• ঢাকা
  • রবিবার, ১৯ মে, ২০২৪, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১,
নতুন বছরের ভাবনা

জ্বালানি সংকট মেটাতে উৎপাদনে জোর দিতে হবে


আফরিদা ইফরাত
প্রকাশিত: ডিসেম্বর ৩০, ২০২২, ০৩:০৪ পিএম
জ্বালানি সংকট মেটাতে উৎপাদনে জোর দিতে হবে

বৈশ্বিক জ্বালানি সংকটের শুরু ২০২১ সালেই। করোনা মহামারি স্থবির না করলেও স্তব্ধতার মুখে ফেলে দিয়েছে পৃথিবীকে। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক দুরবস্থার শুরু সেখান থেকেই। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পর নতুন করে ফের কর্মচঞ্চল হওয়ার প্রচেষ্টা শুরু করে প্রতিটি দেশ। অবশ্য সার্বিক পরিস্থিতি ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর। শুরুর দিকে অনেকেই ভেবেছিলেন এই যুদ্ধ একপেশে একটি যুদ্ধ হতে চলেছে। কিন্তু সবার ধারণা ভেঙে বিশ্লেষকদের দ্বিধাগ্রস্ত করে তুলেছে এই যুদ্ধ।

আধুনিক বিশ্বে প্রতিটি রাষ্ট্রের অর্থনীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ উৎপাদন বাড়ানো। সেই উৎপাদন বাড়ানোর জন্য প্রয়োজন শক্তির জোগান। জ্বালানি ছাড়া প্রত্যেকটি রাষ্ট্রই নানা সমস্যার মুখোমুখি হয়। করোনা দুর্যোগের ক্ষতি এবং সম্প্রতি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে বৈশ্বিক সরবরাহ প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হওয়ার ফলে জ্বালানির জোগানেও সমস্যা দেখা দিয়েছে। এরমধ্যে কিছুদিনের জন্য তেলের দাম কমলেও বাংলাদেশে জ্বালানি তেলের দাম বরং বেড়েছে। জ্বালানি তেলের দামবৃদ্ধির প্রভাব তখন সবাই বুঝতে পেরেছিলেন। জনজীবনে জ্বালানির গুরুত্ব তখন সবাই উপলব্ধি করেছিলেন এবং এখনও তা জাতীয় সমস্যায় পরিণত হতে শুরু করেছে। বিদ্যমান সমস্যা যে আমাদের জন্যই সমস্যা তা কিন্তু নয়। সারা বিশ্বের জন্যই সমস্যা। বিশেষত শীতপ্রধান দেশের জন্য এই সমস্যা মহামারির মতো। উদাহরণ হিসেবে জাপানের কথাই ধরা যাক। জাপানের জ্বালানির জোগান অনেকটাই কম ছিল। আর ২০২২ এর শেষদিকে শীত আসার পর জ্বালানির চাহিদা থাকবে তুঙ্গে। শীত মোকাবেলা করার জন্য পর্যাপ্ত জ্বালানি পাওয়া না গেলে অবস্থা কেমন হবে তা নিয়ে নানা আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। বিষয়টি ইউরোপের জন্যও বিশাল ভাবনার বিষয়। আর এসব আমাদের জন্যও ভাবনার বিষয় অনেক কারণে। ইউরোপ বা পশ্চিমা দেশের অর্থনৈতিক দুরবস্থা আমাদের দেশে বিনিয়োগকারী বাড়ানো, বিভিন্ন সংস্থা বা রাষ্ট্রের অনুদান পাওয়ার পথে বিরাট অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। যেমন এবছর জাপান থেকে আমরা অনুদান পাইনি।

২০২২ এর শেষের দিকে বৈশ্বিক সংকটের কথা অনেকাংশেই আমরা ভুলে গিয়েছিলাম। ফুটবল বিশ্বকাপের মতো আসরের দিকে মনোযোগ দেওয়ায় কিছুদিনের জন্য আমাদের নজর সরে গিয়েছিল মাত্র। এখন আবার সেই সমস্যা আমাদের তাড়া করতে শুরু করেছে। বিশ্বজুড়ে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) বাজারে কম তারল্য ও লেনদেনের উচ্চ ব্যয় এবং গুরুত্বপূর্ণ উৎপাদনকারীরা তেল উৎপাদন কমিয়ে আনার কারণে বিশ্ব প্রথম প্রকৃত জ্বালানি সংকটের মধ্যে রয়েছে। রাশিয়ার সঙ্গে অন্যান্য দেশের সম্পর্ক যেমনই হোক, ইউরোপ জ্বালানির জন্য রাশিয়ার কাছে নির্ভরশীল। বলা যায়, ইউরোপের গ্যাস সরবরাহ ব্যবস্থা অনেকটাই নাজুক রাশিয়া নির্ভরশীলতার জন্য। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির হারের পেছনে শীতকে অনেকেই দায়ী করেন। বিষয়টি অসত্য নয়। ঋতুপরিক্রমা প্রত্যেকটি দেশের জন্য ভাবনার বিষয়। ইউরোপের ক্ষেত্রে শীত নিয়ে পরিকল্পনা জননিরাপত্তা এবং রাষ্ট্রের সংহতি রক্ষার ক্ষেত্রে জরুরি। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের যে পরিস্থিতি সেখানে ইউক্রেনও ভালোভাবেই জবাব দিচ্ছে। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ, রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতির জন্য ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জ্বালানি মজুতের বদলে একটি অস্ত্রের পেছনেই বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচ করেছেন। বিষয়টি সমালোচনার মুখ দেখলেও দু-দেশের যুদ্ধ পরিস্থিতি সম্পর্কে আন্দাজ পাওয়া যায়।

