• ঢাকা
  • সোমবার, ০৬ মে, ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১, ২৭ শাওয়াল ১৪৪৫

স্বাদে অনন্য পুরান ঢাকার ‘টাকি পুরি’


সোহানুর রহমান, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২০, ২০২৩, ০৪:২৮ পিএম
স্বাদে অনন্য পুরান ঢাকার ‘টাকি পুরি’

বাহারী খাবার, ঐতিহ্যবাহী স্থাপনার জন্য বরাবরই বিখ্যাত পুরান ঢাকা। প্রায় ৪০০ বছর ধরে সুস্বাদু নানা পদের খাবারের জন্য এই এলাকার সুনাম রয়েছে। তেমনি এক জনপ্রিয় খাবার ‘টাকি পুরি’। ডাল পুরি, আলু পুরির নাম সবার কাছে পরিচিত হলেও অনেকেই জানে না টাকি মাছের তৈরি এ টাকি পুরির নাম।

রাজধানীর পুরান ঢাকার ওয়ারী এলাকার টিপু সুলতান রোডের খাঁন হোটেলে সুস্বাদু এ টাকি পুরির খোঁজ মিলবে। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলেই প্রায় প্রতিদিন এই হোটেলের সামনে মানুষের উপচে পড়া ভিড় দেখা যায়। হোটেলটির সামনে সারি সারি সাজিয়ে রাখা থাকে পুরি, পিঁয়াজু, আলুর চপ, বেগুনি, চিকেন চপ, ছোলা, ডাবলি বুট ও গরম গরম জিলাপি। কিন্তু সিংহভাগ গ্রাহকের নজর ওই টাকি পুরির দিকে। এখানে পুরি খেতে আসা অনেকেই এসেছেন দূর দূরান্ত থেকে। নিয়মিত অনিয়মিত অনেকের মুখেই এই পুরির সুনাম ছড়িয়েছে বিস্তর। টাকি পুরির স্বাদই এর প্রধান বিশেষত্ব।

টিপু সুলতান রোডের জোড়পুল বাজারের মুখেই গড়ে ওঠা ‘খাঁন হোটেল’ এর বয়স ষাটোর্ধ্ব। হোটেলটির প্রতিষ্ঠাতা ইসমাইল খান অনেক আগেই মারা গেছেন। বর্তমানে হোটেলটি দেখভাল করছেন তার ছেলে মো. বিল্লাহ খান। বংশ পরমপরায় আগে নানা ধরনের পুরি বিক্রি হলেও টাকি পুরির এই রেসিপি তারই আবিষ্কার। টাকি মাছ দিয়ে পুরি হয় এটা কেউ ভাবতে না পারলেও এমনটিই করে দেখিয়েছেন তিনি। শুনতে নতুন মনে হলেও টাকি পুরির বয়স প্রায় ১৫ বছর।

টাকি পুরির আদ্যোপান্ত জানতে চাইলে বিল্লাল খান জানান, বিক্রির উদ্দেশ্যে নয় বরং নিজে খাওয়ার জন্যই হুট করে একদিন টাকি পুরি তৈরি করা হয়। বাড়িতে স্ত্রীর বানানো সুস্বাদু টাকি মাছের ভর্তা খেতে খেতে চিন্তা আসে টাকি মাছের পুরির। টাকি পুরির স্বাদে মুগ্ধ হয়েই দোকানে বিক্রির চিন্তা আসে। তখন থেকেই এই পুরির যাত্রা শুরু হয়।

তিনি আরও জানান, টাকি পুরির বিক্রির শুরু হতেই এমন অভূতপূর্ব সাড়া পাওয়া যায়। প্রথম দিন থেকেই টাকি পুরি গ্রাহকদের মন জয় করে নিয়েছে। তাছাড়া রান্নায় যে তেল ব্যবহার করা হয় তা একদম পিওর। একদিনের তেল আরেকদিন ব্যবহার করা হয় না বলে স্বাদটা হয় ভিন্ন। এখন তো দূর-দূরান্ত থেকেও মানুষ এই টাকি পুরির স্বাদ নিতে ছুটে আসছে।

১০ বছর ধরে দোকানটিতে কাজ করছেন মোহাম্মদ হানিফ। রেসিপি প্রসঙ্গে তিনি জানান, সম্পূর্ণ ঘরোয়া পরিবেশে টাকি পুরির জন্য যেসব টাকি মাছ সংগ্রহ করা হয় সেগুলোর কাঁটা সূক্ষ্ম ও সুনিপুণভাবে আলাদা করা হয়। পরে কাটা ছাড়িয়ে টাকি মাছ সিদ্ধ করে তেলে ভেজে নেওয়া হয়। এরপর কাঁচা মরিচ, সিদ্ধ আলু, ধনেপাতা, পেঁয়াজ ও স্পেশাল মসলা মিশিয়ে বানানো হয় কিমা। ময়দার মধ্যে কিমা গুজে দিয়ে তেলে ভাজা হয় এই টাকি পুরি। ভাজার পর তেল ছেঁকে আলাদা হওয়ার পর পরিবেশন করা হয় টাকি পুরি।

