• ঢাকা
  • শুক্রবার, ০৩ মে, ২০২৪, ১৯ বৈশাখ ১৪৩১, ২৩ শাওয়াল ১৪৪৫

যেভাবে জলদস্যুর কবলে কবির গ্রুপের জাহাজ


চট্টগ্রাম প্রতিনিধি
প্রকাশিত: মার্চ ১৩, ২০২৪, ০৫:৪৭ পিএম
যেভাবে জলদস্যুর কবলে কবির গ্রুপের জাহাজ
জাহাজে ২০-২৫ দিনের খাবার আছে। ছবি : সংগৃহীত

প্রায় এক মাস আগে ইরানি একটি ফিশিংবোট জিম্মি করেছিল সোমালিয়ার জলদস্যুরা। মাছ ধরার সেই জাহাজটি নিয়ে তারা ভারত মহাসাগরে চড়ে বেড়াচ্ছিল বড় জাহাজের সন্ধানে। এরই মধ্যে হাতের নাগালে পেয়ে যায় চট্টগ্রামের কবির গ্রুপের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান এসআর শিপিংয়ের এমভি আবদুল্লাহ নামের জাহাজটি। এখন সেটি সোমালিয়া উপকূলের দিকে নিয়ে যাচ্ছে তারা।

সোমালিয়ান জলদস্যুর হাতে জিম্মি বাংলাদেশি পতাকাবাহী জাহাজ এমভি আবদুল্লাহ থেকে গোপনে জাহাজ মালিকের কাছে প্রধান কর্মকর্তা আতিকুল্লাহ খানের পাঠানো এক অডিও বার্তা থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।

ওই অডিও থেকে জানা গেছে, একটা হাইস্পিড বোট নিয়ে তাদের জাহাজের দিকে আসতে থাকে জলদস্যুরা। জাহাজে উঠে জলদস্যুরা ক্যাপ্টেন ও সেকেন্ড অফিসারকে জিম্মি করে। এরপর আরেকটি স্পিডবোটে আসে আরও কয়েকজন। এভাবে মুহূর্তেই ১৫-২০ জন চলে আসে। এরপরই ইরানিয়ান ওই ফিশিং বোট নিয়ে অন্যান্য জলদস্যুরা আসে।

একমাস আগে জিম্মি করা ইরানিয়ান ফিশিংবোটের তেল শেষ হয়ে গিয়েছিল। ‘এমবি আবদুল্লাহ’ থেকে জাহাজে থাকা পাম্প দিয়ে কিছু ডিজেল নিয়ে ওই বোটে নেয় জলদস্যুরা। এরপর সবাই জাহাজে উঠে জিম্মি করা ইরানিয়ান ফিশিং বোটটিকে ছেড়ে দেয়।

জাহাজের প্রধান কর্মকর্তা আতিকুল্লাহ খান ওই অডিও বার্তায় জানিয়েছেন, জাহাজে ২০-২৫ দিনের খাবার আছে। পানি আছে ২০০ টনের মতো। পানি-খাবার শেষ হলে বিপদে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে সবার।

আতিকউল্লাহ খান অডিও বার্তায় বলেন, ‘আমাদের জাহাজে ২০–২৫ দিনের রসদ আছে। ২০০ টন বিশুদ্ধ পানি আছে। জাহাজে রয়েছে ৫৫ হাজার টন কয়লা।’ রসদ যাতে দ্রুত ফুরিয়ে না যায়, সে জন্য অপ্রয়োজনে ব্যবহার না করার জন্য সবাইকে জানানো হয়েছে।”

সোমালিয়ান জলদস্যুদের কবলে পড়া ‘এমভি আবদুল্লাহ’তে কিছু কোল্ড কার্গো আছে, যেগুলো ভয়ের কারণ বলে মনে করছেন জাহাজের প্রধান কর্মকর্তা আতিকুল্লাহ খান। অডিও বার্তায় তিনি এসব নিয়ে বিশেষজ্ঞের মতামত নেওয়ার অনুরোধ করেন।

