্মেদের সাথে শরফুদ্দিনের দোকানে একসাথে চা খেয়েছিল, মকবুল সাহেবে সাথে রাস্তার মাথায় কথা হয়েছিল। তিনি বলেছিলেন, ‘আমরা সরকারি চাকরিজীবী, আমাদের কেন মারবে? আজ তারা সকলে স্বাধীনতা যুদ্ধের বলি হয়ে গেছে।’ এ ছাড়া ‘ইয়ে মালাউন আভি তাক ক্যায়সে জিন্দা হায়’ ফোরম্যানের কথাটি বারবার প্রতিধ্বনিত হয়ে রামদাসকে কেমন যেন উদাস করে দিতে থাকে। সে ভাবতে থাকে, তবে কি মৃত্যু আসন্ন। এ অবস্থায় তার আর ভাত খাওয়া হয়নি। দু-এক গ্রাস ভাত মুখে তুলেই পানি খেয়ে উঠে পড়ে।

পরপর দুদিন লাগাতার হত্যাযজ্ঞ চালাবার পর পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হয়ে আসলে পাড়ার অন্যদের সাথে রামদাসও কিছুটা হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। এরই মধ্যে ট্রেন চলাচলও শুরু হলে রামদাসও রোস্টার অনুযায়ী বিভিন্ন গন্তব্যে ট্রেন নিয়ে যেতে থাকে। এভাবে কয়েকদিন চলার পর আবার শুরু হয় হত্যাযজ্ঞ। এ পর্যায়ে আর হানাদার সেনারা নয়, ঘাতকের ভূমিকায় নেমে পড়ে স্থানীয় বিহারিরা। তারা রাতে কোয়ার্টারে কোয়ার্টারে হানা দিয়ে লোকজনকে হত্যা করতে থাকে। ইতোমধ্যে রাতের আঁধারে হানা দিয়ে প্রতিবেশী বেলাল, হাফিজউদ্দিন আর শামসুর রহমানকে হত্যা করে ঘাতকরা। এরপর কার কোয়ার্টারে ঘাতকরা হামলে পড়তে সে চিন্তায় রামদাসের ঘুম উধাও হয়ে যায়। রাতে বিছানায় গেলেই রেল ইঞ্জিনের পিস্টনের মতো কানে বাজে  ‘ইয়ে মালাউন আফি তাক ক্যায়সে জিন্দা হায়’। এরইসাথে কানে খটখট করে বাজে নগেনের কথা ‘আমনের দিপালিও তো ডাগর হইছে’।  

এসব কথা রামদাসের মনে যখন বয়লারের আগুনের মতো জ¦লছিল তখন ডান ও বাম পাশের কোয়ার্টার হতে হঠাৎ আর্তনাদের শব্দ ভেসে আসায় রামদাসের তন্দ্র ছুটে যায়। সকলকে জাগিয়ে সে বিছানায় বসে কান খাড়া করে রাখে। এরপর একনাগারে চলতে থাকে কান্না, আর্তনাদ, গোঙানি আর বাঁচাও বাঁচাও চিৎকার। এতে রামদাস বুঝতে পারে; পাশের দুই বাড়িতে লোকজনতে ধরে ধরে জবাই করা হচ্ছে। এ অবস্থায় রামদাসের ঘরেও শুরু হয় চাপা কান্না। রামদাস শুধু নির্বাক তাকিয়ে থাকে স্ত্রী আর কন্যার দিকে। এসময় ফিসফিসিয়ে  স্ত্রী গঙ্গারানিকে বলে; বউ হামার যদিক কিছু হয়া যায়, কইন্যাটাক একনা দেখি শুনি রাখিস। আবস্থা যা, হয়ত আইজ আইতোত মোর স¹ বাস হইবে। রামদাস নিজের স্বর্গবাস নিয়ে উদ্বিগ্ন, সে কল্পনাও করতে পারেনি যে পাশের দুই কোয়ার্টারে শুধু পুরুষ নয়, সব বয়সের নারীসহ দুধের শিশুদেরও হত্যা করা হচ্ছে। দুই পরিবারের দশজনের মৃত্যুকালীন আর্তনাদে সারা পাড়া পরিণত হয় এক মৃত্যুপুরিতে। এভাবে তিন-চার ঘণ্টা পার হওয়ার পর একসময় দুপাশে নেমে আসে শ্মশানের নীরবতা। রামদাস মনে করে ঘাতকরা হয়ত হত্যাযজ্ঞ সমাপ্ত করে ফিরে গেছে। ফিসফিস করে দিপালিকে বলে; মা-রে মনে হইতেছে আর ভয় নাই। তারা মনে হয় চলি গেইসে। এ কথা বলার পরপরই চাটাইয়ের দরোজায় ধপ ধপ করে শব্দ হতে থাকে। বাইরে থেকে কে একজন একটু চাপা গলায় হুংকার দিয়ে বলে; দরওয়াজা খোল শালে লোক। একথা বলতে বলতে লাথি মেরে চাটাইয়ের দরোজা