অনেক বিশেষজ্ঞই বর্তমান পরিস্থিতির সঙ্গে ১৯৭০ এর অবস্থার মিল দেখতে পাচ্ছেন। কিন্তু তা পুরোপুরি সঠিক বলা যাবে না কয়েকটি কারণে। এরমধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ১৯৭০ সালে জ্বালানি সমস্যা ছিল তেলকে ঘিরে। আর এখন জীবাশ্ম জ্বালানি নিয়েই সংকট। ১৯৭০ এর দিকে বিশ্ব অর্থনীতি তেলনির্ভর ছিল। ৫০ বছর আগেও বিশ্ব অর্থনীতির সুসংহত আন্তঃসম্পর্ক থাকলেও এখন রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে তা নেই। গ্যাসের ওপর নির্ভরশীলতা বাড়ায় এবং সীমিত কয়েকটি যোগানদাতা থাকায় সমস্যা আরও ব্যাপক আকার লাভ করেছে।

ইউরোপের অনেক গ্যাস কোম্পানি ইতোমধ্যে তাদের কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছে। উন্নয়নশীল এবং উচ্চ মধ্য আয়ের দেশে এই জ্বালানির দাম বৃদ্ধি জীবনযাত্রার ওপরেও ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। জাপানের উদাহরণ থেকেই বিষয়টি হয়তো স্পষ্ট করা গেছে।

আবহাওয়া, করোনাকালিন স্থবিরতার পর আবার সচল হওয়ার মাধ্যমে ক্ষতি কমানোর প্রচেষ্টার সময়ের আগেই জ্বালানি সংকট দেখা দিচ্ছিল। করোনার কারণে জ্বালানি সরবরাহ কঠিন হয়ে যাচ্ছিল। ইউরোপের বিভিন্ন বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়া এবং নানা কাঠামোগত পরিস্থিতির কারণে রাশিয়াই জ্বালানি সরবরাহকারী দেশের শীর্ষে চলে আসে। সেই রাশিয়াই ২০২১ সালে ইউক্রেনে অভিযানের আগে জ্বালানি সরবরাহ সীমিত করে ফেলে। এমনিতেই সরবরাহ চাহিদার অনুপাতে কম, এমন সময়ে সীমিত করে ফেলা কতটা ভয়াবহ তা বিস্তারিত ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের দাবি রাখে না।

রাশিয়ার এই অভিযান বিশ্বের অনেক দেশ ভালোভাবে নেয়নি। বিশেষত ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন এবং যুক্তরাষ্ট্র দেশটির ওপর নানা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। তাতে রাশিয়া ভাবলেশহীন ছিল। অনেক দেশ রাশিয়া নির্ভরতা বর্জনের ঘোষণা দিলেও রাশিয়াকে টলানো যায়নি। রাশিয়া ইউরোপে সরবরাহের পাইপলাইনে সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। এমনকি সংবাদমাধ্যমে জানা যায়, তারা জ্বালানি অকারণে পুড়িয়ে সমগ্র বিশ্বকে অনেকটা সতর্কবার্তা দেখিয়েছে।

রাশিয়ার গ্যাসের সরবরাহ কম থাকার সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে মুদ্রাস্ফীতি ইতিহাসে সর্বোচ্চ। যুক্তরাষ্ট্র এই প্রথম কর্মীদের বেতন বাড়িয়েও মুদ্রাস্ফীতিতে জনজীবনের দুর্ভোগ কমাতে পারেনি। বেকারত্ব এবং অভিবাসী সমস্যা দিনকে দিন বাড়ছেই। আরেকটি বড় সমস্যা, বিশ্বের অনেক দেশেই রক্ষণশীলদের উত্থান। রাশিয়ার গ্যাসের দাম স্বভাবতই বেড়েছে। কিন্তু কোনো দ্রব্যের জোগান না থাকলে প্রতিপূরক দ্রব্যও থাকতে হয়। সেজন্য অস্ট্রেলিয়ান এবং কাতারের এলএনজির দিকে সবার ঝোঁক বাড়ে। সব চাহিদা সেখানে নিপতিত হওয়ায় এলএনজির দামও বাড়তে শুরু করে। চাহিদা এতটাই বেড়ে গিয়েছে যে এলএনজি প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের পুরো কাঠামোর আধুনিকায়ন শুরু করে দিয়েছে। মূলত এলএনজির সরবরাহ আরও টেকসই, দ্রুত এবং বাড়ানোর স্বার্থেই এই আধুনিকায়ন।