আতিকুল্লাহ খান বলেন, “আমাদের জাহাজে কিছু কোল্ড কার্গো আছে। প্রায় ৫৫ হাজার টন। এগুলো একটু ডেঞ্জারাসও। ফায়ারেরও ঝুঁকি আছে। মিথেন বাড়ে। লাস্ট যখন অক্সিজেন মেপেছি তখন ৯-১০ শতাংশ লেভেল পেয়েছি। এটি নিয়মিত মনিটরিং করতে হয়। কোনো কারণে অক্সিজেন লেভেল বেড়ে গেলে বিশেষজ্ঞের মতামত নিতে হবে। এটার একটু ব্যবস্থা করবেন, স্যার।’

ওই জাহাজে মোট ২৩ জন নাবিক রয়েছেন। তাদের মধ্যে ১০ জন নাবিক চট্টগ্রামের নগর ও উপজেলার বাসিন্দা। জাহাজের মাস্টার মোহাম্মদ আবদুর রশিদ (৫৭)। তিনি নগরীর ডবলমুরিং থানাধীন গোসাইলডাঙ্গা এলাকার মো. আবদুল গনির ছেলে। প্রধান কর্মকর্তা মো. আতিক উল্লাহ খান (৩৮), তিনি চন্দনাইশ উপজেলার মো. নুরুল আলম খানের ছেলে। সেকেন্ড অফিসার মোজাহেরুল ইসলাম চৌধুরী (৩৫), তিনি সাতকানিয়া উপজেলার মো. নুরুল ইসলাম চৌধুরীর ছেলে।

জাহাজের ক্রু মো. আসিফ উর রহমান (২৪), মো. সাজ্জাদ হোসাইন (২৮) এবং মো. নুর উদ্দিন (২৮)। এর মধ্যে আসিফ উর রহমান চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলার মো. আকতার উদ্দিনের ছেলে, সাজ্জাদ হোসাইন চট্টগ্রামের কর্ণফুলী উপজেলার মো. গাজী মিয়ার ছেলে এবং নুর উদ্দিন চট্টগ্রামের কর্ণফুলী উপজেলার মোহাম্মদ আমিন শরীফের ছেলে।

গ্রিজার মোহাম্মদ সামসুদ্দিন (৩১) ও আইনুল হক। সামুদ্দিন চট্টগ্রামের কর্ণফুলী উপজেলার মোহাম্মদ আইয়ুব আলীর ছেলে এবং আইনুল হক মিরসরাইয়ের জোররগঞ্জ থানার সুজাউল হকের ছেলে। জাহাজের ফায়ারম্যান মোশাররফ হোসেন সাকিল (২৪) মিরসরাইয়ের জোরারগঞ্জ থানার মো. শামসুল হকের ছেলে। জাহাজের চিফ কুক মো. শফিকুল ইসলাম (৩৩), তিনি নগরের বন্দর থানার গোসাইলডাঙা এলাকার আবুল কাশেমের ছেলে।

