• ঢাকা
  • শনিবার, ১৮ মে, ২০২৪, ৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ৯ জ্বিলকদ ১৪৪৫

পায়রাবন্দের জ্যোতির্ময়ী বেগম রোকেয়া


অভিজিৎ সাহা
প্রকাশিত: ডিসেম্বর ৯, ২০২৩, ০৯:০১ এএম
পায়রাবন্দের জ্যোতির্ময়ী বেগম রোকেয়া

দিনের নিয়মের দিন আসে, দিন যায়। গভীর রাতের আঁধার চিরে সূর্য উঠে জানান দেয় নতুন দিনের। কোনো কোনো দিন ইতিহাসের পাতায় স্থির হয়ে যায়। তেমনি এক সকালের কথা দিয়ে শুরু করি আজকে। সেই সকাল প্রতিদিনের মতো হলেও ছিল একটু ভিন্ন। খানিক পুরনো দিনের সকাল হলেও সেই সকাল আদতেই ‘সকাল’ বয়ে এনেছিল বঙ্গবাসীর জীবনে। মানব তথা নারী মুক্তির মশাল হাতে এক কুয়াশা ঘেরা সকাল এবং বাংলায় মুক্তির উষ্ণ বার্তা নিয়ে ১৮৮০ সালের আজকের এই দিন, মানে ৯ ডিসেম্বর ব্রিটিশ শাসনাধীন বাংলার বর্তমান রংপুর জেলার পায়রাবন্দ গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম জমিদার পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন বেগম রোকেয়া। ডাক নাম রকু। বাবা জমিরউদ্দিন মোহাম্মদ আবু আলী হায়দার সাবের আর মা রাহাতুনেচ্ছা সবেরা। রাহাতুনেচ্ছা সবেরাও ছিলেন টাঙ্গাইলের নামকরা জমিদার পরিবারের সদস্য। রোকেয়ারা ছিলেন তিন ভাই, তিন বোন। এক ভাই শৈশবে মারা যান।

বেগম রোকেয়ারা যখন বড়ো হচ্ছেন তখন আমরা এক অবরুদ্ধ সমাজ পাই। সেইসময়ের মানুষেরা ছিলেন প্রাচীন বা মধ্যযুগীয় চিন্তার। আর প্রাচীন জমিদারবাড়ির অবস্থা তো আরও শোচনীয়। বিশেষ করে মুসলমান জমিদারবাড়িগুলোর অন্দর ছিলো শিক্ষার আলো বঞ্চিত, আর আঁধার কূপের মতো। এক আশ্চর্য অন্ধকার জগৎ। সেখানে ধর্মীয় গোঁড়ামি, কুসংস্কার, ভ্রান্ত ও অবৈজ্ঞানিক ধারণা নিয়ে তৈরি সব নিয়মকানুন ছিল অবশ্য পালনীয়। বিশেষ করে মেয়েদের জন্য ওইসব বাড়ির অন্দর ছিলো জেলখানার মতো। মেয়েদের হাসতে নিষেধ, খেলতে নিষেধ, নিষেধ জোরে কথা বলতে। সুতরাং সে অবস্থায় একটি শিশুর শৈশব এখন আমরা কল্পনা করতেই পারি কেমন হতে পরে। সমাজের মানুষ যেমন ছিল ব্রিটিশ নাগপাশ দ্বারা বদ্ধ, তেমনি ধর্মীয় শাসন ছিল চরমে। নারীরা ছিল শিক্ষা বর্জিত। বাড়ির বাইরে স্কুলে যাওয়া ছিলো ধর্মীয়ভাবে বর্জিত। পর্দা করার নিয়ম ছিল প্রচণ্ড  কড়া। তখন পারিবারিকভাবে কিছু উর্দু আর আরবি শিক্ষার ব্যবস্থা থাকলেও ছিল না বাংলা আর ইংরেজি শিক্ষার কোনো ব্যবস্থা। বেগম রোকেয়ার দুই ভাই কলকাতার বিখ্যাত সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে পড়াশুনা করতেন। রোকেয়ার অদম্য ইচ্ছাতে ভাই ইব্রাহিম সাবেরের কাছে থাকে ইংরেজি ভাষার শিক্ষা লাভ করেন। যখন সমগ্র মুসলিম নারী অবরুদ্ধ ধর্মীয় শিকলে, তখন সেই শিকল পরার ছলে নিভৃতে শিকল ভাঙার আয়োজন শুরু করেন তিনি।

