• ঢাকা
  • সোমবার, ০৬ মে, ২০২৪, ২৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ শাওয়াল ১৪৪৫

এ বছর শীত বেশি অনুভূত হওয়ার কারণ


সংবাদ প্রকাশ ডেস্ক
প্রকাশিত: জানুয়ারি ১৭, ২০২৪, ০২:২৯ পিএম
এ বছর শীত বেশি অনুভূত হওয়ার কারণ
তীব্র শীতে আগুন পোহাচ্ছে রংপুরের মানুষ। ফাইল ছবি

এ বছর ঢাকাসহ সারা দেশে শীতের তীব্রতা বেড়েছে। রাজধানীবাসীর অনেকেই বলছেন এবারের মতো শীত আর কখনো অনুভূত হয়েছে বলে মনে পড়ছে না তাদের। শীতের তীব্রতায় জনজীবনে তৈরি হচ্ছে নানা রকমের সংকট। শ্রমিক শ্রেণির মানুষ তাদের দৈনন্দিন জীবিকা নির্বাহ করতে কষ্টকর পরিস্থিতিতে পড়েছেন। বিভিন্ন এলাকায় বেড়েছে শীতজনিত রোগ। এ ছাড়া উত্তর জনপদের মানুষ বেশি ভোগান্তিতে পড়েছেন শীতের তীব্রতায়। চলতি মৌসুমে কয়েকটি জেলায় তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নেমে যায়। এতে চরম ভোগান্তিতে পড়েন এসব এলাকার মানুষ।

আবহাওয়াবিদরা জানালেন, এবার শীতের তীব্রতা বেড়ে যাওয়ার কারণ। তারা বলছেন, খাতা-কলমে তাপমাত্রা খুব একটা না কমলেও বেশ কিছু কারণে এবারের শীত বেশি অনুভূত হচ্ছে। পুরো জানুয়ারি মাসজুড়েই শীতের এমন অনুভূতি থাকতে পারে বলে জানান তারা।

অধিদপ্তর জানায়, এ বছর শীত বেশি অনুভূত হওয়ার আরও একটি কারণ হলো দীর্ঘ সময় ধরে কুয়াশা থাকা। এ কারণে এ বছর শীত বেশি অনুভূত হচ্ছে। সারা দেশে অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার দীর্ঘ সময় ধরে ঘন কুয়াশা পড়ছে। কোথাও কোথাও ১৮ থেকে ২০ ঘণ্টা পর্যন্ত কুয়াশা থাকছে।

আবহাওয়াবিদ ড. মুহাম্মদ আবুল কালাম মল্লিক জানান, দীর্ঘ সময়ের কুয়াশার কারণে সূর্যের কিরণকাল কমে এসেছে। অর্থাৎ সূর্য বেশিক্ষণ আলো দিতে পারছে না। স্বাভাবিক সময়ে সূর্যের কিরণকাল ৮ থেকে ১২ ঘণ্টা হলেও এখন তা কমে এসেছে ৩ থেকে ৪ ঘণ্টায়। এতে ভূপৃষ্ঠ উত্তপ্ত হতে না পারায় দিনের ও রাতের তাপমাত্রার পার্থক্য অনেকটাই কমে গেছে। ফলে শীতও বেশি অনুভূত হচ্ছে। এ বছর দিনের তাপমাত্রা ২ থেকে ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত কমতে দেখা গেছে। বিশেষ করে ১১ই জানুয়ারির পর থেকে এটি বেশ কমে এসেছে।

রাজধানীর সবুজবাগের এলাকার বাসিন্দা শিল্পী বেগম জানান, ২০০৮ সাল থেকে ঢাকায় থাকি। কোনো বছর এত শীত অনুভব হয়নি। এবারের শীতে হাড় পর্যন্ত কাঁপছে।

বাসাবো এলাকার বাসিন্দা মো. আসাদ মিয়া জানান, এবারের শীতে রুটিরুজিতে হাত পড়েছে। বাসাবো বালুর মাঠে প্রতিদিন ব্যবসা করি। শীতের কারণে গ্রাহক কমে গেছে। বিক্রিও আগের মতো নেই। নিজের খরচ তুলতে পারছি না।