রাশিয়ার ওপর নির্ভরশীলতাই যে বড় সমস্যা তা নয়। রাশিয়ার ওপর আরোপ করা নিষেধাজ্ঞাও নানা সমস্যার সৃষ্টি করেছে। তেলের দাম বেড়েছে সরবরাহ ব্যবস্থার পরিবর্তনের কারণে। রাশিয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর যুক্তরাষ্ট্র তেল আমদানির যে রুট তাতে বদল আনে। ভৌগোলিক রাজনীতির ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কেও সবাই সচেতন হতে শুরু করে। অনেক জাহাজ রাশিয়ার তেল বহনে রাজি নয়, কারণ রাশিয়ার ওপর স্যাংশন ও নিষেধাজ্ঞা তাদের জন্য সমস্যার কারণ হতে পারে। এজন্যই বিশ্বের তাবড় তেল যোগানদাতা প্রতিষ্ঠানও তাদের সরবরাহ বাড়াতে পারছে না। তেলের দাম বাড়ছে এই সরবরাহ ব্যবস্থার সমস্যার কারণে।

অনেক রাষ্ট্রই অবস্থা কীভাবে সামাল দিবে তা বুঝতে পারছে না। এরমধ্যে জাতিসংঘ স্ট্যাগফ্লেশনের আশঙ্কা থেকে দুর্ভিক্ষের আশঙ্কার কথা ঘোষণা দিয়েছে। প্রতিটি রাষ্ট্রই তাদের উৎপাদন বাড়ানোর বিষয়ে মনোযোগী হয়ে উঠেছে। কিন্তু তাদের কাছে তো সেই একই প্রশ্ন, কীভাবে তা সম্ভব শক্তির জোগান ছাড়া? ইউরোপের অনেক দেশ আলজেরিয়া, নরওয়ে, আজারবাইজান এবং আরও অনেক রাষ্ট্রের কাছে গ্যাসের চাহিদা নিয়ে হাজির হয়েছে। কিছু কিছু দেশ কয়লার ওপর নির্ভর হচ্ছে এবং অনেক পরিচিত রাষ্ট্র পরমাণু বিদ্যুৎনির্ভরতা বাড়িয়েছে। সরবরাহ যেন সুষম থাকে সেজন্য আইইএ জরুরি তেলের মজুত থেকে ইতিহাসে সর্বাধিক তেলের মজুত ছেড়েছে। এমনকি ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন তেলের মজুতের ওপর নানা নিয়ম বেঁধে দিয়েছে যাতে তেলের জোগান একটি রাষ্ট্র ধরে না রাখে।

আপাতত প্রতিটি রাষ্ট্রই উৎপাদন বাড়ানোর জন্য বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সাশ্রয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সেজন্য সাধারণ মানুষকে কিছুটা আপোষ করতে হচ্ছে। আমাদের দেশেও লোডশেডিং এবং শীতের সময় রাজধানীর অনেক আবাসিক এলাকায় গ্যাস সরবরাহ বিঘ্নিত হয়েছে যেন গার্মেন্টস বা শিল্পপ্রতিষ্ঠানে জ্বালানি সরবরাহ স্বাভাবিক থাকে। জ্বালানি সাশ্রয়ের জন্য গরমকালে এসির ব্যবহার এবং সুপারমার্কেট, শপিংমল দ্রুত বন্ধের নিয়ম চালু করা হয়। অবশ্য পুরো ব্যবস্থাপনা নিয়ে নানা অসন্তোষ থাকলেও জ্বালানি সমস্যা এখনও বড় সমস্যা। ডলারের মূল্যবৃদ্ধি, ব্যাংকিং ব্যবস্থার নাজুক দশাও এই সমস্যাকে আরও বড় আকার দিচ্ছে। এমন সময়ে শক্তি উৎপাদনের বিভিন্ন প্রক্রিয়া, প্রযুক্তির ব্যবহার, উৎপাদনশীলতা ইত্যাদি বিষয়ের দিকে মনোযোগ দেওয়া জরুরি। আমাদের দেশের জন্য আপাতত অবস্থা কিছুটা ভালোই মনে হচ্ছে। আইএমএফের ঋণ কিছুটা স্বস্তি হলেও সামনে মেট্রোরেল এবং বড় প্রকল্পের কারণে কিছু সমস্যা দেখা দিতে পারে। সেগুলো কাটিয়ে ওঠা যাবে এই আশা করা যায়। আপাতত উৎপাদন বাড়ানোর দিকে মনোযোগ দিতে হবে।

লেখক : সংবাদকর্মী।

Link copied!