• ঢাকা
  • সোমবার, ১৩ মে, ২০২৪, ৩০ বৈশাখ ১৪৩১, ৫ জ্বিলকদ ১৪৪৫
উৎপাদনে পিছিয়ে বাংলাদেশ

বৈশ্বিক উষ্ণতা কমাবে নবায়নযোগ্য জ্বালানি


সংবাদ প্রকাশ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: এপ্রিল ২৮, ২০২৪, ০৯:৫৮ পিএম
বৈশ্বিক উষ্ণতা কমাবে নবায়নযোগ্য জ্বালানি
নবায়নযোগ্য জ্বালানি। ছবি : সংগৃহীত

শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে জীবাশ্ম জ্বালানির ক্রমবর্ধমান ব্যবহারে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে বিপজ্জনক হারে বেড়ে গেছে গ্রিন হাউজ গ্যাস নিঃসরণ। এতে বৈশ্বিক উষ্ণতা বেড়েছে। ফলস্বরূপ বদলে যাচ্ছে জলবায়ু। পরিবর্তন ঘটছে প্রকৃতির স্বাভাবিক আচরণে। বিশ্বব্যাপী নানারূপে একের পর এক প্রাকৃতিক বিপর্যয় দেখা দিচ্ছে। এর মধ্যে অন্যতম দাবদাহ বা প্রবলমাত্রার তাপপ্রবাহ। যার শিকার হতে হচ্ছে সবচেয়ে ধনী দেশ থেকে শুরু করে গরীব দেশগুলোকে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিল্প বিপ্লবের শুরু থেকেই গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ বেড়ে গেছে। গত কয়েক শতকে যা বিপজ্জনক অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে। গেল শতক থেকে শুরু করে বর্তমান সময় অবধি গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ হ্রাস করার দাবি তুলেছে জাতিসংঘসহ ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো। তবে ধনী দেশগুলো যারা সবচেয়ে বেশি কার্বন তথা গ্রিনহাউজ নিঃসরণ করছে তারা দাবিগুলো উপেক্ষা করে চলেছে। ফলে বৈশ্বিক উষ্ণতা নিয়ন্ত্রণে আনার উদ্যোগ কোনোভাবে সফল হচ্ছে না।

বিজ্ঞানীদের মতে, জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমিয়ে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বাড়িয়ে গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ কমিয়ে আনা সম্ভব। এতে বৈশ্বিক উষ্ণতার লাগাম টানা যেতে পারে। বিশেষ করে যেসব ধনী দেশ গ্রিনহাউজ গ্যাস সবচেয়ে বেশি নিঃসরণ করছে, সেসব দেশকেই এগিয়ে আসতে হবে। জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার তাদের বন্ধ করতে হবে। বিপরীতে শতভাগ নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহার করতে হবে।

নবায়নযোগ্য জ্বালানিবিষয়ক বিশেষজ্ঞ স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক মার্ক জ্যাকবসনের ভাষ্য, “আমাদের কোনো অলৌকিক প্রযুক্তির দরকার নেই। শুধু প্রয়োজন বাতাস, সৌরশক্তি, ভূতাপীয় শক্তি, ছোট ও বৃহৎ জলবিদ্যুৎ দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে কার্বন নিঃসরণ বন্ধ করা। নবায়নযোগ্য শক্তি থেকে স্বল্পমেয়াদে শতভাগ বিদ্যুৎ উৎপাদন যে টেকসই, জার্মানির মতো দেশগুলো তা দেখিয়ে দিয়েছে।

সম্প্রতি বৈশ্বিক জলবায়ু সম্মেলনে যেসব তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে, তাতে দেখা গেছে, বায়ুমণ্ডলে কার্বন নিঃসরণের জন্য যেসব দেশ সবচেয়ে বেশি দায়ী, সেসব দেশ নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে সবার চেয়ে পিছিয়ে রয়েছে। অথচ কার্বন নিঃসরণে পিছিয়ে থেকেও বর্তমানে বিশ্বের সাতটি দেশ মোট বিদ্যুতের প্রায় শতভাগ নবায়নযোগ্য শক্তির উৎস থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে। দেশগুলো হলো, আলবেনিয়া, ভুটান, নেপাল, প্যারাগুয়ে, আইসল্যান্ড, ইথিওপিয়া ও কঙ্গো প্রজাতন্ত্র।

ইন্ডিপেন্ডেন্টের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, শতভাগ নবায়নযোগ্য শক্তির উৎস থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী দেশগুলো তাদের ব্যবহৃত ৯৯ দশমিক ৭ শতাংশ বিদ্যুৎই ভূ-তাপীয়, জল, সৌর অথবা বায়ুশক্তি থেকে উৎপাদন করেছে। 
গবেষকরা পূর্বাভাস দিয়েছেন, আগামীর দশকগুলোতে সৌরশক্তি বৈশ্বিক বিদ্যুৎ সরবরাহের প্রধান উৎস হয়ে উঠবে। গত কয়েক বছরে সৌরবিদ্যুতের দক্ষতায় উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। সৌরবিদ্যুতের বাণিজ্যিক খরচও কমে গেছে।