মালিবাগের বাসিন্দা অমল চন্দ্র বলেন, “শীতের কারণে বাইরে মানুষের চলাফেরা কমে গেছে। ফুটপাতে ব্যবসা করি। আগের মতো কাস্টমার নাই। বিক্রিও নাই। অল্প বিক্রি দিয়ে খরচের টাকা রোজগার হয় না। চলতে কষ্ট হচ্ছে।”

এদিকে আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে, ভিন্ন কথা। প্রতিষ্ঠানটির হিসেবে দেখা যাচ্ছে, সাম্প্রতিক বছরগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি শীত পড়েছে ২০১৮ সালে।

ওই বছরের আটই জানুয়ারি পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায় তাপমাত্রা নেমেছিল ২ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসে, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বনিম্ন রেকর্ড। সে বছর সারা দেশে দফায় দফায় তীব্র শৈত্যপ্রবাহও দেখা গিয়েছিল। সেখানে এ বছর এখন পর্যন্ত কোনো জেলাতেই তীব্র শৈত্যপ্রবাহ দেখা যায়নি। এ তথ্য জানাচ্ছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। কিন্তু তবু মানুষ কেন অস্বাভাবিক শীতের কথা বলছে?

মূলত কোনো অঞ্চলের সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রার পার্থক্য যদি ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে আসে, সেখানে শীতের অনুভূতি বাড়তে থাকে। আর পার্থক্য যদি ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নেমে আসে, তাহলে সেখানে শীতের অনুভূতি অতি তীব্র থেকে তীব্রতর হয়।

অপরদিকে গত এক সপ্তাহে দেশের বিভিন্ন জেলার সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রার তুলনা করে দেখা গেছে রংপুর, দিনাজপুর, তেঁতুলিয়ার মতো উত্তরবঙ্গের বেশিরভাগ অঞ্চলেই তাপমাত্রার পার্থক্য ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কম। অন্যদিকে ঢাকা, বগুড়া, ময়মনসিংহ ও সিলেট অঞ্চলে তাপমাত্রার পার্থক্য ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে।

এবার কুয়াশা বাড়ল কেন
বায়ুর মান পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা আইকিউ এয়ারের সূচকে সম্প্রতি বেশ কয়েকবারই ঢাকাকে শীর্ষ দূষিত শহরের তালিকায় দেখা গেছে। যানবাহন, ইটভাটা ও শিল্পকারখানার দূষিত ধোঁয়ার পাশাপাশি নির্মাণকাজের সংখ্যা বৃদ্ধিসহ নানান কারণে সারা দেশেই আগের চেয়ে বায়ু দূষণ বেড়েছে বলে গবেষণায় বলা হচ্ছে।

এর মধ্যেই আবার জানুয়ারি মাসে দিল্লিসহ ভারতের বিভিন্ন রাজ্য থেকে দূষিত বায়ু প্রবেশের পরিমাণ বেড়েছে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।

দূষিত এই বাতাসে প্রচুর পরিমাণে ধূলিকণা মিশে রয়েছে, যা মেঘ ও কুয়াশা তৈরিতে নিয়ামক হিসেবে ভূমিকা রাখছে বলে গণমাধ্যমকে জানান ড. মুহাম্মদ আবুল কালাম মল্লিক।

গত দুই সপ্তাহে রাজশাহী, রংপুর, ময়মনসিংহ, সিলেটের বেশি কিছু এলাকায় বিকেল পর্যন্ত কুয়াশা দেখা গেছে। কোথাও কোথাও কুয়াশা বেশি থাকায় সারা দিনে একবারও সূর্যের মুখ দেখা মেলেনি।

হিমালয়ের বাতাস
পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশজুড়ে উচ্চচাপ বলয় তথা বাতাসের চাপ বেশি থাকার কারণে হিমালয়ের পাদদেশ থেকে উত্তর প্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, বিহার ও পশ্চিমবঙ্গ হয়ে শীতের ঠান্ডা বাতাস উত্তর ও উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করায় শীতের অনুভূতি তীব্র হচ্ছে বলে জানান আবহাওয়াবিদ ড. মুহম্মদ আবুল কালাম মল্লিক। 