তিনি আরও জানান, শীতে টাকি মাছ সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায় বলে এই সময় পুরিতে মাছের পুরের পরিমাণও বেশি থাকে। শীতকালে নতুন কাঁচামরিচ, ধনে পাতা, কাঁচা পেঁয়াজ ইত্যাদির সংমিশ্রণে পুরির স্বাদ বেড়ে যায় বহুগুণ।

এই পুরির সঙ্গে খাবারের জন্য দেওয়া হয় বিশেষ এক ধরনের চাটনি। চাটনি তৈরিতে ব্যবহার করা হয় টকদই, সরষেবাটা, ধনেপাতা ও কাঁচা মরিচ। চাইলে সঙ্গে নিতে পারবেন টমেটো সস। প্রতিটি টাকি পুরি দাম ১০ টাকা। আকারেও বেশ বড়। প্রতিদিন প্রায় হাজারের অধিক টাকি পুরি বিক্রি হচ্ছে বলে জানান হোটেলের কর্মচারীরা। হোটেলটিতে বর্তমানে প্রায় ৭০ জন কর্মচারী রয়েছে।

হোটেলটিতে টাকি পুরির পাশাপাশি চিকেন পুরি, ডাল পুরি, আলু পুরি, পিঁয়াজু, বেগুনি, আলুর চপসহ অনেক ধরনের খাবার পাওয়া যায়। এছাড়া এখানে চিকেন চাপ, ছোলা বোট, ঘুঘনি এবং জিলাপিও পাওয়া যায়।

ওয়ারি এলাকার বাসিন্দা সোহান শেখ পুরি খেতে খেতে বলেন, এখানকার টাকি পুরিগুলো খেতে খুবই মজা। প্রায় সময় বিকেলে এখানে পুরি খেতে আসা হয়। গরম গরম পাওয়া যায়। তাই ফুঁ দিয়ে খেতে হয়।

মোহাম্মদ মহিউদ্দিন বংশাল থেকে টিপু সুলতান রোডে এসেছেন টাকি পুরি খেতে। তিনি বলেন, “এই পুরি খেতে অনেক সুস্বাদু। খুব মজার একটা খাবার এটা। বিকেলের নাস্তায় আমার খুব প্রিয়। ১০ টাকার এই পুরি একটা পেট ভরে যায়। মাঝে মাঝে প্রতি সপ্তাহেই এখানে আসা হয়। এটি পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী খাবারও বটে।”

সূত্রাপুর থেকে বন্ধুদের নিয়ে টাকি পুরি খেতে এসেছেন লামিম আহমেদ। তিনি বলেন, “আমরা নিয়মিত এখানে আসি। ১০ টাকায় অনেক মজার পুরি পাওয়া যায়। আমরা বন্ধুবান্ধবরা সবাই বলি, পুরির রাজা টাকি পুরি।”

রাজশাহী থেকে টাকি পুরি খেতে এসেছেন মো. ওয়াসিম রেজা। তিনি বলেন, “অনেক আগে থেকেই এই পুরিটি। শুনেছি অনেক, কিন্তু আজ এসেছি, পুরিও খেয়েছি। এখানে অনেক ভিড়। পুরি খেতে খুব ভালো লাগছে।”

বিল্লাহ বলেন, “আমার ব্যবসায় লাভ খুব সামান্য। অনেকেই পরিমাণে কম দিয়ে লাভ বেশি করে- বিষয়টি আমার ভালো লাগে না। হাতের নাগালের মধ্যে আমার এখানে সব পাওয়া যায় বলে ক্রেতার ভিড় লেগেই থাকে।”

৮ বছর ধরে দোকানটিতে ম্যানেজারের দায়িত্ব পালন করছেন শওকত ওসমান। তিনি জানালেন, পুরান ঢাকায় একমাত্র খাঁন হোটেলেই পাওয়া যাবে বিখ্যাত এ টাকি পুরি ৷ বৃষ্টি ও শীতের সময় টাকি পুরির চাহিদা দ্বিগুণ হারে বেড়ে যায়। সাধারণত দিনে হাজার থেকে ১২শ টাকি পুরি বিক্রি হয়। শীতের সময় ১ হাজার ৫০০ থেকে ১ হাজার ৬০০ পুরি বিক্রি হয়ে থাকে। বিকেল ৪টা থেকে রাত সাড়ে ৮টা পর্যন্ত টাকি পুরি পাওয়া যায়।

তিনি আরও জানান, দোকানে এসে অনেকে টাকি পুরি খায়, কেউবা পার্সেল নিয়ে যায় এমনকি পাঠাওফুড, ফুডপান্ডা এবং হাঙ্গরিনাকি ডট কমে সহজে অর্ডার করেও খাঁন হোটেলের টাকি পুরি নেওয়া যায়।

Link copied!