ভেঙে একে একে  ১০ জন ঘাতক ঘরের উঠানে এসে দাঁড়ায়। প্রত্যেকের মুখ গামছা দিয়ে বাঁধা। হাতে বড় বড় রাম দা ও চাপাতি, একজনের হাতে চকচকে তরাবরি। এরই মধ্যে পরিবারের সকলে ঘরের সামনের বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। সকলের চোখ ভেজা। রামদাস করজোরে বলে; হামরাগুলার কী অপরাধ? হামাক ক্ষেমা করেন বাবারা। নীরবতা ভেঙে ঘাতকদের সর্দার আঙুল তুলে একে একে গোনার পর বলে; সাত আদমি। এরপর পাশের  জনের দিকে তাকিয়ে তিরষ্কারের ঢঙে বলে; তুম লোগ শালে সাবকে সাব জাহান্নামকে যাওগে। পাশের জন মিনমিন করে বলে; কিঁউ উস্তাদ, হামারা কসুর ক্যায়া? ফির কসুর কা বাত বলতা হ্যায়, শালে নিকাম্মো, একথা বলেই সে হুংকার দিয়ে বলে; আভি তাক ইছ মহল্লামে সাত মালাউন জিন্দা হ্যায়, আউর তুম কসুর কা বাত বলতেহো। একথা শোনার সাথে সাথে পাশের দুই ঘাতক আভি কে আভি কাম হো যায়গা বলে চিলের মতো ছোঁ দিয়ে ৭ বছরের বিনয় আর ৫ বছরের মিনতিকে ধরে রান্নাঘর লাগোয়া নালায় ফেলে চাপাতির কোপে মাথা শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। চোখের সামনে এহেন মর্মান্তিক হত্যাযজ্ঞ দেখে সকলে একযোগে ডুকরে কাঁদতে থাকে। মা গঙ্গারানি হায় রাম বলেই মাথা ঘুরে ধপাস করে খুনিদের পায়ের কাছে পড়ে যায়। বাচ্চা দুটোর ধড়হীন দেহ দুটো যখন গলাকাটা মাগুর মাছের মতো লাফাচ্ছিল, ঠিক তখন বড় মসজিদ থেকে ফজরের আজানের শব্দ ভেসে আসতে থাকে। আযানের শব্দ শুনতেই তরবারীওয়ালা ঘাতক গঙ্গরানির চুলের মুঠো ছেড়ে দিলে তার জ্ঞানহীন দেহটা ধপাস করে মাটিতে পড়ে যায়। আযানের বিরতিকালে দিপালিকে দেখে দুই ঘাতকের চোখ ক্ষুধার্ত হায়েনার মতো চকচক করে ওঠে। এরপর আযানের ‘আসসালাতু খাইরুম মিনান নাউম’ ঘোষিত হবার পরপরই জ্ঞানহীন গঙ্গরানির চুলের মুঠো ধরে তোলার সময় এক ঘাতক হাত কচলাতে কচলাতে বলে; আগার ইন লোগোকো জাহান্নামনে ভেজনেকে বদলেমে মুসলামান বানা দেঙ্গে তো ক্যায়সা হোগা উস্তাদ। প্রস্তাবে পুলকিত হয়ে উস্তাদ গঙ্গরানির  চুলে মুঠি ছাড়তে ছাড়তে বলে; তেরে বাত মেম দম হ্যায় মেরে ভাই, ঠিক হ্যায় শালে লোগেকো পুছো মুসলমান হোগা কি নাহি?  রামদাস করজোর অবস্থায় এক দৃষ্টিতে থাকিয়ে থাকে সদ্য শহিদ সন্তান দুটির দিকে। হঠাৎ এক ঘাতকের হুংকারে তার সম্বিৎ ফিরে আসে। এরপর প্রতিবেশী বিহারি সাল্লান মুখ থেকে গামছা সরিয়ে মোলায়ের স্বরে সুধায়; রাম কাকা আপ লোগোকো মুসলমান বান না হ্যায়, ইয়া কি মুর্দা বান না হ্যায়। এ ধরনের প্রস্তাবে রামদাসের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে। ধর্মত্যাগ! এ যে মহাপাপ। ২৪ বছর আগে এ কাজ করলে তো মা, বাবা ও বোনকে হারাত হতো না, এখন ধর্মত্যাগ নাকি জীবন ত্যাগ, কোনটা কল্যাণকর তা নিয়ে বেশ ধন্ধে  পড়ে যায় রামদাস। মনে মনে ভাবে; এতদিন স্বাধীনতা মানে ছিল স্বজন হারানোর বেদনা, ঠিকানাহীন হওয়া, এখন এর সাথে যুক্ত হতে চলেছে ধর্মান্তর। রামদাসের এহেন ভাবনাময় নিস্পৃহতায় বিরক্ত হয়ে সাল্লান বলে; সুবেহ হো যা রাহা হায়, জালদি বাতাইয়ে মুসলিম ইয়া মুর্দা?

