• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫

শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা বাবা


মাহবুব সাঈদ মামুন
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১৮, ২০২২, ০৪:০০ পিএম
শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা বাবা

আজ আমাদের বাবা সাঈদ আলীর ৩২তম মৃত্যু দিবস। ১৯৯০ সালে ১৮ সেপ্টেম্বর তার মৃত্যু হয়। মাত্র ৫৩ বছর বেঁচেছিলেন। কত স্বপ্ন না ছিল তাঁর।

স্বপ্ন ছিল ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া করে বিদ্বান হবে, আত্মীয়স্বজন, পাড়া-পড়শিদের সঙ্গে সুখ-দুঃখের সাথী হবে, সমাজ ও দেশের মানুষের তরে মানুষের সহযোগী হবে, কারও ক্ষতির কারণ হবে না। পরস্পরের প্রতি আন্তরিক ও শ্রদ্ধাশীল হবে।

স্বপ্ন ছিল বৃদ্ধ বয়সে নাতি-নাতনিদের সঙ্গে বসে নিজের জীবনের গল্প বলা, মানুষের সভ্যতার ইতিহাস বলা, গান, নাটক, শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতি নিয়ে গল্প করার।

স্বপ্ন ছিল দেশের গরিব মেহনতি মানুষের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির পথ রচনা করার।

স্বপ্ন ছিল একটি শোষণহীন সমাজ গঠনের, যেখানে শ্রেণির অবসান হবে। যার জন্য সরাসরি কলেজের শিক্ষকতার পাশাপাশি বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন ষাট থেকে আশির দশকে।

স্বপ্ন ছিল জীবনের শেষ বয়সে এসে নিজের বসতভিটায় ঘর বানিয়ে থাকার। সেখানে বইয়ের লাইব্রেরি করার। শত শত বইয়ের তাকভর্তি বইয়ের জগৎ করার। সেখানে বসে জ্ঞানের অন্বেষা করার।

স্বপ্ন ছিল উপন্যাস লেখা। তার আগে ছোট ছোট গল্প লিখেছিলেন, কবিতা লিখেছিলেন। ডায়েরির পর ডায়েরি লিখেছেন। সবকিছু ছিন্নভিন্ন হয়ে কালের গর্ভে বিলীন হয়েছে। সযত্ন করে সেগুলো লালন করা যায়নি। কী লিখেছিলেন? হয়তো নিজের জীবনের করুণ, কষ্টের কাহিনি, হয়তো নিজের জীবনে দেখা মানুষের কষ্ট আর যাতনার কাহিনি, হয়তো নিজের জীবনের বা আশপাশে মানুষের প্রেম- প্রীতি, ভালোবাসার কাহিনি।

হঠাৎই সব স্বপ্নের অবসান হলো। একটি ক্ষুদ্র জীবনের বৃহৎ বটগাছের মহীরুহের মতো জীবনের পরিসমাপ্তি হলো। লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত হন তিনি। আক্রান্তের তিন-চার মাসের মাথায় তার জীবন অবসান হয়।

১৯৯০ সালের মাঝামাঝি সময়ে বাবা বুকের আর পেটের ব্যথায় অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে মাঝরাতে কুমিল্লা সদর হাসপাতালে ভর্তি হন। তার কলেজের শিক্ষক, প্রাক্তন ছাত্ররা আর পাড়া-পড়শিরা মিলে তাকে হাসপাতালে নিয়ে আসেন। ওই সময়ে তিনি কলেজের শিক্ষক কোয়ার্টারে থাকতেন।

এর বছরখানেক আগে সাঈদ আলী পয়ালগাছা ডিগ্রি কলেজে আবারও প্রিন্সিপাল পদে আসীন হন। এলাকার স্থানীয় বাসিন্দারা জোর-আবদার খাটিয়ে তাকে আবারও কলেজের অধ্যক্ষ পদে আসীন করেন। তার আগে তিনি বরুড়া শহীদ স্মৃতি কলেজ, বরুড়া মহিলা কলেজ এবং চাঁদপুর পুরানবাজার কলেজে অধ্যক্ষ পদে আসীন ছিলেন।

তিনি পয়ালগাছা ডিগ্রি কলেজের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ ছিলেন। ১৯৬৮ সালে এই কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। এই কলেজ তৎকালীন বরুড়া থানার অন্তর্ভুক্ত ছিল। থানার অবস্থান অনুযায়ী পয়ালগাছা ডিগ্রি কলেজ কুমিল্লা-চাঁদপুর রোডের কাছাকাছি একটুখানি ভেতরে।

খাঁজুরিয়া বাসস্টেশনে নেমে কলেজে যাওয়ার পথে রাস্তার দুই দিকে সবুজ গাছগাছালিতে ঘেরা আর ধানক্ষেতে ধান বা শর্ষে ফুলের সমারোহ। সাঈদ আলীর বাড়ি, জগৎপুর মিজিবাড়ি, আমাদের বসতভিটাও কুমিল্লা-চাঁদপুর রোডের একেবারেই কাছাকাছি, প্রায় এটাকে ডিঙিই পয়ালগাছা ডিগ্রি কলেজ বা আজকের পয়ালগাছা বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে  যেতে হয়।

সময় তরতর করে চলে যায়। কারও জন্য সময় বসে থাকে না। আসলে কি তাই? মনে হয় না। আসল সত্য হলো মানুষ ‘সময়’ নামের শব্দটাকে নিজেদের জীবনে বেঁধে দিয়েছে। কারণ জন্ম থেকে মৃত্যুর যে কাল, তা নির্ণয় করার জন্য।

সাঈদ আলী স্ত্রী, তিন মেয়ে এবং চার ছেলে রেখে যান। স্ত্রী অহিদা খাতুন, আমাদের মা ২০২০ সালের ৩১ মে প্রয়াত হন।

আজ এই দিনে সাঈদ আলীর যেসব স্বপ্ন ছিল, তা যদি তাঁর বংশধরেরা পূরণ করে, তাহলে সাঈদ আলীর জীবন কানায় কানায় বাস্তবে পূর্ণতা লাভ করবে।

বাবার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা থাকল।


স্টকহোম, সুইডেন

Link copied!