• ঢাকা
  • রবিবার, ২৮ এপ্রিল, ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১, ১৮ শাওয়াল ১৪৪৫

নিজের পাতা ফাঁদেই আটকা পড়লেন সিভিল সার্জন


আশিক জামান, গোপালগঞ্জ
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১১, ২০২৩, ০৯:২৩ এএম
নিজের পাতা ফাঁদেই আটকা পড়লেন সিভিল সার্জন
সিভিল সার্জন ডা. নিয়াজ মোহাম্মদ

করোনা পরীক্ষার ২ কোটি ৬১ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেন গোপালগঞ্জের তৎকালীন জেলা সিভিল সার্জন। এরপর যখন বিষয়টি জানাজানি হয়, তখন নিজেকে বাঁচাতে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেন গোপালগঞ্জ থেকে সদ্য ওএসডি হওয়া সিভিল সার্জন ডা. নিয়াজ মোহাম্মদ। পাঁচ সদস্যের ওই তদন্ত কমিটির প্রধান ছিলেন ডা. নিয়াজ মোহাম্মদ নিজেই। তখন দায়সারা তদন্ত করে শুধু মেডিকেল টেকনোলজিস্টের (ল্যাব) ওপর দায় চাপিয়ে তদন্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়। 

দায়সারা তদন্ত প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে ল্যাব টেকনিশিয়ানের বিরুদ্ধে থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন ওই সিভিল সার্জন। এরপর সেই তদন্ত প্রতিবেদন ও জিডির কপি নিজেই জমা দেন খুলনার দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) বিভাগীয় কার্যালয়ে। পরবর্তী সময়ে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) বিষয়টি আমলে নিয়ে  ২০২১ সালের নভেম্বরে শুধু ল্যাব টেকনিশিয়ানের বিরুদ্ধে মামলা করেন। এরপর দুদকের দীর্ঘ তদন্তে বেরিয়ে আসে আসল রহস্য। নিজের পাতা ফাঁদেই আটকা পড়েন সিভিল সার্জন ডা. নিয়াজ মোহাম্মদ। হয়ে যান মামলার অভিযোগকারী থেকে আসামি। 

চলতি বছরের ২৭ জুলাই গোপালগঞ্জ থেকে সদ্য ওএসডি হওয়া সিভিল সার্জন ডা. নিয়াজ মোহাম্মদ  ও খুলনার সাবেক সিভিল সার্জন সুজাত আহমেদসহ ৬ জনের বিরুদ্ধে করোনা পরীক্ষার ফির ২ কোটি ৬১ লাখ টাকা আত্মসাতের মামলায় আদালতে চার্জশিট দাখিল করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

অভিযোগপত্রে বলা হয়, ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে ২০২০ সালের জুলাই থেকে ২০২১ সালের জুলাই পর্যন্ত করোনা পরীক্ষার ফি ২ কোটি ৬১ লাখ টাকা আত্মসাৎ করা হয়। এর মধ্যে ২০২০ সালে তৎকালীন সিভিল সার্জন সুজাত আহমেদের যোগসাজশে ৭৯ লাখ ও ২০২০ সালে ডা. নিয়াজ মোহাম্মদ এর যোগসাজশে ১ কোটি ৮২ লাখসহ মোট ২ কোটি ৬১ লাখ টাকা আত্মসাৎ করা হয়।

অভিযোগপত্রে আরও বলা হয়, খুলনা জেনারেল হাসপাতালের সরকারি রসিদ বইয়ের বাইরে ডুপ্লিকেট রসিদ বই ব্যবহার করে বিদেশগামী যাত্রী ও সাধারণ কোভিড-১৯ রোগীদের নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষার জন্য খুলনা মেডিকেল কলেজের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগে পাঠানো হতো।

তবে ল্যাবে যে পরিমাণ নমুনা পাঠানো হতো, তার থেকে রোগীর সংখ্যা কম দেখিয়ে টেস্টের ফির টাকা আত্মসাৎ করা হয়। ২০২০ সালের জুলাই থেকে ২০২১ সালের জুলাই পর্যন্ত মোট ফি আদায় করা হয়েছিল ৪ কোটি ২৯ লাখ ৯১ হাজার ১০০ টাকা। তবে সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়া হয়েছিল ১ কোটি ৬৮ লাখ ৪৬ হাজার ৭০০ টাকা। বাকি ২ কোটি ৬১ লাখ ৪৪ হাজার ৪০০ টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে।

এই মামলার বাকি আসামিরা হলেন খুলনা মেডিকেলের টেকনোলজিস্ট (ল্যাব) প্রকাশ কুমার দাস, মেডিকেল টেকনোলজিস্ট (ল্যাব) মো. রওশন আলী, ক্যাশিয়ার তপতী সরকার, আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. এস এম মুরাদ হোসেন।

