• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ১২ ডিসেম্বর, ২০২৪, ২৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

অনিবার্য শেখ মুজিব


সালেক খোকন
প্রকাশিত: আগস্ট ১৪, ২০২৩, ০৬:২৫ পিএম
অনিবার্য শেখ মুজিব

স্বাধীনতা লাভের পর বাংলাদেশের সর্বত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিলো পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ধ্বংসলীলা। মানুষের মৌলিক অধিকার খাদ্য, বস্ত্র ও বাসস্থানের অভাব ছিল তীব্র। কলকারখানায় উৎপাদনও বন্ধ। সারাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা পুরোপুরি চালু করা এবং এক কোটি শরণার্থীকে পুনর্বাসন করারসহ সমস্যা ছিল অগণিত। ফলে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে নতুনভাবে গড়ে তোলাই ছিল জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।

ওইসময় যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে দেশের অবস্থার কথা তুলে ধরে তিনি বলেছিলেন ঠিক এভাবে—‘আমি সাড়ে সাত কোটি মানুষ পেয়েছি, যাদের কিছুই নেই। আমি ৫ হাজার ৩০৩টি রান্নাঘর বসিয়েছি। প্রতিদিন এক লাখ লোককে খাবার দিই। দুর্ভাগ্যবশত আমার বহুলোক প্রতিদিন মারা যাচ্ছে। এর জন্য অংশত দায়ী পাকিস্তান। কারণ তারা আমার কাছ থেকে সবকিছুই নিয়ে গেছে।’ সে সময় বিদেশি গবেষকদের ধারণা ছিল—‘বাংলাদেশের পঞ্চাশ লাখ মানুষ অনাহারে প্রাণ হারাবে। দুর্ভিক্ষ দেখা দেবে।’ কিন্তু বাস্তবে তেমনটি ঘটেনি। শত বাধা অতিক্রম করে সাফল্য আনার সক্ষমতা যে এ দেশের মানুষের রয়েছে- এটি বঙ্গবন্ধু অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন দেশবাসীকে ঐক্যবদ্ধ করে উন্নয়নের কাঙ্ক্ষিত পথে সবাইকে নিয়েই এগোনো সম্ভব। জনগণের প্রতি এই অবিচল বিশ্বাসই ছিল বঙ্গবন্ধুর রাষ্ট্র পরিচালনার মূল শক্তি।
বাঙালিদের কতটা চিনতেন বঙ্গবন্ধু-তা জানা যায় তার লেখা অসমাপ্ত আত্মজীবনী পাঠ করেই।

এক জায়গায় (২১৪ পৃষ্ঠায়) তিনি লিখেছেন এভাবে-‘প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের মনেরও একটা সম্বন্ধ আছে। বালুর দেশের মানুষের মনও বালুর মতো উড়ে বেড়ায়। আর পলিমাটির বাংলার মানুষের মন ঐ রকমই নরম, ঐ রকমই সবুজ। প্রকৃতির অকৃপণ সৌন্দর্যে আমাদের জন্ম, সৌন্দর্যই আমরা ভালোবাসি।’

আরেক জায়গায় (৪৭ পৃষ্ঠায়) বাঙালির চরিত্রের নিখুঁত ব্যাখ্যাও করেছেন এভাবে, ‘আমাদের বাঙালির মধ্যে দুইটা দিক আছে। একটা হলো আমরা মুসলমান, আর একটা হলো আমরা বাঙালি। পরশ্রীকাতরতা এবং বিশ্বাসঘাতকতা আমাদের রক্তের মধ্যে রয়েছে। বোধ হয় দুনিয়ার কোনো ভাষাতেই এই কথাটা পাওয়া যাবে না, ‘পরশ্রীকাতরতা’। পরের শ্রী দেখে যে কাতর হয়, তাকে ‘পরশ্রীকাতর’ বলে। ঈর্ষা, দ্বেষ সকল ভাষাতেই পাবেন, সকল জাতির মধ্যেই কিছু কিছু আছে, কিন্তু বাঙালিদের মধ্যে আছে পরশ্রীকাতরতা। ভাই ভাইয়ের উন্নতি দেখলে খুশি হয় না। এই জন্যই বাঙালি জাতির সকল রকম গুণ থাকা সত্ত্বেও জীবনভর অন্যের অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে। …যুগ যুগ ধরে এরা শোষিত হয়েছে নিজের দোষে। নিজেকে এরা চেনে না, আর যত দিন চিনবে না এবং বুঝবে না, ততদিন এদের মুক্তি আসবে না।’

বাঙালিদের নিয়ে এর চেয়ে খাঁটি মূল্যায়ন আর কী হতে পারে!

