মু্ক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বর্তমান বাংলাদেশকে বুঝতে হলে আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলকেই আদর্শ মান হিসেবে ধরা যায়। ‘কিশোর মুক্তিযোদ্ধা’ কথাটা আমরা কত সহজে বলি, কিন্তু কিশোর মুক্তিযোদ্ধা হওয়া কতটা অসাধারণ ব্যাপার তা অনুভব করি না। বাড়ির অনুমতি না নিয়ে, পালিয়ে, একটা ছেলে চলে যাচ্ছে। সে কোনোদিন ফিরবে কিনা তাই সে জানে না। তাও সে দেশকে শত্রুমুক্ত করতে রাতের আঁধারে এক অজানা জগতে মিলিয়ে যাচ্ছে। ঢাকায় জেলে ছিলেন, প্রতিদিন লোক নিচ্ছে আর তারা খুন হয়ে যাচ্ছে পাইকারি হারে। ইমতিয়াজ বুলবুল যে মুক্তিযোদ্ধা এ পরিচয় অনেকে জানতেন না। সাবিনা ইয়াসমিন দেখে বলেছিলেন, ‘আপনি তরুণ প্রেম ভালোবাসার গান লিখবেন।’ তিনি নাকি হেসে বলেছিলেন, ‘দেশও তো আমার প্রেমিকা, গান লিখতে তো বাধা নাই।’
প্রথম সিনেমায় কাজ করার সময় প্রযোজক ভরসা রাখতে পারেননি। ধারণা করতেন, পারবেন কিনা শিউর না। টাকাগুলোই হয়তো জলে যাবে। সত্য সাহা আর আলাউদ্দিন আলীকে পাওয়া যায়নি বলেই ওনার দ্বারস্থ। তিনি অনেকদিন গিটার বাজিয়েছেন সিনেমার বিভিন্ন গানের স্টুডিও রেকর্ডিংয়ে, বিটিভিতে, রেডিওতে। তারপর তো তাঁর গানই ভরসা, বাংলা সিনেমার জন্য। অজস্র ভালো গান, বাজে গান, এভারেজ গান তিনি সিনেমায় সুর করেছেন। দুটো জাতীয় চলচ্চিত্র পুরষ্কার পেয়েছেন। তিনশর ওপর সিনেমায় গান করেছেন।
অবশ্য সব চেয়ে বড় অর্জন তার সিনেমার গানে না, দেশের গানে। এখানেও সাবিনা ইয়াসমিন, সাবিনা ইয়াসমিন খুবই ব্যস্ত। একদিন সকালে পেলেন সময়, শোনালেন সুর। সাবিনা ইয়ামিন অবাক হলেন, এতটুকু মানুষ, কী সুর। সাবিনা ইয়াসমিন বললেন, ‘স্টুডিও আর সংগীত আয়োজন পারবেন ম্যানেজ করতে। আমি ক্যাসেট কোম্পানিকে বলে দেব, আজকালের ভেতরেই ওরা আলাপ করবে।’ ফোক ফোক একটা সুবাস তাঁর গানে। যাদের জন্য মূল ছবি তাদের পালসটা বুঝতেন। দীর্ঘদিন এফডিসির সিনেমা মানেই তাঁর গান। এত পপুলার সব গান তিনি কম্পোজ করেছেন, তা আজও মুখে মুখে।
আগে যেমন সিনেমায় ছিল টাকা, তেমন ছিল সময়। নব্বই দশকে আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল যখন কাজ করতেন ৭-৮ দিন বসে বসে একটা গানের প্রথম অংশ লিখতেন, সুর করতে আরও ১৫ দিন। প্রতিদিন হিরো হিরোইন আসতো, পরিচালক প্রযোজকরা আসতেন, গল্প হতো, আড্ডাই হতো বেশি। প্রতিদিনই নতুন সিনেমা নিয়ে লোকজনে মুখরিত অঞ্চল। সুরকার গীতিকারদের খুব সাবধান থাকতে হতো, যেন ভুলেও রিপিট না হয় আর যেন এক সিনেমার গান আরেক সিনেমায় না চলে যায়।
