স্যাটায়ার আর কাকে বলে, দেখুন! বিজ্ঞানের শিক্ষিকা, যিনি বিজ্ঞান পড়ান আর কি, এমন এক শিক্ষিকা, স্কুলের কম্পাউন্ডের ভেতর ক্লাস চলাকালে কাঁচি দিয়ে নয় নয়টি মেয়ের চুল কেটে নিয়েছেন। কেন? কারণ তারা হিজাব পরে স্কুলে আসেনি।
এই সংবাদ পড়ে তিন চার বছর আগের সেই কাহিনীটা মনে পড়ে গেল। সেই যেবার বোরকা হিজাব পরে ক্রিকেট খেলার ভড়ং করলেন এক মা, ডেইলি স্টার সেটা আবার মহিমান্বিত করে ছাপাল আর মজাটা ঘটলো সেইখানে, যখন আমি এই ভড়ংয়ের বিপরীতে দুটি বাক্য লিখলাম সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের পাতায়, আর সেখানে আমার বিরুদ্ধে নোংরা বাক্য নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো যারা, তাদের একটি বড় অংশ প্রগতিশীল বাম রাজনীতি করেন।
ঘটনার কোথায় যেন মিল পাচ্ছি। আসলে পুরো বাংলাদেশটাই তো এখন রঙ্গমঞ্চ। নানা জাতের পাত্রপাত্রী রং মেখে সঙ সেজে অভিনয় করে যাচ্ছে। সবাই চায় ধর্মের লেবাস পরতে। ধর্ম সবচেয়ে সহজ অস্ত্র কি না। দরিদ্র, মূর্খ, অসচেতন, ভীরু, অসৎ জনগোষ্ঠীকে নতজানু রাখতে ধর্মের চেয়ে সহজ ব্যবহার আর কিছু হয় না; সে আপনি বিজ্ঞানই পড়ান, কি সমাজবিজ্ঞান; সে আপনি রাজনৈতিক নেতা হন, কি কবি; হন গায়ক, নায়ক, শিল্পী—ধর্ম থাকবে সবার আগে। এত আগে যে আপনার ছায়া পড়ার আগে ধর্মের ছায়া পড়বে। সেই ছায়াটাই বা কেমন? সেই ছায়াটা কি সৎ? সত্য? সঠিক? সেসব যাচাই বাছাই কে করবে? তখন তো ঠক বাছতে গাঁ উজাড়।
মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখানের সৈয়দপুর আব্দুর রহমান স্কুল অ্যান্ড কলেজ। সে কলেজের শিক্ষক রুনিয়া সরকার। এ দেখি আরেক সরকার। কদিন আগে ভিকারুন্নিসার মুরাদ হোসেন সরকার যৌন নিপীড়নের কাহিনী করে থলে থেকে বেরুলেন মাত্র। সেইখানেও ছিল ওই একই ধর্মের কোপ। হজ করে এসে তিনি নাকি নিষ্পাপ হয়ে গেছেন, এই ছিল তার সহকর্মীদের তদন্ত রিপোর্ট। আর যৌন নিপীড়নের পরে মুরাদ হোসেন ছাত্রীদের দোআ পড়ে দিতেন, যেন গুনাহ না হয়। তো এবারের রুনিয়া আপা কী করলেন? উনি সপ্তম শ্রেণির ৯ শিক্ষার্থীর চুল কেটে দিয়েছেন। বুধবার (২৮ ফেব্রুয়ারি) ক্লাস চলাকালীন এ ঘটনা ঘটে। অভিযুক্ত রুনিয়া সরকার ওই প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক।
ভাবুন, কী পরিমাণ ডেসপারেট তিনি! কিংবা তারা! মানে এই যে হিজাবের হুজুগের পেছনে গত কয়েক দশক ধরে কাজ করে যাচ্ছে যে মৌলবাদী গোষ্ঠীটি, তাদের হাতে এখন চুল কাটার কাঁচি। কিছুদিন আগে বাসে এরকম কতগুলো নারী ও পুরুষকে পাওয়া যাচ্ছিল যারা মেয়েদের জামা কেটে দিতো। এ তো সেই একই রকম ব্যাপার!
উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মিজানুর রহমান ভূঁইয়া জানিয়েছেন, ঘটনা সত্য। চুল কাটার ঘটনা ওই স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ মিয়া ফরিদ আহমেদর কাছে স্বীকার করেছে ওই শিক্ষিকা। তিনি এখন ফোন বন্ধ করে ঘাপটি মেরে বসে আছেন।
সিরাজদিখান উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইউএনও সাব্বির আহমেদও বলেছেন, ঘটনা সত্য। এখন বিষয়টা হলো একটা স্কুলে ছাত্রীরা হিজাব কেন পরবে? স্কুলের ইউনিফর্মে কি হিজাব থাকে? তাহলে সেই হিজাব কেন তারা পরবে? যদি কেউ পরতে চায়, সেটি ইউনিফর্মের বাইরের পোশাক হিসেবে গণ্য হবার কথা। নাকি এখন নারী মানেই হিজাব? তা সে ছাত্রী হোক, ডাক্তার হোক, পুলিশ হোক কি যা কিছু। হিজাব না পরলে চুল কাটা পড়বে?
এসব নিয়ে বহুবার কথা বলেছি আমরা। ওদের স্পর্ধা এখন সীমাহীন, কারণ এক সময় প্রগতিশীল সেজে থাকা, ভণ্ডজনেরা ব্যক্তিস্বাধীনতার ধুয়া তুলে এই হিজাবকে জাস্টিফাই করেছে, আর আমাদের মুখ চেপে ধরেছে। এখন তারই আফটার ইফেক্ট হিসেবে চুল কাটা হচ্ছে।
সৃজনশীল পাঠ্যপুস্তকের বিরুদ্ধে একটা শ্রেণি উঠে পড়ে লেগেছে। খেয়াল করে দেখবেন এরা সবাই একই সূত্রে গাঁথা, এদের বক্তব্যের ভেতরে একটা কথাই বারবার উঠে আসছে, আমার সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ইত্যাদির ধারক গান নাচ শিল্পকলার চর্চা করাটা তারা স্কুল কলেজে পছন্দ করছে না। লিঙ্গ সমতাকে পছন্দ করছে না। জেন্ডার রোলকে তারা চিহ্নিত করতে চাইছে না, যাতে যুগ যুগ ধরে নারী গৃহে এবং পুরুষ বাইরে কাজ করার যে আদিম চিন্তাটি আছে, তা জিইয়ে থাকে।
বহুবার বহুভাবে সচেতন করতে চাইবার পরও উটপাখির মতো মুখ গুঁজে পড়ে থেকেছেন কেউ, আর কেউ কেউ ইচ্ছে করেই প্রগতিশীল সেজে তাদের মদদ যুগিয়েছেন। এখন রুনিয়া সরকারের মতো শিক্ষকে ভরে গেছে সব প্রতিষ্ঠান। এই আগাছা এখন সাফ করবে কে? 
ছাত্রীদের মনে, অভিভাবকদের মনে যে তীব্র আতঙ্ক তৈরি হলো, সেটি সারিয়ে তোলার দায়িত্ব নেবে কে? একটা সংবাদে দেখলাম কয়েকজন ছাত্রী জানিয়েছে, তারা আর স্কুলে যাবে না। তো, শেষ অব্ধি তাদের চূড়ান্ত বিজয়ও অর্জন হচ্ছে।
এখন আসলে কী বলার বা করার আছে আমাদের, জানি না। শুধু বুঝতে পারি, এখন শক্ত হাতে দমনের সময়। সেটা করতে হবে সরকারকে। আর কেউ পারবে না। জনগণেরও ব্রেইন ওয়াশ ঘটে গেছে। ফলে জনগণকে দিয়ে রুখে দেওয়ার আশাও করি না। যা করার করতে হবে সরকারকে। নিতে হবে কঠোর নীতি, করতে হবে বাস্তবায়ন ও প্রয়োগ। তারপরেই হয়তো এদের বিষদাঁত ও অভিশপ্ত কাঁচিটি ভেঙে গুড়িয়ে দেওয়া সম্ভব হবে।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
                
              
																                  
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    






