রামদাস অর্তস্বরে বলে; বাবারে তোমরাগুলান যা ভাল মনে করেন, তা করেন, জান ভিক্ষার বদলে যদিক ধর্ম ছাড়া নাগে, হামার তাত্ আপত্তি নাই। সম্মতি পাওয়ার পর সাল্লানের পিঠ চাপড়ে উস্তাদ বলে; ইয়ে বহুত আচ্ছা কাম হুয়া, আল্লাহ মিয়া বহুত খোশ হোগা। মিনতিকে জবাইকারীর হাতের চাপাতি থেকে তখনো ঝরছিল, এ সিদ্ধান্তে সে-ও খুশিতে আটখানা হয়ে বলে; ইয়ে বহুত আচ্ছা হুয়া, হামলোগকো ভি বহুত ছারে ছোয়াব মিলে গা। সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হবার পর ঘর ছাড়ার আগ দিয়ে দুই ঘাতক দিপালির দুই হাত ধরে তাদের সাথে নিতে উদ্যত হলে; রামদাস দৌড়ে গিয়ে পথ আগলে দাঁড়ায়। কাঁদতে কাঁদতে পায়ে লুটিয়ে পড়ে বলে; বাবারা হামরা এলা মুসলমান হয়া গেইছি, ফের বেটিক ক্যানে নিয়া যান, দয়া করি উয়াক ছাড়ি দেন। রামদাসের কথা আমলে না নিয়ে সাল্লান বলে; কালেমা পারনেকা বাদ আপলোগ মুসলমান বানেঙ্গে, আভি তাক আপলোক হিন্দুই হ্যায়। অপকা লাকড়ি কো তুরন্ত ওয়াপাস ভেজ দেঙ্গে, ঘাবড়াইয়ে মাত। এ কথা বলতে বলতে লাথি মেরে রামদাসকে একপাশে সরিয়ে দিয়ে ঘাতকরা দিপালিকে নিয়ে বেরিয়ে যায়। দিপালির বুকফাটা চিৎকার মিলিয়ে যায় আবছা আঁধারে। পূর্ব দিগন্তে লালরেখা ফুটে ওঠে। একটু পরই সূর্যের আলো উঁকি দিয়ে দিনের জানান দেয়। ওদিকে দিপালি নিমজ্জিত হতে থাকে নিকষ অন্ধকারে। পরপর পাঁচজনের পাশবিক চাপ সামাল দেয়ার পর তার বিবস্ত্র শরীরটা নিয়ে নাড়াচাড়া করতে থাকে প্রতিবেশী সাল্লান।  বিশ বছরের বড় যে সাল্লানকে শিশুকাল থেকে দিপালি ভাইয়া বলে অভ্যস্ত, যার হাতে রাখিবন্ধন বাঁধার কথা, সেই ভাইয়া আজ পাকিস্তান রক্ষার সৈনিক হিসেবে একজন জাতশত্রæর উপর উপগত হয়ে পাকিস্তানকে হেফাজতের জন্য অসুরের মতো দলিত মথিত করছে দিপালি নামের এক মালাউন নারীকে। সাল্লান নিষ্ক্রিয় হবার পরপরই জ্ঞান হারায় দিপালি। এরপর আরও কতজন ছিল তা তার অজ্ঞাত। অতঃপর নসরের পাটের গুদামে দিপালির জ্ঞানহীন শরীরটা ফেলে রেখে ঘাতকরা যে যার মতো চলে যায়।

পরদিন সকালে আশপাশের প্রতিবেশীরা এসে দেখে রামদাস হাঁটুতে মাথা গুঁজে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে। গঙ্গারানির তখনো জ্ঞান ফেরেনি। পুত্র মুকুল দাস ও গকুল দাস বারান্দায় শুয়ে আছে, তাদের চোখ দিয়ে তখনো জলের ধারা বইছে। হত্যাযজ্ঞ শেষে ঘাতকরা বিনয়, মিনতিসহ পাশের দুই প্রতিবেশীর ১২ জন শহিদের লাশগুলো টুকরো টুকরো করে পাশের এক কলাবাগানের ছায়ায় মাটি চাপা দিয়ে যায়। একইসময় পানি ঢেলে নালা, উঠান