সাধারণ লোকজনের কাছে তিনি বিখ্যাত হন এরপর, গানের প্রতিযোগীতার বিচারক হয়ে। প্রতিযোগীদের সঙ্গে এত সুন্দর করে কথা বলতেন। এতকিছু ভালোই চলছিল। কিন্তু তিনি তো মুক্তিযোদ্ধা, চেতনা তাঁর অন্তরেই। তা সরকার আর ভুইফোঁড় লোকদের মতো বেচতে জানতেন না। গোলাম আজমের বিরুদ্ধে সাক্ষী দিলেন মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইবুনালে। জীবন হয়ে গেল নরক, বাসা থেকে বের হতেন না, কাজ কর্ম কমে গেল। ভাই শহীদ হলেন। অসুস্থ হয়ে পড়লেন। বিদেশে গিয়ে হয়তো থাকতে পারতেন, কিন্তু তিনি কোথাও যাননি। তিলে তিলে আজকের দিনের ২০১৯ সালে তিনি চলে গেলেন। সরকার গোলাম আজমকে দিলো হাজতবাস, তাঁর জীবন থেকে গেল নিরাপত্তাহীন।
অসাধারণ সব দেশের গান সুর করে, কিছু গান লিখেও, সাবিনা ইয়াসমিনকে দিয়ে গাইয়ে, দুইটা জেনারেশনকে মন মাতানো দেশের গান শুনিয়ে মুগ্ধ করার প্রাইজ হিসাবে আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল দুই নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে পাওয়া আওয়ামী লীগ আমলের আড়াই কাঠা জমি বিএনপি আমলে কেড়ে নেয়ে হয়েছিল। তিনিও অকাল প্রয়াত হওয়ার আগ পর্যন্ত ভয়ে ভয়ে চলতেন, সেই জমিও আর পাননি। সামিনা চৌধুরীকে দিয়ে তাই মজা করে গান গাইয়েছেন, আমি জায়গা কিনবো কিনবো করে, পেয়ে গেলাম জায়গাসহ বাড়ি। তাই দেশের গান শুনলে চোখে পানি আসে সত্য, মাঝেমধ্যে শরীর রি রি করা মেজাজ খারাপও হয়। তাও তিনি কিছুই চাইতেন না। বলতেন, এ স্বাধীন দেশ আমাকে যা দিয়েছে, যে ভালোবাসা পেয়েছি তাতেই চলবে। তিনি যেমন লিখেছেন সুর করেছেন, ‘সুন্দর সুবর্ণ তারুণ্য লাবন্যে’র মতো গান তেমনি আবার ‘ও মাঝি নাও ছাইড়া দে ও মাঝি পাল উড়াইয়া দে’। ‘আগামীতে পড়ে না চোখের পলক’ ধরনের গান হয়তো শুনবে কম কিন্তু বাংলাদেশটা যতদিন থাকবে ততদিন ‘সবকটা জানালা খুলে দাও না’ থাকবেই। আর আমরা যতদিন আছি কিভাবে ভুলবো—‘পৃথিবীর যত সুখ’, ‘তুমি মোর জীবনের ভাবনা’, ‘আমার বুকের মধ্যেখানে’, ‘আমার সারাদেহ খেয়ো গো মাটি’, ‘আর কত গান’।
আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলকে নিয়ে আরও কত কিছু লেখা যায়। তিনি একজন যোদ্ধা। জীবনজুড়ে যুদ্ধ করেছেন, আর সুরের ফুল ফুটিয়েছেন, গীতিকার হিসেবেও কত অসাধারণ। অনেকের ওয়েলকামটোনে এখনো বাজে, ‘আম্মাজান আম্মাজান’ সেই গানটাও তাঁর। মান্নার পুরো ক্যারিয়ার হয়তো একদিকে, আর আম্মাজান ছবিটা থাকবে আরেক দিকে। আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল, আপনাকে নিয়ে আমি বারবার লিখতে চাই।