• ঢাকা
  • সোমবার, ০৬ মে, ২০২৪, ২৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ শাওয়াল ১৪৪৫

কুবি শাখা ছাত্রলীগের শীর্ষ পদে আসতে দৌড়ঝাঁপ


কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি
প্রকাশিত: অক্টোবর ২৪, ২০২৩, ০৪:৪২ পিএম
কুবি শাখা ছাত্রলীগের শীর্ষ পদে আসতে দৌড়ঝাঁপ
ছবি: সংগৃহীত

কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় (কুবি) শাখা ছাত্রলীগের কর্মীসভা শেষে আসন্ন তৃতীয় কমিটির শীর্ষ পদে জায়গা পেতে চলছে নানা ধরণের দৌড়ঝাঁপ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কেউ ছুটছেন স্থানীয় আওয়ামীলীগের নেতৃবৃন্দের কাছে, কারো ভরসা কেন্দ্রীয় নেতাদের সুপারিশ। আলোচনায় আসছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পছন্দের প্রার্থী থাকা কিংবা অর্থের লেনদেনও।

তবে এসব আলোচনায় উপরের দিকে যেসব প্রার্থীর নাম থাকছে তাদের বেশিরভাগই বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা শেষ করেছেন অনেক আগে, কারো নামে আছে মামলা, কেউ কেউ শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে বিশ্ববিদ্যালয় ও ছাত্রলীগ থেকে বহিষ্কৃত হয়েছেন, কারো কারো বিয়ে হয়েছে, আবার কারো বিরুদ্ধে আছে চাঁদাবাজি, হুমকি, মারধর ও মাদক নেওয়ার অভিযোগ।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের আসন্ন কমিটিতে পদপ্রত্যাশীদের মধ্যে আলোচনায় আছেন রেজা-ই-এলাহী, স্বজন বরণ বিশ্বাস, ইকবাল হোসেন খান, মু. রকিবুল হাসান রকি, ইমরান হোসেন, এইচ এম মেহেদী হাসান, আবু সাদাৎ মো. সায়েম, মেজবাউল হক শান্ত, ইসরাত জাহান জেরিন, এনায়েত উল্লাহ, মোমিন শুভ, নাজমুল হাসান পলাশ, সালমান চৌধুরী প্রমুখ।

পদপ্রত্যাশীদের মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত নাম রেজা-ই-এলাহী। খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, রেজা-ই-এলাহী এর আগে ২০১৫ সালে গঠিত শাখা ছাত্রলীগের প্রথম কমিটিতে সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। রেজা-ই-এলাহী তখনই লোকপ্রশাসন বিভাগের শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী।
আসন্ন তৃতীয় কমিটিতে তিনি সভাপতি হতে চান। নিয়মিত শিক্ষার্থী হিসেবে পড়ালেখা শেষ অনেক আগেই। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইভেনিং কোর্সে ভর্তি আছেন তিনি। এসএসসি পরীক্ষার নম্বরপত্র অনুযায়ী বর্তমানে তার বয়স ৩১ বছর।

ছাত্রলীগ কর্মীদের অভিযোগ, ‘তিনি বয়স্ক এবং তার শিক্ষাজীবন শেষ হয়েছে অনেক আগেই। যা ছাত্রলীগের গঠনতন্ত্র পরিপন্থী।‍‍`

এই বয়সে আগামী কমিটিতে জায়গা পাওয়ার জন্য চেষ্টা নিয়ে রেজা-ই-এলাহীর মন্তব্য, “ছাত্রত্ব এবং বয়সের বিষয়টি কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ দেখবেন৷ এছাড়া বর্তমানে আমি ইভেনিং কোর্সে ভর্তি আছি।”

বয়সের ভার ছাড়াও রেজা-ই-এলাহীর নামে রয়েছে মামলা। কুবি ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক থাকাকালীন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র খালেদ সাইফুল্লাহকে গুলি করে হত্যা মামলার এজাহারে তার নাম রয়েছে। দীর্ঘ সময় পেরিয়ে গেলেও এই মামলার চার্জশিট এখনো হয়নি। এছাড়াও তার এলাকায় একটি ধর্ষণচেষ্টার মামলায় আসামির তালিকায় ছিলেন রেজা।  কিন্তু ২০২২ সালের ১ জুন সমঝোতার মাধ্যমে  মামলার আসামিদের খালাস দেয়া হয়।

মামলাগুলোর ব্যাপারে  রেজা-ই-এলাহী বলেন, মামলার এজাহারে যে অভিযোগ করা হচ্ছে সে মামলা শেষ হয়ে গেছে। যারা মামলা দিয়েছিলো তারা মামলা উঠিয়ে নিয়েছে। খালেদ সাইফুল্লাহ হত্যা মামলার যে অভিযোগ সেটাই আমি  তখন দায়িত্বে ছিলাম বলে আমাকে জড়ানো হয়েছিল।”

