• ঢাকা
  • শনিবার, ২৭ জুলাই, ২০২৪, ১২ শ্রাবণ ১৪৩১, ২০ মুহররম ১৪৪৫

আমাদের একজন হুমায়ুন ফরীদি ছিলেন


হাসান শাওন
প্রকাশিত: মে ২৮, ২০২৩, ০৯:২৯ এএম
আমাদের একজন হুমায়ুন ফরীদি ছিলেন

শিল্পের নামে অখাদ্য, দূষণ আর ক্ষমতাতোষণের দেশে আমাদের একজন হুমায়ুন ফরীদি ছিলেন। অভিনয়ই করতেন তিনি। এর বাইরে কিছু নন। আমৃত্যু বাঁচতে চেয়েছেন অভিনয়কে ধারণ করে। সম্ভবও করেছেন তা। আবার পারেননি অনেক কিছু।

২৯ মে তার জন্মদিন। মাত্র ৫৯ বছর বয়সে নশ্বর জীবন থেকে অনন্তলোকে এখন তিনি। আমরা ইতোমধ্যে অতিক্রম করেছি হুমায়ুন ফরীদিহীন ১১টি বছর। তার শূন্যতা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন প্রকৃত শিল্পবোধসম্পন্নরা। অন্যদের কাছে ফরীদির দরকার নেই। তারা মেতে থাকতে পারেন শক্তিমান অভিনেতার বোহেমিয়ান জীবনের গসিপ নিয়ে।

অভিনয় দিয়ে নিজেকে উজাড় করা ফরীদির এ পথে হাঁটা কৈশোরে। ১৯৬৫ সালে বাবার চাকরির সুবাদে ছিলেন মাদারীপুর। এই মাদারীপুর থেকেই নাট্যজগতে প্রবেশ। তার নাট্যাঙ্গনের গুরু তখন বাশার মাহমুদ। তার নির্দেশনায় শিল্পী নাট্যগোষ্ঠী নামে একটি সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হন কিশোর ফরীদি। কল্যাণ মিত্রের ‘ত্রিরত্ন’ নাটকে ‘রত্ন’ চরিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে তার প্রথম দর্শকদের সামনে আত্মপ্রকাশ।

১৯৬৮ সালে আবার স্থান বদল। বাবার চাকরির কারণে চাঁদপুরে ফরীদি। উচ্চমাধ্যমিকে ভর্তি হন চাঁদপুর সরকারি কলেজে। পরীক্ষায় কৃতিত্ব অর্জন করে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জৈব-রসায়ন বিভাগে ভর্তি হন। তখন আসে যুদ্ধের ডাক। ক্যারিয়ারের চিন্তা বাদ মাথা থেকে। পড়া অসমাপ্ত রেখে হুমায়ুন ফরীদি ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। কিন্তু বিজয়ের পর ঢাকামুখী হন না। ফিরে এসে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন অর্থনীতি বিভাগে।

১৯৭৬ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত নাট্য উৎসবের অন্যতম সংগঠক ছিলেন হুমায়ুন ফরীদি। তিনি নাট্যাঙ্গনে পরিচিত হয়ে ওঠেন। জাহাঙ্গীরনগরে ছাত্রাবস্থাতেই তিনি ঢাকা থিয়েটারের সদস্যপদ লাভ করেন।

অভিনেতা ফরীদির যাত্রা এরপর ঊর্ধ্বমুখী। ১৯৮৪ সালে তিনি তানভীর মোকাম্মেলের স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘হুলিয়া’য় অভিনয় করেন। পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রে তিনি পা রাখেন ১৯৮৫ সালে শেখ নিয়ামত আলীর ‘দহন’ ছবি দিয়ে। আশির দশকের শেষ দিকে ফরীদি বিটিভি অধ্যুষিত বাংলার ঘরে ঘরে। বিখ্যাত সংশপ্তক নাটকে ‘কানকাটা রমজান’কে ভুলে থাকার সাধ্য নেই কারও।

হুমায়ুন ফরীদি বারবার বলে গেছেন, “অভিনয় ছাড়া আর কিছুই পারি না।” এ দেশে মঞ্চে টাকা নেই। গুণী নির্মাতাদের ছবির সংখ্যা হাতে গোনা। তা-ও কম বাজেটের। কীভাবে তখন অভিনয় দিয়ে বাঁচবেন একজন? ফরীদিকে তখন বেছে নিতে হয় জনপ্রিয় ধারার, মূল স্রোতের অর্থাৎ এফডিসিতে নির্মিত চলচ্চিত্র। নিজের অভিনয় দিয়ে সিনেমা বদলের স্বপ্ন ছিল তার। ইন্ডাস্ট্রিতে অপ্রতিদ্বন্দ্বী খলনায়ক হয়ে ওঠেন তিনি। অভূতপূর্ব সময় তৈরি করেন একক ফরীদি। নায়িকা নয়, নায়ক নন, খলনায়ক হুমায়ূন ফরীদির অভিনয়ের দাপটে সিনেমা হল ভরে যেত। হয়তো নাক উঁচুদের পছন্দ হয় না এ যাত্রা। কিন্তু ফরীদি ঠিকই অভিনয় দিয়ে হৃদয় জয় করেছেন কোটি মানুষের। অর্জন করেছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। জীবিত গুণীর সম্মানহীন দেশে ভূষিত হয়েছেন মরণোত্তর একুশে পদকে।

সব বিচারে শিল্প আঙিনায় হুমায়ুন ফরীদিকে মনে হয় একাকী সংশপ্তক। একাই জীবনজুড়ে শিল্পের আঙিনায় অভিনয় দিয়ে তাকে লড়তে হয়। মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় ভাঙিয়ে দেশের বিরাজমান সংস্কৃতি জগতের পাণ্ডা হওয়ার কোনো বাসনা তার ছিল না। হয়তো আবৃত্তি নিয়ে হতে পারতেন আরও যত্নবান। আর্থিকভাবে সামর্থ্যবান হওয়ার পর হয়তো মঞ্চে নিয়মিত হতে পারতেন। কিন্তু এর সবই হয়তোর আলাপ। ভীষণ টিমওয়ার্ক-শূন্যতায় অভিনেতার একক কিছু করার থাকে না। স্পষ্টভাষী ফরীদি তাই চলেছেন নিজের ইচ্ছায়, নিজের জীবনে। সে জীবন নিয়ে প্রশ্ন থাকতে পারে অনেকের। কিন্তু শক্তিমান অভিনেতার সীমাবদ্ধতার দিকও উপেক্ষা করলে চলে না।

Link copied!