• ঢাকা
  • শনিবার, ০৪ মে, ২০২৪, ২২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৫ শাওয়াল ১৪৪৫

কী সুন্দর এক গানের পাখি ছিলেন শাহনাজ রহমতউল্লাহ!


আরাফাত শান্ত
প্রকাশিত: মার্চ ২৩, ২০২৩, ০৩:৪৪ পিএম
কী সুন্দর এক গানের পাখি ছিলেন শাহনাজ রহমতউল্লাহ!

শাহনাজ রহমতউল্লাহকে তার মা কৈশোরে খালি সারেগামাপা রেয়াজ করাতেন। রেয়াজ না করলে খাওয়া বন্ধ। এখন এ রকম হলে বলা হতো বাজে পেরেন্টিং। নিজেদের স্বপ্ন সন্তানদের ওপর চাপিয়ে দেয়। ভাগ্যিস চাপিয়ে দিয়েছিলেন। খেলাঘরে তিনি আর সাবিনা ইয়াসমীন একসঙ্গে গান শেখা ও গান গাইতেন নানা অনুষ্ঠানে। ‘দোল দোল দুলুনি’ তাদের জন্যই আবদুল লতিফ সাহেব তৈরি করেছিলেন। তখন মধ্যবিত্ত বাঙালি দিশেহারা ছিল না, বুঝতেন গানবাজনা ধর্মের শত্রু না। শেষের দিকে শাহনাজ রহমতউল্লাহ যখন ওমরাহ করে গান ছাড়ার ঘোষণা দিয়েছেন, তখনো তিনি বলে গেছেন, মনপ্রাণ দিয়ে গান শিখতে, তরুণদের আরও উদ্যমী হতে, কণ্ঠকে ধারালো করতে। তিনি যদি এখনকার লোকজনের ইসলামবিষয়ক যে আইডিয়া তা মানলে বলতেন, গানবাজনা শিখো না। নিজের চিন্তা বাদ দিয়ে অন্যকে বেহেশতে পাঠানোই এখনকার বাঙালি মুসলমানদের মূলমন্ত্র।

যে আলাপে ছিলাম, শাহনাজ রহমতউল্লাহ। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর শাহনাজ রহমতউল্লাহকে নিষিদ্ধ করা হয়। তিনি তার মাকে নিয়ে করাতি ছিলেন—এটাই অপরাধ। যিনি কোরাসে গেয়েছেন ‘জয় বাংলা’, ‘সোনা সোনা সোনা লোকে বলে সোনা’। তাকে বানানো হলো দালাল। তিনি হলেন ব্রাত্য। খান আতা সাহসী প্রতিভাবান মানুষ, তাকে নিয়ে গেলেন এফডিসি। দেশে ফিরেই তিনি গাইলেন, ‘এক নদী রক্ত পেরিয়ে’। শাহনাজ রহমতউল্লাহ পাকিস্তানেও বড় শিল্পী। পারিবারিকভাবেই ওনাদের উর্দু ভালো। নব্বইয়ে পাকিস্তানের এক কেব্‌ল টিভি জরিপ করেছিল, তাতে পাকিস্তানের জনপ্রিয় দেশাত্মবোধক গানের প্রথম ও তৃতীয় তার গাওয়া দুটো গান। আবার বাংলা গানেও বিবিসির শ্রোতা জরিপে জনপ্রিয় তার গানই গোটা তিনেক। এসব অর্জন আসমান থেকে আসেনি। একটা বারো বছরের মেয়ে আলতাফ মাহমুদের মতো কিংবদন্তির সঙ্গে রোমান্টিক গান গাচ্ছে, আলতাফ মাহমুদ বারবার ঠিক করে দিচ্ছেন কোথায় কী এক্সপ্রেশন হবে। এসব কম ব্যাপার না। বিখ্যাত সুরকার রবীন ঘোষ তাকে বাংলাদেশের সেরা কণ্ঠ ভাবতেন এমনি এমনি না। তবে তিনি সব সময়ই সাবিনা, ফেরদৌসী রহমানদের গ্রেটনেসকে স্বীকার করেন। অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে মনে করতেন সব সুরকার গীতিকারকে। আলাউদ্দিন আলীর সঙ্গে সবচেয়ে কম কাজ করেছেন তিনি, অথচ আলাউদ্দীন আলীর মেধা ও সুরকে কি উঁচুভাবে মূল্যায়ন করে গেছেন আজীবন। লিজেন্ড মেহেদী হাসানের কাছে কিছুদিন গজল শিখেছেন, এটাও জানলাম সেদিন। অন্য শিল্পী হলে এক মেহেদী হাসানের নামই বারবার বলে চলতেন।