রোববার  (১০ সেপ্টেম্বর)  কথা হয় এ মামলার বাদী ও তদন্তকারী কর্মকর্তা দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) খুলনার বিভাগীয় কার্যালয়ের উপপরিচালক খন্দকার কামরুজ্জামানের সঙ্গে। জানা যায়, কীভাবে মামলার অভিযোগকারী থেকে আসামি হলেন সিভিল সার্জন ডা. নিয়াজ মোহাম্মদ।

দুদকের তদন্তকারী কর্মকর্তা বলেন, ২০২০ সালের জুলাই থেকে ২০২১ সালের জুলাই পর্যন্ত প্রায় ১৩ মাস ধরে আসামিদের পরস্পর যোগসাজশে এই টাকা আত্মসাৎ করা হয়। ২০২০ সালের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ৫ মাস তৎকালীন সিভিল সার্জন সুজাত আহমদেরসহ বাকিরা প্রায় ৮২ লাখ  টাকা আত্মসাৎ করে। পরে সুজাত আহমদ বদলি হলে তার জায়গায় আসে তৎকালীন সিভিল সার্জন ও মামলার অপর প্রধান আসামি ডা. নিয়াজ মোহাম্মদ।

ডা. নিয়াজ মোহাম্মদ সিভিল সার্জন হয়ে যোগদানের পরও চলতে থাকে করোনা পরীক্ষার ফি আত্মসাৎ। তিনি জেনেশুনে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ না করে আত্মসাতে সহায়তা শুরু করেন।

বিদেশগামী যাত্রীদের কোভিড-১৯ এর নমুনা পরীক্ষার জন্য খুলনা মেডিকেল কলেজের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগে ফরওয়ার্ডিংয়ে নমুনার সংখ্যা লেখার জায়গা ফাঁকা রেখে তারিখবিহীন স্বাক্ষর করে। অন্যান্য আসামিদেরকে ফাঁকা জায়গায় নমুনার সংখ্যা ও তারিখ বসিয়ে ডুপ্লিকেট রশিদ বইয়ের মাধ্যমে সংগৃহীত নমুনা ল্যাবে পাঠানোর সুযোগ করে দিয়েছেন। পরবর্তী সময়ে রোগীর সংখ্যা কম দেখিয়ে সেই অনুযায়ী ইউজার ফির টাকা সরকারি কোষাগারে জমা প্রদান করে। অর্থাৎ প্রকৃত আদায়কৃত ইউজার ফির টাকা জমা প্রদান না করে আত্মসাৎ করেছেন।

ঘটনা জানাজানি হওয়ায় তড়িঘড়ি করে অধীনস্থ ডাক্তারদের সমন্বয়ে ৫ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেন। নিজে ওই কমিটির সভাপতি হয়ে প্রভাব বিস্তার করে তার ইচ্ছামতো তদন্ত সম্পন্ন করেন। ল্যাব ইনচার্জ প্রকাশ কুমার দাসের ঘাড়ে দায় চাপিয়ে তদন্ত প্রতিবেদন প্রস্তুতপূর্বক খুলনা  বিভাগীয় কার্যালয়ে লিখিত অভিযোগ করেন।

এরপর দীর্ঘ তদন্তে বেরিয়ে আসে তার অপকর্ম। আত্মসাৎকৃত ২ কোটি ৬১ লাখ ৪৪ হাজার টাকার মধ্যে তার কর্মকালীন সময়ে ১ কোটি ৮২ লাখ ৪৭ হাজার টাকা আত্মসাৎ করে দুদকের আইনে শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন।

এদিকে আদালতে চার্জশিট দাখিলের পর  অভিযুক্ত গোপালগঞ্জের সিভিল সার্জন ডা. নিয়াজ মোহাম্মদ উচ্চ আদালত থেকে দুই সপ্তাহের জামিন নেন। এরপর গত ৭ সেপ্টেম্বর খুলনার জেলা ও দায়রা জজ আদালতে উপস্থিত হয়ে স্থায়ী জামিনের আবেদন করেন। জামিনের  বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন দুদকের আইনজীবী খন্দকার মুজিবর রহমান।

দুদকের এই আইনজীবী বলেন, “গভর্মেন্ট সার্ভিস রুলস অনুযায়ী ডা. নিয়াজ মোহাম্মদকে সাময়িক বহিষ্কার না করে শুধু ওএসডি করায় সাধারণ মানুষকে আইনের নামে আইওয়াশ করা হয়েছে।”

Link copied!