• ঢাকা
  • সোমবার, ২৯ এপ্রিল, ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫
কাতার বিশ্বকাপ

‘এই নশ্বর জীবনের মানে শুধু তোমাকে চাওয়া’


সৌরভ কুমার দাস
প্রকাশিত: ডিসেম্বর ১৯, ২০২২, ০৪:১৩ এএম
‘এই নশ্বর জীবনের মানে শুধু তোমাকে চাওয়া’
ছবি: গেটি ইমেজস

‘অমরত্বের প্রত্যাশা নেই নেই কোন দাবি দাওয়া, এই নশ্বর জীবনের মানে শুধু তোমাকে চাওয়া’ ভারতীয় সঙ্গীতশিল্পী কবীর সুমনের এই ‘তুমি’ বাকি সবার কাছে হয়তো নিজের প্রেমিকা, তবে আর্জেন্টাইন ফুটবল যাদুকর লিওনেল মেসির কাছে এই তুমিটা নিশ্চিতভাবেই বিশ্বকাপের ওই সোনালি ট্রফিটা।

আসরের সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার হাতে নিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন, একটু থেমে গেলেন বিশ্বকাপ ট্রফিরা পাশ দিয়ে যাওয়ার সময়। প্রথমে একটু নিবিড় মনোযোগে তাকালেন ট্রফিটার দিকে, এরপর গভীর চুম্বন এঁকে দিলেন ট্রফিটার গায়ে। একটু ঝুঁকি নিয়েই বলে দেই, যখন তাকিয়ে ছিলেন তখন মেসির মনে অন্য ভাষায় হয়তো কবীর সুমনের  গানটাই বাজছিল।

মন্টিয়েল তখন জয়সূচক গোল, নাহ ভুল হচ্ছে! বিশ্বকাপ জয়সূচক গোলটা করলেন রেফারি বাঁশি দিয়ে জানিয়ে দিলেন বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয়েছে আর্জেন্টিনা। সঙ্গে সঙ্গে যেন দৌড় দিতে চাইলেন মেসি, কিন্তু পারলেন না।

বসে পড়লেন যেখানে ছিলেন সেখানেই, তাকে জড়িয়ে ধরেছেন লিওনার্দো পারদেস। মেসি কাঁদছেন, কেঁদেই চলেছেন। কেঁদেছেন তো ২০১৪ বিশ্বকাপের ফাইনালেও। তবে সেদিন ছিল দুঃখের অশ্রু, আর আজ? আজ তো এই অশ্রু স্বপ্ন পূরণের, এই অশ্রু শতজনম সাধণার পর, হাজারো যুদ্ধ জয়ের পর যেন প্রেমিকাকে একান্ত নিজের করে পাওয়ার অশ্রু।

বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ার। কতশত রেকর্ড, শিরোপা তার নামের পাশে। অথচ প্রতিদিন সেই একই অভিযোগ, বিশ্বকাপ তো জিততে পারেননি। নামের পাশে ইতিহাসের সর্বোচ্চ সাতটি ব্যালন ডি’অর, জাতীয় দল আর ক্লাব মিলিয়ে ৩৫টি শিরোপা, বার্সেলোনার হয়ে ক্লাব সর্বোচ্চ ৬৭২টি গোল। মেসির শুধু রেকর্ড নিয়ে লিখলেও কয়েক দিস্তা কাগজ শেষ হয়ে যাবে, রাতের অন্ধকার শেষে ভোরের আলো বের হয়ে সূর্যমামাও হয়তো উঁকি দিয়ে দেবে।

সর্বকালের সেরা ফুটবলার হওয়ার দৌড়ে ধারেকাছে কেউ নেই। তবুও বিশ্বকাপ না জিতলে নিন্দুকেরা মেনে নিচ্ছিলেন না। আচ্ছা, এখন তারা কী বলবে? অধরা বিশ্বকাপও তো জেতা হয়ে গেলো মেসির। আচ্ছা ছাড়ুন ওদের কথা, আজ শুধু মেসি, আজ শুধু এক ফুটবলের মহাতারকার পরম আরাধ্য স্বাদ পাওয়ার গল্প হোক।