পরিষ্কার করে যায়। হত্যার কোনো চিহ্নই তারা আর রাখেনি। মাথা তুলে প্রতিবেশীদের দেখে খেলনা হারানো শিশুর মতো কেঁদে ওঠেন রামদাস। চোখে মুখে পানি ছিটিয়ে জ্ঞান ফেরানোর পর আশপাশে নজর বুলিয়ে দিপালি বলেই আবার জ্ঞান হারায় গঙ্গারানি। পরে অনেক কসরৎ করে আবার তার জ্ঞান ফেরানো হয়। এভাবে এক শোকার্ত অবস্থায় দুপুর গড়িয়ে যায়। সামনের এক প্রতিবেশীর বাসা থেকে কিছু ভাত তরকারি পাঠানো হলেও কেউ তা মুখে তুলতে পারেনি। উদাস দৃষ্টিতে উঠানের তুলসি গাছটার দিকে তাকিয়ে থাকাকালে বারবার তার নগেনের কথাগুলো মনে পড়তে থাকে। গাছমা দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে রামদাস ভাবে; স্বাধীনতার সাথে আরও একটি ত্যাগ যুক্ত হলো; নারীর সম্ভ্রম। দিপালির কথা ভেবে বুকটা হাহাকার করে ওঠে রামদাসের। মেয়েটা কোথায় আছে, কেমন আছে, আদৌ বেঁছে আছে কিনা, ইত্যাকার ভাবনায় তার মাথা ঘুরতে থাকে। একসময় আর বসে থাকাও সম্ভব হয় আস্তে করে কাত হয়ে মেঝেতে শরীর লুটিয়ে দিয়ে তন্দ্রচ্ছন্ন হয়ে পড়ে।  

এর কিছুক্ষণ পর ঢোলের শব্দে রামদাসের তন্ত্রা ছুটে যায়। ঢোলের শব্দ ক্রমশ এগিয়ে আসতে থাকলে সে কাতর শরীরটাকে কোনামতে টেনে উঠে বসতে বসতে দেখে; খুনি সাল্লান দরোজা ঠেলে আন্ধা মাওলানাকে (একচোখ কাণা ও এক চোখ ভাল হলেও সকলে তাকে আন্ধা মাওলানা বলত) নিয়ে ভেতরে ঢুকছে। সাথে এলাকার কয়েকজন বিহারিসহ দু-জন ঢুলি। অন্ধা মাওলানা এলাকায় বেশ পরিচিত। লোকমুখে শোনা যায়; সে নাকি জিন নামাতে পারে। খুব কামেল লোক। গেল বছর জলবসন্তের প্রকোপকালে রামদাসরাও চার আনা হাদিয়া দিয়ে তার কাছ থেকে বিশেষ কবচ এনে হাতে বেঁধেছিল। তাদের দেখেই রামদাসের বিগত রাতে কথা মনে পড়ে। বুঝতে পারে ওয়াদামতো আজ তাদেরকে ধর্মান্তরিত হতে হবে। নিজে থেকেই একটা মোড়া এগিয়ে দিলে; আন্ধা মাওলানা শুকরিয়া বলে তসবি টিপতে থাকে। এ সময় ঘরের দিকে নজর বুলিয়ে দিপালিকে না দেখে একটু খটকা লাগে সাল্লানের। মুকুল দাাসকে ইশারায় কাছে ডেকে আস্তে করে জিজ্ঞেস করে; তেরা দিদি ওয়াপাস নাহি আয়া?  আস্তে করে বললেও তা রামদাসের কানে বাজে। সাল্লানের দিকে তাকিয়ে বলে; বাবা, বেটি কোনাক কোটে নিয়া আখনেন, ত্যাঁয় তো এলাও আসিল না। প্রশ্নটা করেই করুণ চোখে তার দিকে তাকিয়ে থাকে রামদাস। মেয়েকে আদৌ ফিরে পাবে কিনা তা নিয়ে সন্ধিহান হয়ে ওঠে। এ কথা শোনার পর আঙুলের ইশারায় মুকুলকে কাছে ডেকে বলে; যারা নসর মিয়াকা গেডাউনছে ডুনকে আও, দেখো, ওহা হায় কি নাই তোমহারা দিদি। এ কথা শুনে মুকুল