• ঢাকা
  • শনিবার, ০৪ মে, ২০২৪, ২২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৪ শাওয়াল ১৪৪৫
উপজেলা নির্বাচন

দলের কথা শুনছে না কেউ


সফিকুল ইসলাম
প্রকাশিত: এপ্রিল ২২, ২০২৪, ০৯:৪২ পিএম
দলের কথা শুনছে না কেউ

উপজেলা নির্বাচনে তৃণমূলে মন্ত্রী-এমপিদের স্বজনদের সরে দাঁড়ানোর আওয়ামী লীগের কঠোর বার্তা কাজে আসছে না। তবে প্রথমপর্বে নাটোরের সিংড়ার তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকের শ্যালক লুৎফুল হাবিব ছাড়া গুরুত্বপূর্ণ কোনো স্বজনই মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করেননি। এমনকি দলের নির্দেশনাও মানছেন না কেউ। 
তবে দলীয় সূত্রগুলো বলছে, উপজেলা নির্বাচনে মন্ত্রী-এমপির স্বজনদের মধ্যে প্রার্থী হয়েছেন ২৫ জনের মতো। এর মধ্যে প্রথমপর্বে আছেন ১৫ জন। বাকিরা অন্য পর্বে থাকবেন। এই ১৫ জনের মধ্যে একমাত্র রুবেল ছাড়া কেউ মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করেননি। তারা নানা অজুহাতে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেননি। যে তালিকায় রয়েছেন অনেক মন্ত্রী-এমপির স্বজন ও দলের পদ-পদবী ধারি নেতাকর্মীও।

সাবেক মন্ত্রী ড. রাজ্জাকের দুই ভাই
প্রধানমন্ত্রীর কঠোর নির্দেশনার পরও ধনবাড়ী উপজেলা পরিষদ নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াননি আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য এবং সাবেক মন্ত্রী ড. মো. আব্দুর রাজ্জাকের খালাতো ও চাচাতো মামাতো ভাই। আব্দুর রাজ্জাকের খালাতো ভাই হচ্ছেন, ধনবাড়ী উপজেলা পরিষদের বর্তমান চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি হারুন অর রশিদ হীরা।

অন্যদিকে, মামাতো ভাই হচ্ছেন ধনবাড়ী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. মঞ্জুরুল ইসলাম তপন। তারা দুইজনই নির্বাচনী মাঠে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সিদ্ধান্তে অটল আছেন। একইভাবে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মাদারীপুর-১ আসনের এমপি শাজাহান খানের ছেলে আসিবুর রহমান খান সদর উপজেলায় প্রার্থী হয়েছেন। তিনিও শেষ পর্যন্ত প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেননি।

মাঠ না ছাড়ার ঘোষাণা একরাম পুত্রের
নোয়াখালী-৪ (সদর-সুবর্ণচর) আসনের সংসদ সদস্য একরামুল করিম চৌধুরীর একমাত্র পুত্র আতাহার ইসরাক শাবাব চৌধুরী সুবর্ণচর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা থাকলেও প্রত্যাহারের শেষ সময়েও তিনি মনোনয়ন প্রত্যাহার করেননি বলে রিটার্নিং কর্মকর্তা নিশ্চিত করেছেন। এ বিষয়ে এমপিপুত্র আতাহার ইসরাক সাবাব চৌধুরীর বলেন, এমপি পুত্র ছাড়াও আমি এদেশের নাগরিক। এলাকার নাগরিক হিসেবে ভোট করার অধিকার আমার রয়েছে।

তবে এক ভিডিওবার্তায় একরামুল করিম চৌধুরী প্রশ্ন তুলেছেন এমপি-মন্ত্রীর সন্তানেরা রাজনীতি না করলে, রাজাকারের সন্তানেরাই কি আওয়ামী লীগের দায়িত্ব নেবে? তিনি বলেন, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সুবর্ণচর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান এএইচএম খায়রুল আনম সেলিম নৌকার বিরুদ্ধে ভোট করেছেন। আমি সাংগঠনিকভাবে তার বিচার চেয়েছি। জানতে চাইলে নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি এএইচএম খায়রুল আনম সেলিম বলেন, দলীয় সভাপতি নির্দেশনা দিয়েছেন। কেউ অমান্য করলে তার বিরুদ্ধে দলীয় গঠনতন্ত্র মোতাবেক ব্যবস্থা নিবে।