বাকি ১৩ নাবিক দেশের বিভিন্ন জেলার। তারা হলেন থার্ড অফিসার মো. তারেকুল ইসলাম (২৮), তিনি ফরিদপুর জেলার মধুখালি থানার মো. দেলোয়ার হোসেনের ছেলে। ডেক ক্যাডেট মো. সাব্বির হোসাইন (২৪), তিনি টাঙ্গাইল জেলার নগরপুর থানার মো. হারুন অর রশিদের ছেলে। চিফ ইঞ্জিনিয়ার এ এস এম সাইদুজ্জামান (৪৫), তিনি নওগাঁ সদরের মো. আবদুল কাইয়ুমের ছেলে। সেকেন্ড ইঞ্জিনিয়ার মো. তৌফিকুল ইসলাম (৩৮), তিনি খুলনা জেলার সোনাডাঙ্গা উপজেলার মো. ইকবালের ছেলে। থার্ড ইঞ্জিনিয়ার রোকোন উদ্দিন (৩২), তিনি খুলনা জেলার সোনাডাঙ্গা উপজেলার মো. ইকবালের ছেলে। ফোর্থ ইঞ্জিনিয়ার তানভীর আহমেদ (২৯), তিনি ফেনী সদরের জাফর আহমেদের ছেলে। ইঞ্জিন ক্যাডেট আইয়ুব খান (২৩), তিনি লক্ষ্মীপুর জেলার রায়পুর থানার আজাহার মিয়ার ছেলে। ইলেক্ট্রিশিয়ান ইব্রাহিম খলিল উল্লাহ (৩৫), তিনি ফেনী জেলার দাগনভ‚ঞার আবুল হোসাইনের ছেলে।

এ ছাড়া জাহাজে ক্রুদের মধ্যে রয়েছেন মোহাম্মদ আনোয়ারুল হক (২৮), তিনি নোয়াখালী জেলার কোম্পানীগঞ্জ থানার মোহাম্মদ আজিজুল হকের ছেলে। জয় মাহামুদ (২৩), তিনি নাটোর জেলার বাগাতিপাড়া থানার মো. জিয়াউর রহমানের ছেলে। নাজমুল হক (২২), তিনি সিরাজগঞ্জ জেলার কামাড়–খান্দা থানার মো. আবু সামা শেখের ছেলে। জাহাজে গ্রিজারের মধ্যে রয়েছেন মো. আলী হোসাইন (৩৫), তিনি বরিশাল জেলার বানারিপাড়া থানার মো. ইমাম হোসাইনের ছেলে। জাহাজের ফিল্টারম্যান মোহাম্মদ সালেহ আহমেদ (৪৭), তিনি নোয়াখালী জেলার চাটখিল থানার মো. সাখায়েত উল্লাহর ছেলে।

মঙ্গলবার (১২ মার্চ) বিকেলে জাহাজের আরেকজন নাবিক অডিও বার্তায় জানিয়েছিলেন, জাহাজটি সোমালিয়ায় নেওয়া হচ্ছে। ৬০০ নটিক্যাল মাইল যেতে তিনদিন লাগবে। সেখানে জলদস্যু প্রধানরা আসবে।

এমভি আবদুল্লাহ জাহাজটি এসআর শিপিংয়ের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হচ্ছিল। আফ্রিকার দেশ মোজাম্বিক থেকে দুবাই আসছিল পণ্যবাহী জাহাজটি। মালিকপক্ষ জিম্মি ঘটনার সতত্য নিশ্চিত করে নাবিকদের ছাড়িয়ে আনার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন বলে জানিয়েছেন।

এদিকে টাকা না দিলে এক এক করে সবাইকে মেরে ফেলা হবে বলে স্ত্রীর কাছে অডিও বার্তায় জানিয়েছেন জাহাজ এমভি আবদুল্লাহর প্রধান কর্মকর্তা মো. আতিক উল্লাহ খান। মঙ্গলবার (১২ মার্চ) ইফতারের পর আতিক উল্লাহ তার স্ত্রীর কাছে অডিও বার্তাটি পাঠিয়েছেন।

অডিও বার্তায় আতিক বলেছেন, “এই বার্তাটা সবাইকে পৌঁছে দিয়ো। আমাদের কাছ থেকে মোবাইল নিয়ে নিচ্ছে। ফাইনাল কথা হচ্ছে, এখানে যদি টাকা না দেয়, আমাদের একজন একজন করে মেরে ফেলতে বলেছে। তাঁদের যত তাড়াতাড়ি টাকা দেবে, তত তাড়াতাড়ি ছাড়বে বলেছে। এই বার্তাটা সবদিকে পৌঁছে দিয়ো।”

Link copied!