মহামারি করোনায় গতি হারিয়েছে বাঙালির প্রাণের মেলা অমর একুশে বইমেলা। করোনা মোকাবিলায় বিপর্যস্ত পুরো বিশ্ব। তালিকা থেকে বাদ যায়নি বাংলাদেশও। প্রতিনিয়ত করোনার নতুন নতুন ধরনে হিমশিম খাচ্ছে সবাই। বছরের শুরুতে করোনার নতুন ধরন ওমিক্রন মোকাবিলায় ১১ দফা বিধিনিষেধ আরোপ করেছে সরকার। ফলে বইমেলা পেছাতে বাধ্য হয়েছে প্রশাসন। প্রতিবছরের মতো পয়লা ফেব্রুয়ারি বদলে সেটি শুরু হচ্ছে ১৫ ফেব্রুয়ারি। চলবে আগামী ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত।
এদিকে মেলার তারিখ নিয়ে হতাশা দেখা গেছে প্রকাশনা-সংশ্লিষ্ট ও বইপ্রেমীদের মধ্যে। পাঠকদের অভিমত, দীর্ঘ অপেক্ষায় থাকেন তারা বইমেলার জন্য। অন্যদিকে প্রকাশকেরা বলছেন, মেলাকে কেন্দ্র করে নতুন বইয়ে বিনিয়োগ করে থাকেন তারা। স্বল্প সময় মেলা হওয়ায় এবারও আর্থিক ক্ষতি দেখছেন তারা। আর মেলা কর্তৃপক্ষ বলছেন, মহামারি সবকিছু ওলটপালট করে দিচ্ছে। সরকার যেভাবে সিদ্ধান্ত দেবে, তা আমাদের মেনে নিতে হবে। আর প্রকাশকেরা বলছেন, মেলার তারিখ পেছানো আর স্বল্প সময়ে মেলা চললে অনেক প্রকাশনা আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়বে। পাশাপাশি মেলাকে ঘিরে বছরব্যাপী লগ্নি করা অর্থ উঠিয়ে আনা কঠিন হয়ে যাবে।
বাংলা একাডেমি সূত্রে জানা যায়, এবারের বইমেলা শর্ত সাপেক্ষে ১৫ থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হবে। এজন্য বইমেলার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একাডেমির সব কর্মকর্তা-কর্মচারী, লেখক, প্রকাশক, বিক্রেতা, স্টলের কর্মচারীসহ মেলা সংশ্লিষ্ট সব কর্মীকে ভ্যাকসিন গ্রহণসহ বয়স্কদের প্রয়োজনমতো বুস্টার ডোজ গ্রহণের অনুরোধ জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা মোতাবেক ভ্যাকসিন বুথ বসানোর জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরেও চিঠি দিয়েছেন।
ইত্যাদি গ্রন্থপ্রকাশের স্বত্বাধিকারী জহিরুল আবেদীন জুয়েল সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “গত বছর করোনায় বইমেলায় আমাদের যে আর্থিক ক্ষতি হয়েছে, তা এখনো পুষিয়ে নিতে পারিনি। এবারও যদি স্বল্প সময়ে মেলা অনুষ্ঠিত হয়, তাহলে প্রকাশনার ব্যবসা টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে যাবে।’’
জহিরুল আবেদীন জুয়েল আরও বলেন, “একটা স্টল প্রস্তুত করতে আমাদের অনেক টাকা খরচ হয়। আর স্টলটি ১৫ দিন রাখলে যে খরচ, এক মাস রাখলেও একই খরচ হবে। ফলে বাংলা একাডেমি যদি মেলা মাসের শেষ অর্ধেক করে, তাহলে আমাদের লোকসানের পরিমাণটা দ্বিগুণ হবে।”
স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকলে বইমেলায় পাঠক সমাবেশ কম হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন ‘কলম প্রকাশন’-এর কর্ণধার ওমর ফারুক। সংবাদ প্রকাশকে তিনি বলেন, “গত বছর সরকার লকডাউন দিয়ে বইমেলা খোলা রেখেছে। এবার করোনার এমন ভয়াবহ সময়ে বইমেলা করছে। একদিকে বিধিনিষেধ, অন্যদিকে নির্দিষ্ট সময়ের পরে শুরু হচ্ছে বইমেলা, যা পাঠকের কাছে একধরনের নেতিবাচক চিন্তা তৈরি করবে। সরকারের উচিত ছিল স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে নিশ্চিত করে মেলা নির্দিষ্ট সময়ে শুরু করে যথাসময়ে শেষ করা।”
এ বিষয়ে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক মুহম্মদ নূরুল হুদা সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “হঠাৎ করে করোনার সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় বইমেলা নিয়ে আমাদের নতুন করে সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। ১৫ ফেব্রুয়ারি শুরু হয়ে সেটি চলবে আগামী ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। বইমেলা নিয়ে আগের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আমরা কাজ করছি। তখন কিছু শর্তের মধ্যে ছিল- বইমেলায় অংশগ্রহণকারী সবার করোনা টিকা সনদ নিশ্চিত করতে হবে। আমরা প্রকাশকদের ভ্যাকসিন নেওয়ার বিষয়টি অবহিত করে চিঠি দিয়েছি। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা মোতাবেক ভ্যাকসিন বুথ বসানোর জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরেও চিঠি দিয়েছি।”
বইমেলার যাত্রা শুরু হয় ৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২ সালে মুক্তধারার স্বত্বাধিকারী চিত্তরঞ্জন সাহার হাত ধরে। তিনি সেবার বাংলা একাডেমির বর্ধমান হাউস প্রাঙ্গণে বটতলায় এক টুকরো চটের ওপর বসেন বই নিয়ে। সে সময় কলকাতা থেকে আনা ৩২টি বই সাজিয়ে বইমেলার গোড়াপত্তন করেন তিনি। এইভাবে ১৯৭২ থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত তিনি একাই বইমেলা চালিয়ে যান। ১৯৭৮ সালে বাংলা একাডেমির সে সময়ের মহাপরিচালক আশরাফ সিদ্দিকী বাংলা একাডেমিকে মেলার সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত করেন। ১৯৭৯ সালে মেলার সঙ্গে যুক্ত হয় বাংলাদেশ পুস্তক বিক্রেতা ও প্রকাশক সমিতি। এই সংস্থাটিও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন চিত্তরঞ্জন সাহা। ১৯৮৩ সালের পয়লা ফেব্রুয়ারি মনজুরে মওলা বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হিসেবে বাংলা একাডেমিতে প্রথম অমর একুশে গ্রন্থমেলার আয়োজন করেন। সেই থেকে ফেব্রুয়ারি মাসের ১ তারিখ থেকে বইমেলা হয়ে আসছে।