• ঢাকা
  • রবিবার, ০৫ মে, ২০২৪, ২৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৫ শাওয়াল ১৪৪৫

ঈদের আগে শ্রমিকদের বেতন-বোনাস শতভাগ নিশ্চিত হোক


জান্নাতুল যূথী
প্রকাশিত: এপ্রিল ২০, ২০২৩, ০৯:২৬ এএম
ঈদের আগে শ্রমিকদের বেতন-বোনাস শতভাগ নিশ্চিত হোক

ঈদ মানে খুশি। ঈদ মানে আনন্দ। কিন্তু এ সমাজে একশ্রেণির মানুষ আছেন যারা ঈদের দিনটাও ঠিক মতো দুমুঠো খেতে পারেন না।  পরতে পারেন না একটু ঠিকঠাক জামাকাপড়। কিন্তু এই শ্রেণিই আবার এ সমাজের মূল কারিগর। দেশের মূল চালিকাশক্তি এই শ্রমজীবী মানুষ। দিনান্ত পরিশ্রম করে মালিকের ঘরে তোলে লভ্যাংশ। তবু দুঃখের সঙ্গে বলতেই হয় ভাগ্য যেন কোনোদিনই এদের ওপর দয়াপরবশ হয় না। যখন মালিক শ্রেণি মুনাফার টাকা গুনতে গুনতে ক্লান্ত ঠিক তখন এই শ্রেণি পরিবার-পরিজন নিয়ে অসহায়-নির্জীব হয়ে জীবন কাটায়।

বছরের ৩৬৫ দিনের একটি বা দুটি দিনও যে তাদের একটু পেটপুরে খেয়ে-পরে দিন যাবে এমনটা এ সমাজে খুব কিঞ্চিৎই চোখে পড়ে। নিপীড়িত এই বৃহৎ জনগোষ্ঠী দেশের অর্থনীতিকে সচল রাখলেও তাদের পেট সচল রাখার দায়িত্ব কেউ গ্রহণ করে না। বলা চলে এই শ্রেণিকে নিয়ে উচ্চবিত্তের তেমন কোনো মাথাব্যথা নেই। ঘরের বাইরে এদের দেখলে নাক সিটকায়। কিন্তু এদেরই কাঁধে চেপে তারা কর্দমাক্ত রাস্তা পার হয়। আর যখনই রাস্তা পার হয়ে যায় ঠিক তখনই পারিশ্রমিকের কথা তাদের মাথায় থাকে না। কিন্তু ধর্মপ্রাণের দেশে এই শ্রমজীবীরা কেন অবহেলিত? একইসঙ্গে স্মরণযোগ্য তারা কিন্তু করুণা ভিক্ষা চায় না। বরং মাথার ঘাম পায়ে ফেলে যেটুকু রোজগার হয় সেই ন্যায্যমূল্যটুকুও ঠিকমতো পায় না। এই দায় কার।

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সবচেয়ে বড় অবদান পোশাক খাতের। এ দেশে ৩২ লাখের বেশি শ্রমিক কারখানায় কর্মরত রয়েছে। এর মধ্যে পুরুষ কর্মী প্রায় ১৫ লাখ এবং নারী কর্মী ১৭ লাখ। তৈরি পোশাক শিল্পের সঙ্গে যুক্ত এসব শ্রমিকেরা দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে শুধু পেটের তাগিদে। কিন্তু প্রায়ই গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয় অরাজক পরিস্থিতির। আর ঈদ আসলেই দেখা যায় শ্রমিকদের বেতন- বোনাসের তাগিদে রাস্তায় বিক্ষোভে অংশ নিতে। শ্রমের তুলনায় ন্যূনতম পারিশ্রমিকে তারা অন্তত ৮-১২ ঘণ্টা পরিশ্রম করেন। তারপরও মাসান্তে বেতনের টাকা ঠিকভাবে পায় না। তবু কর্মসংস্থানের অপ্রতুলতার কারণে এত সহজলভ্য মূল্যে এ দেশের জনগণ কাজে সম্পৃক্ত হয়। বাংলাদেশের রপ্তানি খাতের বড় মাধ্যমও এটি। তবু এই শ্রমিকদের সঙ্গে কিছু মালিকের সর্বদাই বিমাতাসুলভ আচরণে লিপ্ত।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্ট্যাডিজের (বিলস) এক গবেষণায় দেখা যায়, প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশের পোশাক শ্রমিকদের মজুরি সর্বনিম্ন। এমনকি ভারতের চেয়েও অনেক কম। ভারতে পোশাক শ্রমিকদের সর্বনিম্ন মজুরি বাংলাদেশি মুদ্রায় ১২,১৬০ টাকা (১২৮ ডলার) আর বাংলাদেশে ৮,০০০ টাকা (৭৫.৫ ডলার, প্রতি ডলার ১০৬ টাকা হিসেবে)। বিলসের গবেষণা অনুযায়ী, বাংলাদেশে বর্তমানে পোশাক খাতে ৩২ লাখ শ্রমিক কর্মরত। তাদের মাসিক ন্যূনতম মজুরি ৭৫.৫ ডলার বা ৮,০০০ টাকা।