মাত্র দশ মিনিটে খান আতা তাকে শিখিয়েছেন, ‘তোমার আগুনে পোড়ানো এ দুটি চোখে’। কী অনবদ্য এক গান। আবদুল আহাদের সুরে গেয়েছেন, ‘আমি তো আমার গল্প বলেছি।’ সত্য সাহার সুরে গেয়েছেন, ‘আমি সাত সাগরের ওপার হতে।’ ‘তুমি কি সেই তুমি নেই’, শাহনাজ রহমতউল্লাহর কালজয়ী গান আরেকটা। সুরকার শাহ্ নেওয়াজের প্রথম গানের গীতিকার সুব্রত সেন গুপ্ত। রোমান্টিক ধাঁচের গানের জন্য গীতিকার সুব্রত সেন গুপ্ত বিশেষ জনপ্রিয় ছিলেন। বিটিভির বিশেষ একক সংগীতানুষ্ঠানে শাহনাজ রহমতউল্লাহর গানটি প্রথম গেয়েছেন ১৯৮১ সালে। পরে ড. নাশিদ কামাল (১৯৮৯) সুরকার শাহ্ নেওয়াজের সুরে একটি একক গানের লং প্লে বের করেন। ‘তুমি কি সেই তুমি নেই’ যেখানে এই গানটি তিনি গেয়েছিলেন। বিটিভির শাহীদা আরবীর প্রযোজনায় ‘কথা ও সুর’ (১৯৯২) একজন সুরকারের চারটি নতুন এবং চারটি পুরোনো গান নিয়ে পরিকল্পনা করা হয়েছিল। রওশানারা মুস্তাফিজ, রফিকুল আলম ও মলয় কুমার গাঙ্গুলির সঙ্গে আরেকজন শিল্পী ছিলেন সুরকারের খুবই পছন্দের কণ্ঠশিল্পী, সামিনা চৌধুরী। সামিনা সেই অনুষ্ঠানেই আবার গান, ‘তুমি কি সেই তুমি নেই’!

রাজা হোসেন খানের সুর ও মুকুল চৌধুরীর লেখা, ‘খোলা জানালায় চেয়ে দেখি’ এখন সবাই গায়। আমি চাই যারা শুনে তারাই শুনুক, অত লোকের দরকার নেই। তিনি নিজেও খুব বেশি গান গাইতে চাননি। সিনেমার গান তো একদম কম গেয়েছেন। হাজার হাজার গান গেয়ে বাজার দখলের চিন্তা তার কখনোই ছিল না। তার দেশের গান থাকবে যত দিন থাকবে এই বাংলাদেশ। ‘একবার যেতে দেনা’ গানের যে আবেগ তা চিরকালীন। কিন্তু শাহনাজ রহমতউল্লাহ যেকোনো গানই এত শ্রুতিময়, মনে হয় প্রথমবার শুনছি।

রুনা লায়লার একটা বই পড়েছিলাম। সেখানে তিনি এমনভাবে বলছেন, তিনি দেশের বড় শিল্পী। সাবিনা ইয়াসমীন শাহনাজ রহমতউল্লাহ তার কলিগ আর কি, রুনার মতো বড় হতে পারে নাই তেমন। এসব আমার বিরক্ত লাগে। সাবিনা ও শাহনাজ কখনোই নিজেদের দেশের প্রধান শিল্পী দাবি করেননি। রুনা লায়লা এ দাবিটা করে বসেন। শাহনাজ রহমতউল্লাহকে পাকিস্তান সরকার খেতাব দিতে চেয়েছিল, উনি সম্মানের সঙ্গে তা প্রত্যাখ্যান করেছেন। তার জন্ম মৃত্যুর খবর খুবই গুরুত্ব নিয়ে দেখানো হয় পাকিস্তানের চ্যানেলে। আওয়ামী লীগের প্রথম আমলে তিনি নিষেধাজ্ঞায় ছিলেন বিটিভিতে। প্রচুর শো করেছেন দেশে বিদেশে নানান জায়গায়। ওসব গল্প তিনি করতেন না মোটেও। নিজে ছাদ বাগান ও সংসার নিয়ে ছিলেন নিজের মতো। তিনি বাংলাদেশের গানের হৃদয়। যে গাইতে পারে, ‘জীবনের সংগীতে ছিঁড়ে যেন গেছে তার, যত তার সুর বাঁধি গান তো আসে না আর।’ মৃত্যুবার্ষিকীতে তাকে স্মরণ করি বিনম্র শ্রদ্ধায়; ভালোবাসা জানাই অন্তর থেকে।

Link copied!