জানুয়ারিতে প্রকাশিত ইন্টারন্যাশনাল এনার্জি এজেন্সির (আইইএ) হিসাব অনুযায়ী, ২০২২ সালে যুক্তরাজ্য তাদের মোট বিদ্যুতের ৪১ দশমিক ৫ শতাংশ নবায়নযোগ্য উৎস থেকে উৎপাদন করেছে।

আইইএ ও আইআরইএনএ-এর (ইন্টারন্যাশনাল রিনিউয়েবল এনার্জি এজেন্সি) তথ্যানুসারে, ২০২১ ও ২০২২ সালে আরও ৪০টি দেশ তাদের ব্যবহৃত বিদ্যুতের অন্তত ৫০ শতাংশ নবায়নযোগ্য শক্তির প্রযুক্তির মাধ্যমে উৎপাদন করেছে। এর মধ্যে ইউরোপের দেশ ১১টি।

স্কটল্যান্ডে নবায়নযোগ্য শক্তির প্রযুক্তি থেকে ২০২২ সালে দেশটির মোট ব্যবহৃত বিদ্যুতের ১১৩ শতাংশ বিদ্যুতের সমান বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়েছে। 
স্কটিশ রিনিউয়েবলসের প্রধান নির্বাহী ক্লেয়ার ম্যাক বলেন, “নিট শূন্য নিঃসরণের পথে এই রেকর্ডভাঙা হিসাব একটি বড় মাইলফলক।”

ইউনিভার্সিটি অব এক্সিটার ও ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের বিজ্ঞানীরা গত বছর দাবি করেছেন, ২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্বে জ্বালানির প্রধান উৎস হয়ে উঠবে সৌরশক্তি।

তবে অর্থনীতির সব সূচকে এগিয়ে গেলেও নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে চোখে পড়ার মতো কোনো অগ্রগতি নেই বাংলাদেশে। এমনকি বিদ্যুৎ উৎপাদনে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারে দক্ষিণ এশিয়ায় অন্যতম প্রধান প্রতিবেশী পাকিস্তান ও ভারত থেকেও অনেক পিছিয়ে থাকছে বাংলাদেশ।

পরিসংখ্যান বলছে, ভারতে জলবিদ্যুৎ বাদে ৩ লাখ ৭৪ হাজার ১৯৯ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়। এর মধ্যে নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎস থেকে আসে প্রায় ৯০ হাজার ৩৯৯ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। যা মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতার ২৪ দশমিক ১৬ শতাংশ। একইভাবে পাকিস্তানে সৌর ও বায়ু বিদ্যুৎ বাদে মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ৩৭ হাজার ৪০২ মেগাওয়াট। এর মধ্যে নবায়নযোগ্য উৎস থেকে আসে এক হাজার ৮৭০ মেগাওয়াট। যা মোট উৎপাদনের ৫ শতাংশ।

বাংলাদেশে দেশে প্রচলিত উৎস থেকে মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে ২০ হাজার ৫৯৫ মেগাওয়াট। যার মধ্যে নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎস থেকে উৎপাদিত বিদ্যুতের পরিমাণ মাত্র ৭০০ দশমিক ৬১ মেগাওয়াট। যা মোট উৎপাদন ক্ষমতার মাত্র ৩ শতাংশ মাত্র। তুলনা করলে দেখা যায়, দ্রুত ও সম্প্রসারণশীল উন্নয়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ প্রতিবেশী ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে থাকলেও নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে অনেক দূরে থেকে যাচ্ছে।

তবে সম্প্রতি পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় থেকে আশ্বস্ত করা হয়েছে যে, বাংলাদেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ৪০ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রায় সরকার কাজ করছে।

মূলত, বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় বায়ুমণ্ডলে কার্বন নিঃসরণ রোধে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারে উৎসাহিত করা হচ্ছে। অনেক দেশ এক্ষেত্রে শতভাগ লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করেও ফেলেছে। শুধু পিছিয়ে থাকছে বাংলাদেশ।

জ্বালানি খাতের অংশীজনসহ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানির এমন খারাপ পরিস্থিতির জন্য দায়ী মূলত, নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে প্রতিশ্রুতির অভাব, জমির সংকট, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের অভাব এবং প্রচলিত জ্বালানির পক্ষে কঠোর আমলাতান্ত্রিক মানসিকতা।

জাতীয় বিভাগের আরো খবর

Link copied!