তিনি বলেন, যেহেতু পশ্চিমাঞ্চল অর্থাৎ পশ্চিবঙ্গজুড়ে উচ্চচাপ বলয় সক্রিয় আছে, ফলে বায়ুচাপ বাংলাদেশের দিকে প্রবেশ করছে। বাতাসের গতিবেগ তুলনামূলকভাবে একটু বেশি থাকার কারণে রাজশাহী, রংপুর, ময়মনসিংহ, সিলেট এবং ঢাকার পশ্চিমাঞ্চল ও খুলনার ওপরের দিকে যশোর, সাতক্ষীরা, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গার এসব অঞ্চলে শীতের অনুভূতি তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে।

এ ছাড়া ঊর্ধ্ব আকাশের বাতাস খুব ঠান্ডা হওয়ায় কোনো কোনো ক্ষেত্রে জেড স্ট্রিম বা প্রচণ্ড গতিবেগ সম্পন্ন বাতাস কখনো নিচে নেমে আসছে, কখনো ওপরে উঠে যাচ্ছে। এর ফলে শীত বেশি অনুভূত হচ্ছে। চলতি মাসের পুরোটা জুড়েই শীতের এমন অনুভূতি থাকতে পারে বলে জানান এই আবহাওয়াবিদ।

শীতে স্বাস্থ্যঝুঁকি
বায়ুদূষণের কারণে অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার সারা দেশেই বেশি কুয়াশা দেখা যাচ্ছে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। ধূলিকণাময় এই কুয়াশা শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে শরীরে ঢুকলে নানা ধরনের স্বাস্থ্য ঝুঁকি তৈরি হতে পারে।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের শিক্ষক ডা. শাহনূর শরমিন গণমাধ্যমকে বলেন, বাংলাদেশে এখন আমরা আগের চেয়ে বেশি ফুসফুসের সমস্যা ও অ্যালার্জিজনিত রোগ দেখতে পাচ্ছি। কুয়াশায় মিশে থাকা ধূলিকণা এসব রোগীদের শ্বাসযন্ত্রে ঢুকলে জটিলতা আরও বাড়তে পারে। এ ছাড়া যাদের শ্বাসকষ্ট বা এলার্জিজনিত রোগ নেই, ধূলিকণা সমৃদ্ধ কুয়াশা শরীরে ঢুকলে তারাও এসব রোগে আক্রান্ত হতে পারেন। সে জন্য কুয়াশার মধ্যে বাইরে বের হলে অবশ্যই মাস্ক পরে বের হতে হবে। পাশাপাশি শিশুদের ক্ষেত্রে একটু বাড়তি সতর্কতা অবলম্বনের পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। গরম কাপড় পরানোর পাশাপাশি শিশুদেরও মাস্ক পরাতে হবে। কুয়াশার মধ্যে বাইরে বের না হতে দেওয়াটাই উত্তম।

বৃষ্টি 
কয়েক দিনের মধ্যে বৃষ্টি হতে পারে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। অধিদপ্তর বলছে, আগামী কয়েক দিন দেশের বিভিন্ন জেলায় আকাশ আংশিক মেঘলা থাকতে পারে। শুক্রবার নাগাদ ঢাকা, খুলনা, রাজশাহী ও বরিশাল বিভাগে অস্থায়ীভাবে দমকা হাওয়ার সঙ্গে গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ফলে এই সময়ে তাপমাত্রা আরও কমে আসতে পারে।

এছাড়া রাতে সারাদেশে মাঝারি থেকে ঘন কুয়াশা পড়তে পারে, যা কোথাও কোথাও দুপুর পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে। তাপমাত্রা ৮ থেকে ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস হলে সেটিকে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ বলা হয়। ৬ থেকে ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নামলে মাঝারি শৈত্যপ্রবাহ এবং ৪ থেকে ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে থাকলে সেটিকে তীব্র শৈত্যপ্রবাহ বলা হয়। আর তাপমাত্রা ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নেমে গেলে হয় অতি তীব্র শৈত্যপ্রবাহ। তবে এ বছর দেশের কয়েকটি জেলায় মৃদু শৈত্যপ্রবাহ দেখা গেলেও তা তীব্র আকার ধারণ করেনি। জানুয়ারির শেষের দিকে সারা দেশে মৃদু বা মাঝারি ধরনের শৈত্যপ্রবাহ দেখা যেতে পারে।

Link copied!