আর বিলম্ব না করে তখনই ছোটে নসর মিয়ার পাট গুদামের দিকে। অধাভাঙা দরোজাটা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই দেখে অন্ধকারে একটা নারী মূর্তি পড়ে আছে। কাছাকাছি গিয়ে চিনতে পেরেই দিদি বলে চিৎকার দিয়ে দিপালিকে জড়িয়ে ধরে। দিদির এ অবস্থা দেখে বুকটা হাহাকার করে ওঠে মুকুলের। সে যে বিবস্ত্র অবস্থায় পড়ে আছে, সে কথাও ভুলে যায় মুকুল। কিছুক্ষণ পর দিপালি চোখ মেলে তাকালে শুরু হয় কান্নার মচ্ছব। বিধ্বস্ত দিপালি পড়ে ছিল একটি রক্তমাখা ত্রিপলের ওপর। পাশেই পড়েছিল তার রক্তমাখা শাড়ি, বøাউস ও পেটিকোট। স্বাভাবিকতা ফিরে পাবার পর পরম মমতায় দিদিকে শাড়ি পরিয়ে তার কাঁধে ভর দিতে বলে দুই ভাইবোন আস্তে আস্তে হাঁটতে থাকে বাসার দিকে। পথে তাদের দেখে কেউ কেউ মুচকি মুচকি হাসে, কেউ আবার জামা উপরে উঠিয়ে চোখ মোছে। উঠান পেরিয়ে ঘরে ওঠার সময় তার রক্তাক্ত শাড়ি দেখে মাওলানা অন্যদিকে চোখ ফিরিয়ে বলে; ইয়ে হালাত মে কালেমা পাড়না জায়েজ নেহি, ইস আওরাতকো যারা ছা নাহাকে পাক ছাপ কারকে লাইয়ে। দিপালির তখন গোসল তো দূরের কথা, মুখে একমগ পানি তোলারও শক্তি নাই। মুকুলের কাঁধে হাত রেখে টলতে টলতে কোনোমতে বারান্দায় পা দিতেই সে ঢলে পড়ে জ্ঞান হারায়। অনেক পানির ছিটা দিয়েও তার জ্ঞান ফেরানো যায়নি। এই বেকায়দা অবস্থায় পড়ে রামদাস অনেকটা সাহস নিয়ে করজোরে মাওলানাকে বলে; ছাওয়া দুইটাক মারি ফালাইছে, বেটিটার কী আবস্থা করিছে তা তো দেখিছেন, হামার কারোরো সারাদিন খানাপিনা নাই। এই আবস্থাত কাইল কলেমা পড়িলে হয় না মাওলানা সাব? এ কথার পর সাল্লান কিছু একটা বলতে গলা খাকারি দিলে মাওলানা তাকে হাতের ইশারায় থামিয়ে বলে; কই বাত নাই, আজ তোম লোগ আরাম কারো, কাল সামকে বাদ আয়েঙ্গে, আজ জো হোনে কা থা ও কাল হোগা। খোদা হাফেজ।  মাওলানা উঠে দাঁড়িয়ে ডানে ঘুরতেই তুলসি গাছটি নজরে পড়লে; গাছটির দিকে আঙুল তুলে বলে; ইয়ে সাব ইস ঘারমে নাহি থাকনা চাইয়ে। মাওলানার কথা শেষ হতে না হতেই দুজন বিহারি তরুণ এক হেচকা টানে গাছটি সমূলে উৎপাটিত করে বাইরে ফেলে দিয়ে আসে। এই তুলসি গাছের উৎপাটনের মধ্য দিয়ে শেষ হয় ধর্মান্তরের প্রাথমিক পর্ব। এরপর ক্রমে ক্রমে পুরা উঠান খালি হয়ে যায়। শুধু শোকে শরিক হওয়ার জন্য বাঙালি প্রতিবেশীদের কয়েকজন থেকে যান। এরপর শুরু হয় ক্রন্দন পর্ব। যে পর্বের সমাপ্তির জন্য রামদাসদের ডিসেম্বর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়।