প্রতিবেদনে দেখা যায়, বাংলাদেশ তৈরি পোশাক রপ্তানিতে বিশ্বে দ্বিতীয়। রপ্তানি আয়ের ৮২ শতাংশই আসে এই খাত থেকে। সংকটের মধ্যেও গত ডিসেম্বরে রপ্তানি আয়ে যে রেকর্ড হয়েছে তার ভিত্তিতে এই রিপোর্ট পেশ করা হয়। কিন্তু পোশাক খাতের প্রাণ এই শ্রমিকদের মজুরি এবং ভাতা প্রদানের ক্ষেত্রটা একেবারেই ন্যায়সম্মত নয়। তাহলে তাদের ভাগ্যের অমানিশা কীভাবে কাটবে? বাংলাদেশে পোশাক খাতে শ্রমিকদের মজুরি অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক কম। তার ওপর ঈদের আগেও যদি তাদের বেতন-বোনাস ঠিক মতো না দেওয়া হয়, তবে এর দায় কার?

শুধু পোশাক শ্রমিকই নয়, এ দেশে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে যুক্ত আছে লাখ লাখ কর্মী। শ্রমের বিনিময়ে ন্যূনতম মজুরি তাদের জন্য নির্ধারিত। ২০২২ সালের ৯-১৩ আগস্ট চা শ্রমিকদের ৩০০ টাকা পারিশ্রমিকের দাবিতে আন্দোলন-ধর্মঘটের পরিপ্রেক্ষিতে তাদের জন্য মজুরি নির্ধারিত হয় ৩০ টাকা বাড়িয়ে ১৭০ টাকা। দুর্মূল্যের বাজারে যা অতি নিম্ন। নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতিতে এই শ্রমিকদের সঙ্গে ঘটেছে প্রহসন। যেখানে চালের সর্বনিম্ন কেজি ৫৫ টাকা, সবচেয়ে কম মূল্যের মাছের দাম যেখানে কেজিতে ১৫০ টাকা, সেখানে এ ধরনের মজুরি নির্ধারণ কতটা যুক্তিসঙ্গত বিবেকসম্পন্ন জাতির কাছে তা প্রশ্নবিদ্ধ। তদুপরি যদি বছরের দুটি ঈদে শ্রমজীবী মানুষদের নির্ধারিত বেতন-বোনাস নিশ্চিত করা না যায় তবে হতভাগ্য জাতির ভবিষ্যৎ নিয়ে আরও শঙ্কিত হতে হয়।

দেশে বস্ত্রকল, চিনিকল, পাটকল, চা শ্রমিক থেকে শুরু করে সর্বস্তরের শ্রমিকদের যাতে ঈদে বেতন-ভাতা নিশ্চিত হয় সে লক্ষে সরকার এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে এগিয়ে আসতে হবে। শ্রমজীবী মানুষেরা যাতে ঈদুল ফিতর খুশি মনে উদযাপন করতে পারে সে জন্য মালিকদের কর্মতৎপরতা জরুরি। তৈরি পোশাকসহ প্রাতিষ্ঠানিক সব খাতের শ্রমিকদের বেতন-বোনাস ঈদের পূর্বে পরিশোধ করতে হবে। যদি তারা তা না করতে চান তবে সরকারকে অবশ্যই এ ব্যাপারে কার্যকরী ভূমিকা পালন করতে হবে। যেন কোনো শ্রমজীবী মানুষের পেটে লাথি না পড়ে সেদিকে নজর দিতে হবে।

ঈদ যেহেতু সবার ঘরে আনন্দ বয়ে আনে এবং সম্প্রীতির বার্তা প্রদান করে তাই ঈদের আগে শ্রমিকদের বেতন-বোনাস নিশ্চিত করতে হবে। যাতে তারা এই উৎসবের দিনটিকে ঘিরে পরিবার-পরিজন নিয়ে একটু শান্তিতে দিন কাটতে সক্ষম হয়। সন্তানকে একটি নতুন জামা উপহার দিতে পারে।

সম্প্রতির এই দিনকে ঘিরে সমাজের বৈষম্য দূর হোক। যারা এ সমাজের ঢাল হয়ে সব মানুষকে আগলে রাখার প্রচেষ্টায় রত, দেশের অর্থনীতিকে যারা ভঙ্গুর হতে দেয় না, মাথার ঘাম পায়ে ফেলে যারা নিজেদের সর্বোচ্চটা দিয়ে মালিকশ্রেণির দাসত্ব করে যায় সেই অসহায় মানুষদের প্রতি ন্যায় প্রতিষ্ঠা হোক। জেগে উঠুক মানবিক বোধ। ঈদের আগে শ্রমজীবী এ সব মানুষের মুখে একটু প্রশান্তির হাসি ফোটাতে তাদের বেতন-বোনাস শতভাগ প্রদান করা হোক। সম্প্রতির বন্ধন গড়ে উঠুক মালিক-শ্রমিকের মধ্যে।

লেখক : গবেষক ও শিক্ষক।
 

Link copied!