সাল ১৮৯৬। শৈশব থেকে কৈশোর পার হতে না হতেই ষোল বছর বয়সে বিয়ে হয় বেগম রোকেয়ার। স্বামী সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেন, যিনি ছিলেন ভাগলপুরের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান। তবে তিনি ছিলেন নিজের চেষ্টায় গড়ে ওঠা এক উচ্চশিক্ষিত আদর্শবাদী মানুষ। নারীকে শিক্ষার মাধ্যমে বিকশিত করে এবং আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী করার মাধ্যমে নারী-পুরুষ সাম্যের এক সমাজ প্রতিষ্ঠাই ছিল বেগম রোকেয়ার লক্ষ্য। স্বামীর সামাজিক ও আর্থিক অবস্থান এবং নারীর অর্থনৈতিক মুক্তি সম্পর্কে মুক্ত দৃষ্টিভঙ্গি রোকেয়ার চিন্তা ও কাজের সহায়ক ছিল। স্বল্পস্থায়ী সংসার জীবনে তিনি পড়াশোনা ও সামাজিক মেলামেশার সুযোগ পেয়েছেন। তিনি দেখেছেন, সমাজে নারীরা কতটা নিগৃহীত। স্বামীর সহযোগিতায় রোকেয়া পাশ্চাত্য জীবনধারা, গণতন্ত্রের গতি-প্রকৃতি ও নারী সত্ত্বার বিকাশের নানা স্তর ও পথ নির্দেশনা পান। স্বামীর জীবদ্দশাতেই প্রকাশিত হয় তার প্রথম বই, যা ছিল ইংরেজিতে লেখা। সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেন তাকে বাংলা সাহিত্য চর্চায় উদ্বুদ্ধ করেন। কলকাতার অধ্যাপিকা, গবেষক ও রোকেয়া সাহিত্য সমগ্রের সম্পাদক ড. মীরাতুন নাহার বলেন বেগম, “রোকেয়া খুব সুন্দরী ছিলেন এবং তার বিয়ে হয়েছিল খুব কম বয়সে। তার স্বামী ছিলেন খুব উদার মনের মানুষ এবং খুবই শিক্ষিত ব্যক্তি। বেগম রোকেয়া কিছুটা উর্দু তো আগেই শিখেছিলেন। বিয়ের পর সেই শিক্ষা তার উর্দুভাষী স্বামীর সহায়তায় আরও প্রসার লাভ করল। এবং স্বামীর কাছ থেকে ইংরেজিতে খুব ভাল দক্ষতা অর্জন করলেন। সুন্দর ইংরেজি রচনা করতে পারতেন তিনি। তবে বাংলা ভাষার প্রতি তার ছিল গভীর টান। বাংলা তিনি ছাড়লেন না। বাংলাতেই তিনি লেখালেখি শুরু করলেন।”

রোকেয়ার সাহিত্যজীবন শুরু হয় ১৯০২ সালে ‘পিপাসা’ নামের একটি বাংলা গদ্য রচনার মধ্যে দিয়ে। সে যুগের অভিজাত শ্রেণির মুসলমানদের ভাষা ছিল উর্দু। কিন্তু রোকেয়া উপলব্ধি করেন যে, এ দেশের অধিকাংশ মুসলমানের ভাষা বাংলা। তাই বাংলা ভাষা ভালোভাবে আয়ত্ত করে এই ভাষাকেই বক্তব্য প্রকাশের বাহন হিসেবে ব্যবহার করেন। ১৯২৭ সালে বঙ্গীয় নারী শিক্ষা সম্মেলনে বেগম রোকেয়া বাংলা ভাষার পক্ষে জোরালো বক্তব্য রাখেন; যা সে যুগের পরিপ্রেক্ষিতে ছিল দুঃসাহসিক কাজ। তার লেখনীর প্রভাব আমাদের সমাজে আজও আছে। তিনি নারী শিক্ষা প্রসারে যে অনন্য অবদান রেখেছেন তা আজও বিস্ময় জাগায়।

অবরুদ্ধ সমাজে থেকে তিনি যেভাবে বৈশ্বিক নারী উন্নয়ন চিন্তা করেছেন তাতে এখনও গবেষকরা আশ্চর্য হয়ে যান। মূলত, চরম শৃঙ্খলিত সময়, সামাজিকীকরণ এবং অবরুদ্ধ ব্যবস্থাই তাকে মুক্তির দিকে ধাবিত করে। অবরুদ্ধ থেকেই তিনি বুঝেছিলেন, আত্মপ্রতিষ্ঠিত হলেই পরে নারী উন্নয়ন এবং নারী মুক্তি সম্ভব।

বর্তমানে ‘নারীর ক্ষমতায়ন’ বর্তমানে বহুল আলোচিত। কিন্তু বেগম রোকেয়া একশ বিশ বাইশ বছর আগে এই অবরুদ্ধ, শৃঙ্খলিত সমাজে নারীর অর্থনৈতিক, সামাজিক, শিক্ষা ও আত্মমর্যাদার অধিকার আদায়ে লিখে শুধু থেমে যাননি, স্কুল (সাখাওয়াত হোসেন মেমোরিয়াল স্কুল) প্রতিষ্ঠার জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। নিজের রচনা ও সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে নারী সমাজের মনে আর নয়নে রোকেয়া ফোটাতে চেয়েছেন জ্যোর্তিময় আলো।

এই আলোর কথাই আমরা শুনতে পাই রণেশ দাশগুপ্তের কলমে—আলো দিয়ে আলো জ্বালা’। তেমনি বেগম রোকেয়া নিজে আলোকিত হয়ে থেমে যাননি। আলোকিত করেছেন জগতকে তার কর্মের মধ্য দিয়ে।