আরেক পদপ্রত্যাশী স্বজন বরণ বিশ্বাসও খালেদ সাইফুল্লাহ হত্যা মামলার এজাহারভুক্ত আসামী। এই মামলার জেরে তৎকালীন সময়ে ৫৫ দিন কারগারের ছিলেন। এছাড়া তিনি ২০১২-১৩ শিক্ষাবর্ষের বিশ্ববিদ্যালয়ের সপ্তম ব্যাচের শিক্ষার্থী। সেই হিসেবে তারও ছাত্রত্ব নেই। তাছাড়া, ২০১৮ সালের ১ মার্চ শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগ থেকে তাকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। ২০১৯ সালে এসে সেই বহিস্কারাদেশ উঠানো হয়।

এসব বিষয় মাথায় নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের শীর্ষ পদে আসতে চাওয়া নিয়ে তিনি বলেন,  ‍‍`রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে সেসময় আমাকে বহিষ্কার করেছিল তৎকালীন সভাপতি ইলিয়াস। কিন্তু পরবর্তী সময়ে ২০১৯ সালে এই বহিষ্কারের কোনো প্রমাণ না পেয়ে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ বহিষ্কারাদেশ তুলে দিয়েছিল। সাইফুল্লাহ আমার বন্ধু ছিলো, যারা সেসময় ছিল তারা রাজনৈতিক কারণে আমাকে সেখানে সংযুক্ত করেছে। আমি নির্দোষ হয়েও জেল খেটেছি।‍‍`

বর্তমান কমিটিতে পদপ্রত্যাশীদের মধ্যে আছেন আবু সাদাৎ মো. সায়েম। বিদায়ী কমিটির এই সাংগঠনিক সম্পাদকেরও ছাত্রত্ব নেই বলে অভিযোগ আছে। তবে তার দাবি, আমি এখনও মাস্টার্সের ভাইবা দেইনি।”

পদপ্রত্যাশী মোমিন শুভ’র ছাত্রত্ব থাকলেও ২০২০ সালের ১৬ মার্চ সংগঠনের নীতি-আদর্শ পরিপন্থি কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকা ও দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হল শাখা ছাত্রলীগের পদ থেকে তাকে অব্যাহতি দেওয়া হয় এবং বহিষ্কারের জন্য কেন্দ্রে সুপারিশ করা হয়।  এ ব্যাপারে তিনি বলেন, তখন আমাকে শত্রুতার জের ধরে মারধর করা হয় এবং বঙ্গবন্ধু হলের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক পদ থেকে অব্যহতি দেওয়া হয়।”

কুবি শাখা ছাত্রলীগের জন্য গুরুত্বপূর্ণ  শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত হল থেকে পদপ্রত্যাশীদের মধ্যে এগিয়ে আছেন হল শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এনায়েত উল্লাহ। তবে তার বিরুদ্ধেও মামলা রয়েছে। তিনিসহ আরো কয়েকজনের বিরুদ্ধে কসবা পশ্চিম ইউনিয়ন ছাত্রদলের তৎকালীন জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক সাদ্দাম হোসেনের ছবিসংবলিত ফেস্টুন ছিড়ে ফেলাকে কেন্দ্র করে মারামারির ঘটনায় একটি মামলা হয়। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল বডির দায়িত্ব পালনে বাঁধা, শিক্ষককে হেনস্তা এবং শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে চলতি বছরের ৭ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয় এনায়েত উল্লাহ ও আরেক পদপ্রত্যাশী সালমান চৌধুরীকে। পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সেই বহিস্কার আদেশ তুলে নেন।

এ বিষয়ে এনায়েত উল্লাহর সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, মামলাটি আগেই নিষ্পত্তি হয়েছে এবং নিষ্পত্তির প্রমাণস্বরূপ প্রতিবেদককে মামলার রিকলের কাগজ প্রদান করেন। যেখানে আসামিকে খালাস দেয়ার কথা উল্লেখ রয়েছে।”

এনায়েতের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় নানা কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মারধরের অভিযোগ রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী ছাড়াও স্থানীয় এক ডেকোরেটর ব্যবসায়ীকে মারধর করেও সংবাদের শিরোনাম হয়েছেন তিনি।

অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজী নজরুল ইসলাম হল থেকে হল শাখা ছাত্রলীগের বর্তমান সভাপতি নাজমুল হাসান পলাশও পদপ্রত্যাশী। খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে তিনি স্থানীয় আওয়ামীলীগ নেতাদের আশীর্বাদপুষ্ট। ছাত্রত্ব না থাকা বা সংগঠনের শৃঙ্খলা পরিপন্থী কোনো কাজের অভিযোগ না থাকলেও এনায়েত ও সালমান বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল বডিকে দায়িত্ব পালনে বাধা দেওয়ার ঘটনায় তিনিও ছিলেন। এছাড়া তৎকালীন বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ইলিয়াস হোসেন সবুজের সাথে মিলে সংবাদ প্রকাশের জেরে দুই সাংবাদিককে হুমকি দেওয়ার অভিযোগও আছে তার বিরুদ্ধে।

পলাশ বলেন,  সামনের কমিটিতে আসতে পারলে সময়োপযোগী ও সকলের সিদ্ধান্তকে প্রাধান্য দিয়ে রাজনীতি করব।”

