• ঢাকা
  • সোমবার, ১৭ মার্চ, ২০২৫, ৩ চৈত্র ১৪৩০, ১৬ রমজান ১৪৪৬

অভিযুক্তরা কীভাবে মনোনয়ন পান


কবির য়াহমদ
প্রকাশিত: অক্টোবর ২০, ২০২১, ০৩:১৫ পিএম
অভিযুক্তরা কীভাবে মনোনয়ন পান

ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাওয়া বেশ কজনকে নিয়ে বেশ আলোচনা চলছে। প্রথমে মনোনয়ন দিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সমালোচনার পর এদের কারও কারও মনোনয়ন বাতিলও করেছে দলটি। এই তালিকায় ত্রাণ বিতরণে অনিয়মের অভিযোগে অভিযুক্ত লোকজন যেমন আছে, তেমনি আছে একাধিক মামলার আসামি, আছে সাম্প্রদায়িক হামলার উসকানিদাতা, আছে বিএনপি-জামায়াত থেকে অনুপ্রবেশকারী, এমনকি একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে অভিযুক্তও।

আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী এবং বিতর্কিতদের মনোনয়নে সংক্ষুব্ধজনেরা এই ভেবে অন্তত সান্ত্বনা পেতে পারেন যে তাদের প্রতিবাদ ও সমালোচনা ব্যর্থ হয়নি। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় মনোনয়ন বোর্ড বিষয়টি গুরুত্ব দিয়েছে। বিতর্কিতদের কয়েকজনকে বাদ দিয়েছে। বাদ পড়াদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সাম্প্রদায়িক হামলায় অভিযুক্ত দুইজনসহ হবিগঞ্জের একাধিক মামলার আসামি। এর বাইরে অন্য কেউও থাকতে পারেন। নিবন্ধের আলোচ্য যখন অনুপ্রবেশকারী ও আদর্শিক স্খলন তখন সেদিকে যাচ্ছি না।

যে তালিকা ধরে প্রার্থীবিষয়ক চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত তার সুপারিশ যায় স্থানীয় পর্যায় থেকে। যারাই এই বিতর্কিত ও অনুপ্রবেশকারীদের তালিকা পাঠাচ্ছেন কেন্দ্রে, তাদের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের কোনো সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণের ইঙ্গিত অদ্যাবধি মেলেনি। সরকারি দল আওয়ামী লীগ ইউপি নির্বাচনের প্রার্থী বাছাইয়ে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সহায়তা নিয়েছে বলে গণমাধ্যম সূত্রে আমরা জেনেছি। তারপরেও কীভাবে একাধিক মামলার আসামি, বিএনপি-জামায়াত থেকে অনুপ্রবেশকারী, ত্রাণ বিতরণে অনিয়মের অভিযোগে অভিযুক্ত, সাম্প্রদায়িক হামলায় জড়িত ও একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে অভিযুক্তরা চূড়ান্ত মনোনয়ন পায়? তবে কি গোয়েন্দা তথ্য কাজ করেনি? কেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ বিতর্কিতদের পক্ষে কাজ করছে? এটা কি তাদের আদর্শিক স্খলন নয়?

অন্য অনেক সংবাদের সঙ্গে গণমাধ্যমে এসেছে সিলেটের একটি সংবাদও, যেখানে দেখা যায় কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা ছাত্রশিবিরের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ইমদাদ হোসেন ইমাদ একটি ইউনিয়নে পেয়েছেন আওয়ামী লীগের টিকিট। ইমাদ সংবাদ সম্মেলন করেও বিষয়টি অস্বীকার করলেও ছাত্রশিবিরের প্রকাশনাতেও ছিল তার নাম। এ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। এত আলোচনা সত্ত্বেও তার মনোনয়ন টিকে গেছে। তার পক্ষে সাফাই গেয়েছেন সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট নাসির উদ্দিন খানও। ‘আগে কেন সমালোচনা হয়নি’—এমন অনুযোগ করে নাসির উদ্দিন খান বলছেন, ‘অই এলাকায় একসময় আওয়ামী লীগ দুর্বল ছিল। অন্য দল থেকে লোক এনে দলকে শক্তিশালী করা হয়েছে।’ একটি শক্তিশালী সাংগঠনিক জেলার গুরুত্বপূর্ণ একজন নেতা যখন কোনো ধরনের রাখঢাক না রেখেই অনুপ্রবেশকারীদের পক্ষে সাফাই গান, তখন দলটির আদর্শিক অবস্থান প্রকাশ হয়ে যায়। আওয়ামী লীগ যে আগের নয়, এর চেয়ে বড় প্রমাণ আর কী হতে পারে!