রোকেয়া অনুভব করেছিলেন সমাজের উন্নয়ন তথা সামগ্রিক উন্নয়ন মানবিক মানুষ তৈরিতে নারীর শিক্ষা, অর্থনৈতিক তথা সামগ্রিক মূল্যায়নের কথা। তিনি ‘স্ত্রীজাতির অবনতি’ প্রবন্ধে বলেছেন, “আমরা সমাজেরই অর্ধ্বঅঙ্গ, আমরা পড়িয়া থাকিলে সমাজ উঠিবে কিরূপে? কোনো ব্যক্তির এক পা বাঁধিয়া রাখিলে, সে খোঁড়াইতে খোঁড়াইতে কতদূর চলিবে? পুরুষদের স্বার্থ এবং আমাদের স্বার্থ ভিন্ন নহে—একই। তাহাদের জীবনের উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য যাহা, আমাদের লক্ষ্যও তাহাই। শিশুর জন্য পিতা ও মাতা উভয়েরই সমান দরকার। কি আধ্যাত্মিক জগতে, কি সাংসারিক জীবনের পথে সর্বত্র আমরা যাহাতে তাহাদের পাশাপাশি চলিতে পারি, আমাদের এরূপ গুণের আবশ্যক।”

নারী মুক্তির কথা তথা আত্মপ্রতিষ্ঠার অনুপ্রেরণা দানের কথা বলতে গিয়ে তিনি লিখেছেন, “স্বাধীনতা অর্থে পুরুষের ন্যায় উন্নত অবস্থা বুঝিতে হইবে, পুরুষের সমকক্ষতা লাভের জন্য আমাদিগকে যাহা করিতে হয়, তাহাই করিব। যদি এখন স্বাধীনভাবে জীবিকা অর্জন করিলে স্বাধীনতা লাভ হয়, তবে তাহাই করিব। আবশ্যক হইলে আমরা লেডি কেরানি হইতে আরম্ভ করিয়া লেডি ম্যাজিস্ট্রেট, লেডি ব্যারিস্টারর, লেডি জর্জ সবই হইব।”
আবার স্বামী-স্ত্রী সঙ্গে তুলনা করে রোকেয়া তার ‘অর্ধাঙ্গী’ প্রবন্ধে লেখেন, “স্বামী যখন পৃথিবী হইতে সূর্য ও নক্ষত্রের দূরত্ব মাপেন, স্ত্রী তখন একটা বালিশের কভারের দৈর্ঘ্য-প্রস্থ (সেলাই করিবার জন্য) মাপেন। স্বামী যখন কল্পনার সাহায্যে সুদূর আকাশে গ্রহ-নক্ষত্রমালা বেষ্টিত সৌরজগতে বিচরণ করেন, সূর্যমণ্ডলের ঘনফল তুলনাদণ্ডে ওজন করেন এবং ধূমকেতুর গতি নির্ণয় করেন স্ত্রী তখন রন্ধনশালায় বিচরণ করেন, চাউল, জল ওজন করেন এবং রাঁধুনির গতি নির্ণয় করেন।”

মুসলমান সমাজের ঘোর অন্ধকার যুগে নারী জাগরণের ক্ষেত্রে রোকেয়ার ভূমিকা ছিল একক, ব্যতিক্রমী এবং অনন্যসাধারণ। অবরোধ প্রথার শিকল ভেঙে তিনি বেরিয়ে আসেন অসামান্য সাহস, প্রবল আত্মবিশ্বাস ও দৃঢ় সংকল্প নিয়ে। বেগম রোকেয়াই প্রথমবারের মতো বাঙালি মুসলিম সমাজে পুরুষের পাশাপাশি নারীর সমান অধিকারের দাবি তুলে ধরেন এবং নারী স্বাধীনতার পক্ষে নিজের মতবাদ প্রচার করেন। সাহিত্যচর্চা, সংগঠন পরিচালনা ও শিক্ষাবিস্তার এই ত্রিমাত্রিক ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে বেগম রোকেয়া সমাজ সংস্কারে এগিয়ে আসেন এবং স্থাপন করেন উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তার অন্যতম লক্ষ্য ছিল নারীশিক্ষার প্রসার, নারীর অর্থনৈতিক মুক্তি এবং মুসলমান সমাজের অবরোধ প্রথার অবসান। শিক্ষা ব্যতীত নারীজাতির অগ্রগতি ও মুক্তি সম্ভব নয়, এ সত্য অনুধাবন করেই তিনি নারীশিক্ষা প্রসারের কাজে ব্রতী হন। ১৯৩২ সালের ৯ ডিসেম্বর আজকের এই দিনে কলকাতায় এই মহীয়সী নারী তার কর্মময় জীবনের সমাপ্ত করে চলে যান সেইখানে, যেখানে কেবল যেতে হয় আর ফিরে আসা যায় না।  

অভিজিৎ সাহা :  শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক

Link copied!