• ঢাকা
  • শনিবার, ১৮ মে, ২০২৪, ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১,

দ্রব্যমূল্যের আঘাত আর টিকে থাকার চেষ্টা  


রাজেকুজ্জামান রতন
প্রকাশিত: অক্টোবর ১৩, ২০২১, ০৩:২৭ পিএম
দ্রব্যমূল্যের আঘাত আর টিকে থাকার চেষ্টা  

নিরুপায় মানুষ বাজারে কেনাকাটা করে আর অসহায়ের মত বলে, সব জিনিসের দাম বাড়লে বাঁচবো কিভাবে? সাধারণ মানুষ প্রতিদিন যা ব্যবহার করে তার প্রায় সবকিছুরই দাম বাড়ছে। খাদ্য দ্রব্য যেমন চাল, আটা, ময়দা, সয়াবিন তেল, মসুর ডাল, চিনি, পিয়াজ, মুরগি, ডিম কোনটার ছেড়ে কোনটার কথা বলবেন। দাম বেড়েছে এবং বেড়েই চলেছে সব ধরণের খাদ্যপণ্যের। এর সাথে তাল মিলিয়ে গায়ে মাখার সাবান যা এখন সুগন্ধি সাবান বলে পরিচিত তার দামও বেড়েছে, দাম বেড়েছে কাপড় কাচা সাবান, টিস্যু, টুথ পেস্ট, নারিকেল তেল, সরিষার তেল এ সব কিছুর। তাহলে রান্নার গ্যাস বা বাকি থাকবে কেন?

বিশ্ব বাজারের অজুহাতে এলপিজি’র ১২ কেজির সিলিন্ডারের দাম গত ৪ মাসে ৪ বার বাড়িয়ে এখন তা নির্ধারণ করা হয়েছে ১২৫৯ টাকা। সেপ্টেম্বরে যা ছিল ১০৩৩ টাকা, আগস্ট মাসে ছিল ৮৯১ টাকা। অন্যদিকে শাক সবজির মত নিম্নমানের জিনিস দিয়ে ভাত খায় একথা বলতে অনেকের লজ্জা হলেও, এসবের দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে বিক্রেতার কিন্তু কোন লজ্জা নেই। সাধারণ মানুষ যা কেনে তার দাম বাড়লেও সাধারণ মানুষের একমাত্র বিক্রয়যোগ্য পণ্য শ্রম শক্তি তার দাম কিন্ত বাড়ে নাই। বেতন বাড়ে নাই শ্রমিকের এবং বেসরকারি খাতে কর্মরত লাখ লাখ শ্রমিক কর্মচারীর। তাদের জীবনে টানাটানির আর শেষ নেই। জীবনযাপনের কঠিন যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছেন তারা। তবে এই অসম যুদ্ধে মার খেয়েই যাচ্ছে মধ্যবিত্তের নিচের অংশ, নিম্নবিত্ত ও দরিদ্ররা।        

সরকারি হিসেবে মূল্যস্ফীতির হার ৫.৮ শতাংশ। অর্থাৎ গত বছর দ্রব্যমূল্য ১০০ টাকা হলে এবার তা হয়েছে ১০৫ টাকা ৮০ পয়সা। এই হিসাবের সাথে মানুষের অভিজ্ঞতা মেলে না কোনভাবেই। কারণ বাজারে মোটা চাল এখন ৫০ টাকা, আটা ৩৪ টাকা, ময়দা ৪৪ টাকা, সয়াবিন তেল ১৫০ টাকা, চিনি ৮৫ টাকা, মসুর ডাল ৯০ টাকা, মুরগি ১৭৫ টাকা সাধারণভাবে বিক্রি হচ্ছে। এলাকাভেদে এর সঙ্গে দুই এক টাকা যোগ হতে পারে। টিসিবির বাজার দরের তালিকার সাথে তুলনা করলে দেখা যাবে ২০২০ সালের তুলনায় চালের দাম গড়ে ৩১ শতাংশ, আটা ২০ শতাংশ, ময়দা ৩৩ শতাংশ, সয়াবিন তেল ৪৫ শতাংশ, চিনি ৫০ শতাংশ, মসুর ডাল ৩০ শতাংশ বেড়েছে। আর রান্নার গ্যাসের দাম তো আগস্ট মাসের তুলনায় ৪০ শতাংশ বেড়েছে।