নির্বাচন করছেন সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রীর ফুপাতো
মানিকগঞ্জ সদর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে মাঠে শেষ পর্যন্ত থাকার ঘোষণা দিয়েছেন মানিকগঞ্জ-৩ (সদর ও সাটুরিয়া) আসনের এমপি ও সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের আপন ফুপাতো ভাই ইসরাফিল হোসেন। তিনি সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। দুই দফায় তিনি দলীয় প্রতীক (নৌকা) নিয়ে চেয়ারম্যানের নির্বাচিত হয়েছিলেন।

এ বিষয়ে ইসরাফিল হাসেন বলেন, আমার মনে হয় না দলীয় সিদ্ধান্ত আমার জন্য প্রযোজ্য হবে? কারণ আমি জেলা আওয়ামী লীগের দুইবারের সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য। দুইবারের উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। দল আমাকে দুইবার মনোনয়ন দিয়েছিল, আমি বর্তমান উপজেলা চেয়ারম্যান হিসেবে আছি। সেই ক্ষেত্রে আমার মনে হয় না দলীয় ভাবে নেওয়া এই সিদ্ধান্ত আমার জন্য কোনও বাধা হবে।

মানিকগঞ্জ সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আরও বলেন, আমরা যখন রাজনীতিতে আসি, আমাদের এমপি সাহেব (ফুপাতো ভাই-জাহিদ মালেক) আমার বিশ বছর পর রাজনীতিতে এসেছেন। আমার ধারণা নেত্রী এমন কোনো সিদ্ধান্ত নেবেন না, যা তৃণমূলের নেতাকর্মীদের মাঝে ক্ষোভ সৃষ্টি হবে। আমি নির্বাচনে অবশ্যই থাকবো, এলাকার জনগণ আমাকে পুণরায় বিপুল ভোটে নির্বাচিত করবেন বলে প্রত্যাশা করি।

মনোনয়ন প্রত্যাহার করেননি এমপির ছোট ভাই
চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা উপজেলা নির্বাচনে চুয়াডাঙ্গা-২ আসনের সংসদ সদস্য আলী আজগর টগরের ছোট ভাই উপজেলা চেয়ারম্যান আলী মুনসুর বাবু মনোনয়ন তার প্রত্যাহার করেননি। অর্থাৎ শেষ পর্যন্ত নির্বাচনী মাঠে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্তে অটল রয়েছেন। তবে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়ে সংসদ সদস্য আলী আজগর টগরের ভাতিজা মোহা. সহিদুল ইসলাম মনোনয়ন প্রত্যাহার করেছেন। আওয়ামী লীগ সভাপতির নির্দেশনাকে শ্রদ্ধা জানিয়ে তিনি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। পলাশ উপজেলা নির্বাচনে প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ দিন কেউ মনোনয়ন পত্র প্রত্যাহার করেননি।

নির্বাচনের মাঠে এমপির স্ত্রীর বড় ভাই
প্রথম ধাপে নরসিংদীর পলাশ উপজেলা নির্বাচনে প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ দিনেও প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেননি চেয়ারম্যান প্রার্থী ঘোড়াশাল পৌরসভার সাবেক মেয়র আলহাজ্ব শরীফুল হক। সম্পর্কে তিনি স্থানীয় সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আশরাফ খান দিলীপের স্ত্রীর বড় ভাই (সম্বন্ধি)। এছাড়া এই উপজেলায় কেউ মনোনয়ন পত্র প্রত্যাহার করেননি। চেয়ারম্যান পদে তিন জন, ভাইস চেয়ারম্যান পদে তিনজন ও সংরক্ষিত মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে দুইজন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন।

বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত এমপির চাচা
আপিলে মনোনয়ন বৈধতা ফিরে পান মুন্সীগঞ্জ সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান প্রার্থী মুন্সীগঞ্জ-৩ আসনের সতন্ত্র সংসদ সদস্য মোহাম্মদ ফয়সাল বিপ্লবের চাচা আনিছ উজ্জামান আনিস। নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে আর কোনো প্রার্থী না থাকায় এবার তিনি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় চেয়ারম্যান হতে চলেছেন। তিনি জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মো. মহিউদ্দিনেরও ছোট ভাই। এদিকে আনিছউজ্জামান আনিস সদর উপজেলা চেয়ারম্যান পদে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ায় উপেক্ষিত হলো আওয়ামী লীগের নির্দেশনা।