একই হলের সাবেক সভাপতি ইমরান হোসাইনও পদপ্রত্যাশী। তবে তার বিরুদ্ধে নিজ দলের নেতাকর্মীরাই বিভিন্ন সময় শিবির সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ এনেছেন। শিবিরের কর্মীদের সাথে আনন্দ ভ্রমণে যাওয়ার ছবি প্রায়ই তারা সামাজিক মাধ্যমে আনেন। এছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশের কয়েকজন  ভবন মালিকের অভিযোগ, ভবন নির্মাণ করতে গেলে ইমরান চাঁদা চাইতো। চাঁদা না দিলে মারধর করতো।” এ নিয়ে একবার বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী হল নওয়াব ফয়জুন্নেছা হলের সামনের সিমেন্ট দোকানে সালিশও হয়েছে।
এসব ব্যাপারে তার কাছে জানতে চাইলে ইমরান নিজেকে একজন আওয়ামী পরিবারের সন্তান হিসেবে দাবি করেন। এছাড়া ২০১৯ সালে বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের নলছিটি উপজেলার সভাপতি মো. তছলিম  উদ্দিন চৌধুরী ও নলছিটি পৌর আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক জনারধন দাস স্বাক্ষরিত এক প্রত্যয়ন পত্র প্রতিবেদককে প্রদান করেন।

পদপ্রত্যাশী মু. রকিবুল হাসান রকি, এইচ এম মেহেদী হাসান, মো.ইকবাল হোসেন খানের নিয়মিত শিক্ষাকার্যক্রম শেষ অনেক আগেই। তারা বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ে ইভেনিং কোর্সে ভর্তি আছেন। তাদের প্রত্যেকের পরিবারই আওয়ামী সমর্থিত বলে তথ্য রয়েছে। মো. ইকবাল হোসেন খানের বাবা কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশনের ২৪ নং ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর। ‍‍`নৌকা‍‍` প্রতীক নিয়েই তিনি কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছিলেন। এছাড়া মু. রকিবুল ইসলাম রকির মা রেনু বেগম ফরিদপুর ইউনিয়ন পরিষদের ৭,৮,৯ নং ওয়ার্ডের সংরক্ষিত মহিলা সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এইচ এম মেহেদী হাসানের মামা মুক্তিযোদ্ধা  সামসুল আলম চুন্নু বাকেরগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও বাকেরগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

এদিকে পদপ্রত্যাশী ইসরাত জাহান জেরিন ও মেজবাউল হক শান্তের ছাত্রত্ব রয়েছে। তবে আলোচনা আছে তারা দুইজন বিয়ে করেছেন।  যা ছাত্রলীগের গঠনতন্ত্র বিরোধী। এ বিষয়ে ইসরাত জাহান জেরিন বলেন, বিয়ের সম্পর্কে যে কথা বলা হচ্ছে তা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। এই অভিযোগটা কে করছে, কেন করছে তা জানা নাই। মানুষ কেন আসলে এরকম উদ্ভট কথা ছড়ায় আমি জানি না। যে বা যারা এই সকল কথা ছড়াচ্ছে আমি তাদের উদ্দেশ্যে বলবো কাউকে নিয়ে হুটহাট, মনগড়া অভিযোগ না করে প্রমাণ থাকলে সেই প্রমাণ দেখাক নতুবা এভাবে গুজব ছড়িয়ে কাউকে ছোট করার চেষ্টা থেকে বিরত থাকুক।”

সার্বিক বিষয়ে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালি আসিফ ইনান বলেন, ‍‍`কে এগিয়ে আছে, কে পিছিয়ে আছে সেটা কমিটির সাথে সম্পৃক্ত কোনো বিষয় না। আমরা জীবনবৃত্তান্ত পেয়েছি এবং মামলার আসামী বা অছাত্র কিনা সেগুলা যাচাই-বাছাই করেই কমিটি দেওয়া হবে।‍‍`

উল্লেখ্য, ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর মাসের ৩০ তারিখ এক প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে ইলিয়াস-মাজেদ কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়। পরবর্তীতে একটি বেসরকারি টেলিভিশনের টকশোতে এসে আল নাহিয়ান খান জয় ইলিয়াস-মাজেদ কমিটি বহাল আছে বলে মন্তব্য করেন। এরপর ২০২২ সালের ৩১ অক্টোবর নতুন কমিটি গঠনের লক্ষ্যে কেন্দ্রীয় নেতারা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে পদপ্রত্যাশীদের জীবনবৃত্তান্ত সংগ্রহ করেন। পরবর্তীতে চলতি বছরের ৬ মার্চ বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদের এক জরুরি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়া, সাংগঠনিক নিষ্ক্রিয়তা, শৃংঙ্খলাহীনতা, গঠনতন্ত্র পরিপন্থী কার্যকলাপে সম্পৃক্ত থাকার কারণে, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের কমিটি (ইলিয়াস-মাজেদ) বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়েছিল। সর্বশেষ গত ৯ অক্টোবর কর্মীসভা করে আগামী কমিটির পদপ্রত্যাশীদের জীবনবৃত্তান্ত নেওয়া হয়।

Link copied!