পরদিন সন্ধ্যায় ১৫-২০ জনের বিশাল এক দল নিয়ে হাজির হয় আন্ধা মাওলানা। নেকি হাসিলের জন্য কয়েকজন সাথে করে লাড্ডু, আমিত্তি, পরোটা ও কাবাব নিয়ে আসে। খবর পেয়ে নেক্কার কাজে শরিক হওয়ার জন্য মহল্লার হোটেলওয়ালা শরফুদ্দিন মোনাজাতের তবারকের জন্য দুই শের  গরম জিলাপি পাঠিয়ে দেয়। আনসার মহাজন কর্মচারি দিয়ে পাঠিয়ে দেয় ২ সের চিনি, ৫ সের ময়দা, ১ সের সেমাই ও ১ সের শুকনা খেজুর। রামদাসের আঙ্গিনা জুড়ে এক উৎসরমুখর পরিবেশ। অবস্থা দেখে বোঝার উপায় নাই যে দুদিন আগে এই আঙ্গিনা ছিল একটি বধ্যভূমি। গনিমতের মাল হিসেবে এ ঘরের এক নারী হায়েনাদের থাবায় হয়েছিল ক্ষতবিক্ষত। সেসব ক্ষত নিয়ে বারান্দায় মাদুুরের উপর বসে থাকে রামদাস ও পরিবারের লোকজন। এরই মধ্যে পুরুষ স্বেচ্ছাসেবকরা ছেলেদের নয়া পায়জামা-পাঞ্জাবি পরিয়ে মাথায় টুপি চড়িয়ে শরীরে আতর ছিটিয়ে, চোখে সুরমা লাগিয়ে দেয়। মেয়ে স্বেচ্ছাসেবকরা গঙ্গারানি ও দিপালিকে নতুন সেলোয়ার কামিজ পরিয়ে শরীরে বোরকা চাপিয়ে দেয়। সকলকে কলতলায় নিয়ে অজু করিয়ে আনে। এরপর শুরু হয় আনুষ্ঠানিকতা। শুরুতেই গঙ্গারানির সিঁথির সিধুর, হাতের শাঁখা ও ঘরের দেব-দেবির মূর্তিগুলো অপসারণ করা হয়েছে কিনা, জানতে চাইলে; বিহারি প্রতিবেশী রোকশানা বেগম বিগলিত কণ্ঠে বলে; সিন্দুর পোছা গিয়া, আউর হাতকা কাংকান ভি তোড়া হুয়া, ঘারকা পুতলা ভি বাহারমে ফেক দিয়া। এরপর আন্ধা মাওলানা মৃত্যুর পর মুসলমানরা জান্নাতে কী কী পাবে, তার একটা ফিরিস্তি দেন, এ জন্য যে চারটা ফরজ পালন করতে হবে, সে সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত ওয়াজ করেন। এরপর প্রত্যেকের নতুন নাম দেয়া হয়। রামদাসের নাম দেয়া হয় রমজান আলী, গঙ্গারানির নাম দেয়া হয় রাবেয়া বেগম, মুকুল দাসের নাম দেয়া হয় আব্দুল মজিদ, গকুল দাসের নাম দেয়া হয় আব্দুল গালিব পরিশেষে দিপালির দিকে একচোখ দিয়ে তাকিয়ে মাওলানা বলে; আজ সে ইয়ে খুবসুরাত লাড়কি কা নাম হোগা দিলরূবা বেগম। নামের পর্ব শেষে তার সাথে সাথে কলেমা বলতে বলে তিনবার কলেমা পড়েন মাওলানা। কলেমা পড়া হলে সবাইকে মোনাজাত ধরতে বলে মোনাজাত শুরু করেন। দীর্ঘক্ষণের মোনাজাতে নও মুসলিমদের কল্যাণ কামনাসহ পাকিস্তানকে হেফাজতের ওপর বেশ জোর দেয়া হয়। এরপর শুরু হয় তবারক বিতরণ এবং কোলাকুলি পর্ব। বিদায়ের আগ দিয়ে আন্ধা মাওলানা মুখে পান পুরতে পুরতে বলেন; আউর এক কাম অধুরা রাহ গিয়া, ইন লোগোকা খাতনা করানা জরুরি হ্যায়, কাল কই ইন লোগোকো লে কার রেলওয়ে হসপিটালসে খাতনা কারাকে লানা। হত্যা, পাশবিকতা