ক্যারিয়ার জুড়ে বড় অভিযোগ ছিল, জাতীয় দলের হয়ে মেসিকে স্বরূপে দেখা যায় না, জাতীয় দলের হয়ে শিরোপা জিততে পারেন না। সবকিছুর জবাব দিতে পারতেন ২০১৪ বিশ্বকাপের ফাইনালে। কিন্তু মারাকানায় সেদিন ফুটবল বিধাতা তাকে খালি হাতেই ফিরিয়ে দিয়েছিল।

শুধু সেবার নয়, এরপর কোপা আমেরিকাতে টানা দুইবার ফাইনালে উঠেও শিরোপা অধরাই থেকে গেলো। একবার তো রাগে, ক্ষোভে, দুঃখে, অভিমানে অবসরই নিয়ে নিলেন। পরে পুরো পৃথিবীর অনুরোধে ফিরে এসেছিলেন।

আচ্ছা যদি সেদিন না ফিরতেন? কী হতো তাহলে! না, আজ আর কি হতো বা কী হতে পারতো ওসব নিয়ে আলোচনা নয় আজ বরং যায় হয়েছে সেটাই নিয়ে গল্প হোক।

২০২১ সালে কোপা আমেরিকাতে সেই অভিশপ্ত মারাকানাতেই ব্রাজিলকে হারিয়ে কোপা আমেরিকার শিরোপা জিতলেন। যারা এতদিন বলছিলেন জাতীয় দলের হয়ে শিরোপা নেই, ও কেন গ্রেট হবে? সেই তারাই এবার বলা শুরু করলেন বিশ্বকাপ না জিতলে তাকে সর্বকালের সেরার তকমা দেওয়া যাবে না।

এবার শুরু হলো সেই বিশ্বকাপ জয়ের মিশন। টানা ৩৬ ম্যাচে জয়ের পর বিশ্বকাপ খেলতে কাতারে পা রেখেছিল আর্জেন্টিনা। বিশ্বকাপে প্রথম ম্যাচ জিতলে অপরাজিত থাকার বিশ্বরেকর্ড হবে, এমন ম্যাচেই কিনা সৌদি আরবের মতো দলের বিপক্ষেই হেরে বসলো আর্জেন্টিনা।

নিন্দুকেরা খোঁচা মারা শুরু করলেন, গ্রুপ পর্বেই নকআউট পর্ব শুরু হয়ে গেছে আর্জেন্টিনা। অবশ্য পরিস্থিতিটা লিওনেল মেসিদের জন্য সেরকমই ছিল।

বাঁচা মরার লড়াইয়ে মেক্সিকোর বিপক্ষে প্রথমার্ধ যতটা সম্ভব বাজে খেললো আর্জেন্টিনা। দ্বিতীয়ার্ধে এক জাদুকরি মুহূর্ত তৈরি করে গোল করলেন মেসি। সেই যে শুরু এরপর যেন লিখিত চিত্রনাট্য মঞ্চায়ন হওয়া শুরু হলো।

একে একে পোল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া বাধা পার হয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে সবচেয়ে বড় পরীক্ষায় পড়লো আর্জেন্টিনা। দুই গোল করে এগিয়ে থেকে শেষ মুহূর্তে দুই গোলই হজম করে ম্যাচ গড়ালো টাইব্রেকারে। গোলরক্ষক এমিলিয়ানো মার্টিনেজের দৃঢ়তায় সে বাধাও পার হয়ে গেলো মেসির দল।

সেমিফাইনালেই যেন সবচেয়ে সহজ ম্যাচটাই খেললো আর্জেন্টিনা। ক্রোয়েশিয়াকে উড়িয়ে ফাইনাল নিশ্চিত করে মেসিরা।

এবারের কাতার বিশ্বকাপ মেসিকে দুহাত ভরে দিয়েছে। এই বিশ্বকাপেই একমাত্র আর্জেন্টাইন ফুটবলার হিসেবে চারটি বিশ্বকাপে গোল করার রেকর্ড গড়েছেন। এই বিশ্বকাপেই আর্জেন্টিনার জার্সিতে সর্বোচ্চ গোলদাতা হয়েছেন, একমাত্র ফুটবলার হিসেবে পাঁচ বিশ্বকাপে অ্যাসিস্ট করেছেন। বিশ্বকাপের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি ম্যাচ খেলার রেকর্ডেও ভাগ বসিয়েছেন।