বলতে পারেন, বক্তা এখানে একটা জেলা কমিটির নেতা, তিনি দলের নীতিনির্ধারণী কেউ নন। ব্যক্তি প্রসঙ্গে কথাটা হয়তো সত্য, কিন্তু কেন্দ্রের অবস্থা কি আলাদা কিছু? প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করি চট্টগ্রামের একটি আসনের এমপি আবু রেজা মুহাম্মদ নেজামুদ্দিন নদভীর কথা, যার বিরুদ্ধে অভিযোগ তিনি ছিলেন জামায়াতে ইসলামীর একজন নেতা। তবু আওয়ামী লীগ দলীয় এমপি হতে কোনো সমস্যা হয়নি তার। শীর্ষ পর্যায়ের অনেক আওয়ামী লীগ নেতাদের মধ্যে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল-আলম হানিফকে ফুলের তোড়া দিয়ে জামায়াতের লোকজনকে আওয়ামী লীগে যোগদান করাতে দেখেছি আমরা। আমরা কি দেখিনি বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা ইনাম আহমেদ চৌধুরীকে আওয়ামী লীগে যোগদান এবং দলটির উপদেষ্টা হয়ে যেতে? নাম উল্লেখ করতে গেলে এই তালিকা দীর্ঘ হয়ে যাবে নিশ্চিত। এটা কি আদর্শিক রাজনীতির চর্চা? কেবল তা-ই নয়, রাজনীতি না করা খেলোয়াড়-ব্যবসায়ীদের আওয়ামী লীগের মনোনয়নে এমপি করা হয়েছে, মেয়র করা হয়েছে, রাজনীতি না করা ব্যবসায়ীকে দেওয়া হয়েছে সম্পাদকীয় পদ। একজনের মৃত্যুতে তার পরিবারের অন্য সদস্যকে বানানো হচ্ছে এমপি। যেন পারিবারিক সম্পর্কই যোগ্যতার মাপকাঠি। অথচ এগুলো আওয়ামী লীগের রাজনীতির ধারা ছিল না।

আওয়ামী লীগ আওয়ামী লীগের রাজনীতির ধারার বাইরে যাওয়ার কারণে এখন দলটির মনোনয়নে পদ-পদবি পাওয়া সহজ হয়ে গেছে। ‘ত্যাগ’ শব্দটি মুষ্টিমেয় কিছু লোক ছাড়া অন্যদের জন্য হয়ে গেছে উপহাস্য। ফলে স্থানীয় পর্যায়ের মনোনয়নে ত্যাগীদের টপকে বিতর্কিত ও অনুপ্রবেশকারীরা সামনে চলে আসছে। কেবল মনোনয়নের ক্ষেত্রেই নয়, যেকোনো দুর্দিনে তৃণমূল থেকে শক্তি পাচ্ছে না আওয়ামী লীগ।

রামু, নাসিরনগর, শাল্লা, হেফাজতের তাণ্ডব, ভাস্কর্য ইস্যু, সাম্প্রতিক হিন্দুদের মন্দির-পূজামণ্ডপ ভাঙচুর, লুটপাট, হামলায় যা প্রকাশিত হয়েছে—এটা আওয়ামী লীগের জন্য অশনিসংকেত। নিঃসন্দেহে এটা তাদেরই কর্মফল।

কেন বলি কর্মফল? উত্তর আছে নিশ্চয়! কেন্দ্রের কাজের প্রভাব পড়েছে প্রান্তে। চলমান সাম্প্রদায়িক বিশৃঙ্খলার বিরুদ্ধে কঠোর হতে পারেনি সরকার। শুরুতেই কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ না করার খেসারত দিয়ে চলেছে সারা দেশের হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা। কুমিল্লার ঘটনায় ত্বরিত পদক্ষেপ নিলে চাঁদপুর, ফেনী, নোয়াখালী,  রংপুর, সিলেটসহ অন্যান্য স্থানে এমন ঘটনা ঘটত না।

আদর্শিক স্খলনের কথা বলছি জোর দিয়ে। এর প্রমাণও অনেক। ব্লগার ও অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট হত্যার সময়ে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসীদের পক্ষে যায় এমনও মন্তব্য করা হয়েছে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে। আমলার অপমানে মুক্তিযোদ্ধার আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে, জাতির পিতার ভাস্কর্য ভেঙে দেওয়ার প্রকাশ্য হুমকির পর তাদের দাবি পূরণ হয়েছে, সুপ্রিম কোর্টের ‘জাস্টিসিয়া’ ভাস্কর্য মৌলবাদীদের হুমকি ও দাবিতে সরানো হয়েছে, ধর্মীয় রাজনীতিকের চাপে পাঠ্যসূচিতে পরিবর্তন আনা হয়েছে,  হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় স্থাপনার ওপর হামলার বিচার হয়নি, রসরাজ-ঝুমনেরা বিনা অপরাধে জেল খেটেছে, বাউলদের ওপর নির্যাতন হচ্ছে, বাঙালির প্রাণের উৎসব নববর্ষ উদযাপন সীমিত করা হয়েছে। এমন অনেক কিছুই করা হয়েছে, যা প্রগতির পথে অন্তরায় হয়ে প্রতিক্রিয়াশীলদের আশকারা দিয়েছে।

এসব কি কেবলই দুর্বলতা, নাকি আদর্শিক স্খলন?  না, দুর্বলতা বলতে পারছি না। কারণ, এর প্রভাব এত দীর্ঘ মেয়াদের আর ধারাবাহিক হয় না। একে তাই আদর্শিক স্খলন হিসেবে দেখা ছাড়া উপায় কী? 

লেখক : সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক

Link copied!