ও ধর্মান্তরের কোপানলে পড়ে রামদাস ও গঙ্গারানি ভেতরে ভেতরে ভীষণ শোকাহত ও বিষণœ হলেও নির্বাক বসে থাকে। সাল্লানের দিকে চোখ পড়লে দিপালির ইচ্ছে করে পশুটা মুখে একদলা থুতু নিক্ষেপ করতে। বাস্তবে তার কিছুই করার থাকে না। পরদিন যথারীতি রামচন্দ্রসহ দুই পুত্রকে খৎনা করিয়ে আনা হয়। মুসলমান হওয়ার পর থেকে শত শোকের মধ্যেও তারা নিজেদের নিরাপদ ভাবতে থাকে। রামদাস টুপি পরেই ডিউটি করতে থাকে। নও মুসলিম হিসেবে অনেকে সমীহও করে। ফোরম্যান বেশ মিঠা ভাষায় কথা বলে। এভাবে কয়েকদিন যাওয়ার পর অকস্মাৎ এক রাতে রাইফেল কাঁধে নিয়ে চারজন বিহারি মিলিশিয়া হাজির হয় কোয়ার্টারে। এদের মধ্যে আরমান পূর্ব পরিচিত, সে থাকে পাশের কসাই পট্টিতে। দরোজা থাপড়ানোর শব্দ শুনে রামদাসই দরোজা খুলে দেয়। তারপর তারা জানায়; মেজর সাহাব নে দিল রূবাকো ক্যাম্প মে যানে কো বলা। কথা শুনে রামদাসের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। এ নিয়ে কথা বলে কোনো ফায়দা হয় না। এক পর্যায়ে তারা অনেকটা জোর করেই দিল রূবাকে নিয়ে যায়। চিল্লা-চিল্লি শুনে আশপাশ থেকে অনেকে ছুটে এলেও মেজরের কথা শুনে সবাই চুপসে যায়। রেলওয়ের অফিসার্স ক্লাবে মিলিটারি অফিসাররা ক্যাম্প করে থাকে। এর একটি কক্ষ ব্যবহার করা হয় নির্যাতন কক্ষ হিসেবে। অপর একটি কক্ষে নারীদের রেখে ইচ্ছেমাফিক পাশবিক চাহিদা মেটায় হানাদার সেনারা। মেজর বেগ বিকালে হাতিবান্ধা ফ্রন্ট পরিদর্শন করতে গিয়েছিল। কিন্তু তার পরিদর্শন সুখকর হয়নি। মুক্তিফৌজরা সেখানকার কলেজ ক্যাম্পে আচানক হামলা চালালে পাকিস্তানিরা কামান দাগাতে শুরু করে। এ অবস্থায় মুক্তিফৌজের সাপোর্টে ভারতীয় আর্টিলারি ফায়ার শুরু হলে ডজন খানেক পাকসেনার সেখানেই মৃত্যু হয়, অতঃপর তারা ক্যাম্প ছেড়ে পিছু হটতে বাধ্য হয়। আর মাত্র ১০ ফিট সামনে থাকলেই মেজর বেগের জীবন খালাস হয়ে যেত। যুদ্ধ থামার পর রাগে-দুঃখে-অপমানে ভারতীয় আর্টিলারি সেনাদের মালাউল বলে গাল দিতে দিতে ট্রেন ধরে সে সদর ক্যাম্পে চলে আসে। ভেতরের রাগ প্রশমিত করতে এক বোতল কেরুর হুইসকি  খেয়ে বেসামাল হলেও ক্ষোভ প্রশমিত হয়নি। এরপর ভারতীয় সেনা বিরোধী ক্ষোভ উগরে দেয়ার জন্য চার বিহারি মিলিশিয়াকে ডেকে বলে; জাহাসে মিলে মুঝে মালাউন লাড়কি চাইয়ে।