তবু এগুলোর কি আসলেই কোনো মূল্য ছিল মেসির কাছে, তিনি যে কাতারে গিয়েছিলেন বিশ্বকাপ জিততে, ব্যক্তিগত রেকর্ডে তাই মনোযোগ না থাকারই কথা। স্বপ্নের ফাইনালে তার হাত ধরেই লিড পেলো আর্জেন্টিনা। পেনাল্টি থেকে নিখুঁত শটে লক্ষ্যভেদ করলেন।

অ্যাঞ্জেল ডি মারিয়ার আরেক গোলে প্রথমার্ধেই ২-০ গোলে এগিয়ে আর্জেন্টিনা। তখন কি বিশ্বকাপের ট্রফির দিকে একটু-আধটু আড়চোখে তাকিয়েছিলেন মেসি? কে জানে হয়তো বা হয়তো না।

আর্জেন্টাইন সমর্থকরা মজা করে বলে থাকেন, আর্জেন্টিনা জিতলেও কাঁদতে হয়, হারলেও কাঁদতে হয়। এবারও সেটাই হলো তবে, শেষ পর্যন্ত চোখ থেকে অশ্রুটা আনন্দ হয়েই বের হয়েছে।

৮০ আর ৮১ মিনিটে জোড়া গোল করে ফ্রান্সকে ম্যাচে ফেরান কিলিয়ান এমবাপে। অতিরিক্ত ৩০ মিনিটের দ্বিতীয়ার্ধে আবারও ত্রাতা হয়ে আবির্ভাব মেসির, লিড এনে দেন আর্জেন্টিনাকে। তবে এবারও এমবাপে গোল করে আবারও সমতায় ফেরান ফ্রান্সকে।

তবে কি আবারও তীরে এসে তরী ঢুববে আর্জেন্টিনার? এবার অবশ্য ঢোবার কথাই ছিল না। স্বয়ং ঈশ্বরই হয়তো ফুটবলের সবচেয়ে বড় পূজারিকে আগুনে পুড়িয়ে খাঁটি করে তারপর প্রাপ্য বুঝিয়ে দিতে চাইছিলেন।

আর সেজন্যই এমিলিয়ানো মার্টিনেজকে দেবদূত করে পাঠিয়েছেন মেসির জন্য। কোপার মতো এখানেও মেসির স্বপ্ন পূরণ সবচেয়ে বড় ভূমিকা তারই। ১২৩তম মিনিটে যে সেভটা এমি করেছেন সেটাও আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ জয়ের অ্যালবামে টাঙিয়ে রাঙার মতোই।

এরপর টাইব্রেকারেও এমির দৃঢ়তায় শিকল ভেঙেছে আর্জেন্টিনার। ৩৬ বছর অর্থাৎ তিন যুগের শিরোপা খরা ঘুচিয়ে এখন বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন আর্জেন্টিনা, মেসির আর্জেন্টিনা।

আচ্ছা, ধরুন একজন রাজা তার রাজ্য চালাচ্ছেন দাপটের সঙ্গে কিন্তু তার মাথার রাজার সেই মুকুটটাই নেই। এমন হলে কেমন লাগে বলুন তো! লিওনেল মেসি যেন এতদিন সেই মুকুটহীন রাজা হয়েই রাজ্য চালাচ্ছিলেন। অবশেষে তার মাথায় এবার মুকুট উঠলো তবে।  

‘বলতে পারিনি তার যেটুকু যা ভাষা ছিল, কেঁপে ওঠা চোখের পাতায়। তারপর ভোরবেলা ডিঙিয়েছি চৌকাঠ ভয়ানক সতর্কতায়, এভাবেও ফিরে আসা যায়‍‍’— কলকাতর ব্যান্ড চন্দ্রবিন্দুর এই গানটা কাউকে উৎসর্গ করে লেখা হয়েছিল কিনা জানি না।

তবে এই গানটা লিওনেল মেসি নামক আর্জেন্টিনা এক ফুটবল যাদুকরের সাথেই বোধহয় সবচেয়ে ভালো যায়। সবচেয়ে ভালো বর্ণনা করা যায় মেসিকে।

Link copied!