সপরিবারে বঙ্গবন্ধু

কিন্তু এই বাঙালিদের জন্যই বঙ্গবন্ধুর বুকে ছিল গভীর ভালোবাসা। নির্বাচনের সময় একবার হেঁটে হেঁটে প্রচারণার কাজ চালাচ্ছেন, তখন এক হতদরিদ্র বৃদ্ধ মহিলার সঙ্গে দেখা। বঙ্গবন্ধুকে দেখার জন্য কয়েক ঘণ্টা থেকে দাঁড়িয়ে আছেন, তাকে ধরে নিজের কুঁড়েঘরে নিয়ে এক বাটি দুধ, একটা পান আর চার আনা পয়সা দিয়েছেন, বলেছেন, ‘খাও বাবা, আর পয়সা কয়টা তুমি নেও, আমার তো কিছু নেই।’

এ ঘটনা বঙ্গবন্ধুর মনে দাগ কাটে। সেই দিনের অনুভূতি তিনি তুলে ধরেছেন  এভাবে—“নীরবে আমার চক্ষু দিয়ে দুই ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়েছিল, যখন তার বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসি। সেই দিনই আমি মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, মানুষেরে ধোঁকা আমি দিতে পারব না।’  জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু তার এই প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করেননি।

তিনি বাংলার মানুষকে কত গভীরভাবে ভালোবাসতেন সেটি তার প্রতিটি পদক্ষেপের মধ্যেই প্রতিফলিত হয়েছে। একবার এক বিদেশি সাংবাদিক বঙ্গবন্ধুকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘What is your qualification?’—উত্তরে তিনি বলেছিলেন, ‘I love my people.’ ওই সাংবাদিক সঙ্গে সঙ্গেই পাল্টা প্রশ্ন ছুড়লেন, ‘What is your disqualification?’ বঙ্গবন্ধু শান্তকণ্ঠে উত্তর দিয়েছিলেন, ‘I love them too much.’

কেমন দেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন জাতির জনক? সেটি অনুমান করা যায় তার নানা বক্তব্য বিশ্লেষণে। স্বাধীনতার প্রথম বর্ষপূর্তিতে তিনি বলেছিলেন—‘শ্মশান বাংলাকে আমরা সোনার বাংলা করে গড়ে তুলতে চাই। যে বাংলায় আগামী দিনের মায়েরা হাসবে, শিশুরা খেলবে। আমরা শোষণমুক্ত সমাজ গড়ে তুলব। ক্ষেত-খামার, কলকারখানায় দেশ গড়ার আন্দোলন গড়ে তুলুন। কাজের মাধ্যমে দেশকে নতুন করে গড়া যায়। আসুন সকলে মিলে সমবেতভাবে আমরা চেষ্টা করি, যাতে সোনার বাংলা আবার হাসে, সোনার বাংলাকে আমরা নতুন করে গড়ে তুলতে পারি।’

তাই বঙ্গবন্ধুর জীবন-ইতিহাস, শাসনামল ও দর্শন নতুন প্রজন্মের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্যোগই হতে পারে সবচেয়ে বড় কাজ। তাঁর নেতৃত্ব, উদ্যোগ ও স্বপ্নের কথাগুলোই ছড়িয়ে দিতে হবে শিশু-কিশোর ও প্রজন্মের মাঝে। আর এভাবে অসাম্প্রদায়িকতার আদর্শ ও ধর্মনিরপেক্ষতার দিশারী বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন পূরণের উদ্যোগই হতে পারে তার প্রতি শ্রেষ্ঠ শ্রদ্ধা নিবেদন।

জাতির পিতার সমগ্র জীবনের স্বপ্ন ছিল দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানো। বাঙালি জাতিকে তিনি শুধু একটি ভূখণ্ডই দেননি, দিয়েছেন সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক মুক্তি। দিয়েছেন অসাম্প্রদায়িক মানবিক চেতনায় উজ্জ্বল জীবনাদর্শ। তার সবকিছুই ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাকে জানলেই জানা হযে যায় বাংলাদেশকে। তাই সব কালেই অনিবার্য হয়ে থাকবেন জাতির পিতা শেখ মুজিব।

 

লেখক: মুক্তিযুদ্ধ-গবেষক

Link copied!