কিন্তু হিন্দুরা সব শহর ছেয়ে চলে যাওয়ায় বেশ মুশকিলে পড়ে মিলিশিয়াগুলো। এর মধ্যে একজন দাঁত কেলিয়ে বলে বসে; স্যার টাউন ছে সাব মালাউন ভাগ গিয়া, এঁহা তো মালাউন মিলনা বহুত মুশকিল হ্যায়। এ কথা শুনেই মেজর দাঁত কামড়াতে কামড়াতে তার গালে কষে একখান ওজনদার থাপ্পর বসিয়ে বলে; বায়েনচোত তুমকা জো বলা ওহি কারো, ইয়া নাইতো গোলিছে ওড়া দোউঙ্গা। এরপর আরমানের পরামর্শে তারা হাজির হয় দিপালি তথা দিলরূবাদের কোয়ার্টারে। মেজর ডাকা মানে মেয়েটিকে তারা নির্যাতন চালিয়ে শেষ করে দিবে। একথা ভাবতে ভাবতে গাল বেয়ে জল গড়িয়ে পড়তে থাকে রামদাসের। পরদিন সকালে গিয়ে হাজির হয় বিহারি নেতা কামরুদ্দিনের বাড়িতে। নয়া মুসলমান হিসেবে তাকে দেখেই খুশিতে আটখানা হয়ে ওঠে কামরুদ্দিন। এরপর সবকথা শুনে হাসতে হাসতে বলে; ডারো মাত, মেজরকো বোল দেঙ্গে, উসকো মারেগা নাহি, চলে আয়গা। এসব সান্ত্বনা দিয়ে তাকে বিদায় করে দেয়। রামদাস বলতে চেয়েছিল; নির্যাতনই যদি চালাবে, তাহলে ধর্মত্যাগ করে কী লাভ হলো? কথাটা জিবের গোড়ার আসলেও বলতে পারেনি রামদাস। হতাশ হয়ে ফিরে আসে বাসায়। সাতদিন বাদে বিধ্বস্ত অবস্থায় ফিরে এলেও দিপালির মুক্তি মেলেনি। কয়দিন পরপরই মেজরের ডাক আসতে থাকে। অনেকের দুয়ারে ধর্ণা দিয়েও মেয়ের জন্য কিছুই করতে পারে না রামদাস। শান্তি কমিটির বাঙালি দালাল রমিজ মেম্বারও কিছুই করতে পারেনি। উল্টো বলেছিল; এত হা হুতাশ করতেছেন ক্যান? মাইরাতো ফালায় নাই।

এভাবে বুকে পাথর চাপা দিয়ে দিন গুজরানের সময় একরাতে রামদাস স্বপ্নে দেখে; মা দুর্গা দশ হাতে দশটি খড়গ নিয়ে অসুর নিধন করতে করতে মিলিটারি ক্যাম্পে গিয়ে সব অসুরকে বধ করছে। এরপর দিপালিকে তার সাথে ঘোড়ার পিঠে বসিয়ে তাদের কোয়ার্টারের দিকে আসতেছে। ভোরের দিকে দেখা স্বপ্নটা রামদাসকে প্রবলভাবে উদ্দীপিত  করে। তাকে একজন নাগা সাধু বলেছিল; ভোরের দিকে দেখা স্বপ্ন সবসময় সত্যি হয়। সকালে রুটি খাওয়ার সময় আবেগ সামাল দিতে না পেরে স্বপ্নটার কথা স্ত্রীকে বললে; গঙ্গারানি হতাশ কণ্ঠে বলে; তা কি করিয়া হইবে দিপালির বাপ, হামরা তো এলা আর হেন্দু নই, হামরা এলা মোসলমান, হামাক বাঁচাবার জন্যি মা দুর্গা কোন্ দুক্কে আসপে?

নোট: বাস্তবতার নিরিখে গল্পটি লেখা হয়েছে। স্বাধীনতার পর ব্রাহ্মণদের প্রচুর দক্ষিণা দিয়ে একটি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে নিজ ধর্মে প্রত্যাবর্তন করলেও হিন্দু সমাজ তাদের গ্রহণ করেনি। দুর্গা পূজার মণ্ডপ থেকে রামদাসকে অপমান করে বের করে দেয়। অতঃপর স্বাধীনতার অনতিকাল পরেই নশ্বর পৃথিবীর যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে একরাশ অভিমান নিয়ে রামদাস স্বর্গের পথে যাত্রা করেন।  

Link copied!