এই সময়কালে পানির দাম বাড়ানো হয়েছে, বিদ্যুতের দাম বেড়েছে এবং আরো বাড়ানোর প্রস্তুতি চলছে। সব আঘাত এসে পড়ছে মানুষের জীবনে এবং সংসারে। নিশ্চিত মূল্যবৃদ্ধি এবং অনিশ্চিত আয় সাধারণ মানুষের জীবনকে দিশেহারা করে দিচ্ছে। কিন্তু মানুষের জীবন তো আর থেমে থাকে না, সে চলতেই থাকে তবে কমে গেছে গতি আর বেড়েছে দুর্দশা। কোনমতে বেঁচে থাকার নানা কৌশল আবিষ্কার করছেন তারা। কেমন আছেন একথা যে কাউকে জিজ্ঞেস করলে একটু হাসির মত ভঙ্গি করে বলেন, এই তো চলছে, কিন্তু এগুচ্ছে না।   

বাংলাদেশের অতি ধনী, ধনী এবং উচ্চ মধ্যবিত্তদের জীবনে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি তেমন কোন প্রভাব ফেলে না। বরং তারা অনেকেই ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করে বলেন, আমাদের দেশের জিনিসপত্রের দাম পৃথিবীর অনেক দেশের চাইতে কম তারপরও দ্রব্যমুল্য নিয়ে কথা বলাটা এদেশে একটা ‘ফ্যাশন’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাদের কাছে উদাহরণ ইউরোপ আমেরিকা, যদিও সেসব দেশের মানুষের আয় রোজগার কেমন সেটা তারা বলেন না। ৮০ শতাংশের বেশি মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত ও দরিদ্র মানুষেরাই দেশের অর্থনীতির চাকা ঘোরায় কিন্তু দ্রব্যমুল্য বৃদ্ধি যে তাদের সংসারের চাকাকে শ্লথ করে দেয়, সেটা এইসব মানুষের অনুভব করার ইচ্ছাও নেই। যদিও এই উচ্চবিত্তরাই দেশের নীতি নির্ধারণ প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত।

একটি পাঁচ সদস্যের পরিবারের কথা যদি ধরা যায় তাহলে একটা সম্ভাব্য ব্যয় বৃদ্ধির হিসাব বুঝতে কোন অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। মাসে ৫০ কেজি চাল, ৫ লিটার তেল, ৫ কেজি পিঁয়াজ, মাছ- মাংস ১০ কেজি ( ১ দিন পর একদিন মাছ অথবা মাংস খেলে), ডিম ৫ ডজন ( দিনে ২টা ডিম ৫ জনে খাওয়া), ডাল ৫ কেজি, চিনি ৩ কেজি, লবন ২ কেজি, তেল- সাবান- গুড়া সাবান- টুথ পেস্ট, শাকসবজি, তরিতরকারি, আর একটু চা খাওয়ার বিলাসিতা করলে মাসে ১৮০০ থেকে ২০০০ টাকা খরচ বেড়ে যাচ্ছে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে। যার মাসিক আয় ২০ হাজার টাকা তিনি কিভাবে এই ব্যয় বৃদ্ধি সামাল দেবেন তা ভাবলে কপালে দুশ্চিন্তার ছাপ পড়বে সবারই।

কিন্তু যাদের এই বিষয়গুলো দেখার কথা তারা কী বলছেন? পিঁয়াজের দাম নিয়ে মন্ত্রী বলছেন দেশে পিঁয়াজের সংকট নেই। ৫ লাখ টন পিয়াজ আছে। এই পিঁয়াজে দেশের তিন মাস চলবে। আমরা তো জানি নভেম্বরের শেষে দেশী পিঁয়াজ বাজারে আসবে। তাহলে পিঁয়াজের দাম বৃদ্ধির এই কারণ কী? যার উত্তরে আবার সচিব বলছেন আরও এক দেড় মাস পিঁয়াজের দাম বাড়বে। এটা কি ভোক্তাদের সতর্ক করলেন, না ব্যবসায়ীদের ইশারা দিলেন তাতো বোঝা গেল না। তবে সাধারণ মানুষ বুঝলেন যে একটা টোটাল ফুটবল খেলার মত খেলা চলছে। একজন বল এগিয়ে দেন অন্যে গোলবারে শট নেন। দারুণ সমঝোতা! ভারতের পিঁয়াজের দাম বাড়লে তা না হয় আমদানি করা পিঁয়াজের ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য হতে পারে, কিন্তু দেশী পিঁয়াজের দাম কেন বাড়বে, এই প্রশ্নের উত্তর কে দেবে? মাসে যদি ২ লাখ টন পিয়াজ প্রয়োজন হয় আর প্রতি কেজিতে ৩০ টাকা পিঁয়াজের দাম বাড়ে তাহলে ক্রেতা বা ভোক্তার পকেট থেকে অতিরিক্ত বেরিয়ে যায় প্রায় ৬০০ কোটি টাকা। কথায় বলে পিঁয়াজ মানুষকে কাঁদায়। বাংলাদেশে পিঁয়াজ কাঁদায় কৃষককে, যখন সে খেতের ফসল বিক্রি করে, পিঁয়াজ কাঁদায় ক্রেতাকে যখন সে বেশি দামে কেনে, আর সর্বশেষে কাঁদায় যিনি পিঁয়াজ কাটেন তাকে। কিন্তু হাসায় একদল ব্যবসায়ীকে। যারা প্রতিবছর অপেক্ষায় থাকে সেপ্টেম্বর মাসের জন্য, যখন সে দাম বাড়াবে। এই ব্যাপার চলছে সমস্ত ভোগ্যপণ্যের বেলাতেই এবং দুর্ভাগা ক্রেতারা এই প্রক্রিয়ার অসহায় শিকারে পরিণত হচ্ছে নিয়মিতভাবেই। বিশ্ববাজারে দাম বৃদ্ধির অজুহাতে সবকিছুর দাম বাড়ান তারা, কিন্তু বিশ্ববাজারে চালের দাম যে কম, তাহলে বাংলাদেশে কেন কমছে না?  ভারত, পাকিস্তান, থাইল্যান্ড এসব চাল উৎপাদনকারী দেশে চালের দাম গত বছরের চাইতে ১৫ শতাংশ কমে গেছে আর বাংলাদেশে ৩১ শতাংশ বৃদ্ধি পেল কেন? এই প্রশ্নের উত্তর কে দেবে?

দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিতে সরকারের পদক্ষেপ ঐ ট্রাকে করে টিসিবির পণ্য বিক্রিতেই সীমাবদ্ধ। এই ১ কোটি ৬০ লাখ মানুষের ঢাকা মহানগরীতে ৫০০ ট্রাক দিয়ে চিনি, তেল ও ডাল বিক্রি করছে তারা। এসব ট্রাকের সামনে দীর্ঘ লাইন দেখে বুঝতে অসুবিধা হয় না যে একটু মূল্য সাশ্রয়ের জন্য প্রচণ্ড রোদে দাঁড়িয়ে মানুষ কত কষ্ট করছে। এক কেজি চিনিতে সরকার নানা ধরনের শুল্ক, কর নিয়ে থাকেন ২৮ টাকা, এক লিটার সয়াবিন তেল থেকে নেন ২০ টাকা। অর্থাৎ গড়ে প্রতিবছর ২০ লাখ টন চিনি থেকে ৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকা এবং ২০ লাখ টন তেল থেকে ৪ হাজার কোটি টাকা সরকার পেয়ে থাকেন। তাহলে কী দাঁড়ালো ব্যাপারটা! সরকার নিচ্ছেন নানা ধরনের শুল্ক ও কর, ব্যবসায়ীরা করছে বাধাহীন মুনাফা। আর মূল্যবৃদ্ধির কোপটা এসে পড়ছে সাধারণ ক্রেতাদের ঘাড়ে। সর্বংসহা জনগণ সব সহ্য করে একটু কৌতুক করে বলেন, পিঁয়াজের দাম বাড়লে পিঁয়াজ খাওয়া ছেড়ে দিতে পরামর্শ দেন যারা, তারা কাপড়ের দাম বৃদ্ধি পেলে কী পরামর্শ দেবেন?           

 

লেখক: শ্রমিক নেতা ও কলাম লেখক

Link copied!