কালীগঞ্জে চাচা-ভাতিজার লড়াই
লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী হয়েছেন লালমনিরহাট-২ আসনের সংসদ সদস্য ও সাবেক সমাজকল্যাণ মন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদের ছোট ভাই বর্তমান চেয়ারম্যান মাহবুবুজ্জামান আহমেদ ও পুত্র রাকিবুজ্জামান আহমেদ। গত রোববার (২১ এপ্রিল) বিকেলে অনলাইনের মাধ্যমে মনোনয়নপত্র দাখিল করেন এমপিপুত্র রাকিবুজ্জামান আহমেদ। এর আগে শনিবার মনোনয়নপত্র দাখিল করেন এমপির ছোটভাই মাহবুবুজ্জামান আহমেদ। মাহবুবুজ্জামান কালীগঞ্জ উপজেলা পরিষদের বর্তমান চেয়ারম্যান এবং জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য। এদিকে ভোটের মাঠে চাচা-ভাতিজা কেউ কাউকে ছাড় দিতে নারাজ। এ নিয়ে ভোটারদের মাঝেও রয়েছে ব্যাপক কৌতূহল। তবে ভোটাররা জানান, চাচা-ভাতিজা দুজন প্রার্থী হওয়ায় তারা কাকে ভোট দেবেন, এ নিয়ে বিড়ম্বনায় পড়েছেন অনেকে। বিপাকে পড়েছেন তাদের আত্মীয়-স্বজনরাও।

দলীয় সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে ভোট করছেন সিরাজগঞ্জ-১ আসনের এমপি প্রকৌশলী তানভীর শাকিল জয়ের আপন চাচাতো ভাই মো. রাশেদ ইউসুফ জুয়েল। তিনি নেতাকর্মীদের জানান দিচ্ছেন যে, তানভীর শাকিল জয় তাকে সমর্থন দিয়েছেন। চালিয়ে যাচ্ছেন নিজের প্রচার-প্রচারণা। এতে নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হওয়া নিয়ে আশঙ্কা করছেন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা। এজন্য উপজেলায় সাধারণ নেতাকর্মীর মধ্যে ক্ষোভ ও বিভক্তি দেখা দিয়েছে। পাশাপাশি জুয়েলের বাবা আবু ইউসুফ সূর্য সিরাজগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি। তিনি এমপি তানভীর শাকিল জয়ের কথা বলে তার ছেলের জন্য কাজ করতে নেতাকর্মীদের ওপর চাপ প্রয়োগ করছেন বলেও অভিযোগ উঠেছে।

রাঙামাটিতে প্রার্থিতা ফিরে পেল ২ আ.লীগ নেতা
মনোনয়নপত্র বাছাইয়ে ছিটকে পড়ার পর অবশেষে আপিলে প্রার্থিতা ফিরে পেয়েছেন রাঙ্গামাটির দুই আওয়ামী লীগ নেতা। মনোনয়নপত্র বাছাইয়ের শেষ দিনে শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদ দেখাতে না পারায় বাছাইয়ে বাতিল হয় রাঙামাটি সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী শাহাজাহান ও জুরাছড়ি উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী রন্টু চাকমার মনোনয়নপত্র। রোববার আপিল নিষ্পতির দিনে দুজনই প্রার্থিতা ফিরে পেলেন বলে জানিয়েছেন রির্টানিং অফিসার ও রাঙামাটির সিনিয়র জেলা নির্বাচন অফিসার মো. মনির হোসেন।

প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ৩৩টি উপজেলায় চেয়ারম্যান পদে ৪৭ জন প্রার্থীর খোঁজ পাওয়া গেছে, যাঁরা স্থানীয় এমপির স্বজন ও নিকটাত্মীয়। স্বজনদের প্রার্থী হওয়া নিয়ে এরই মধ্যে অপ্রীতিকর ঘটনায় বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখিও হয়েছেন কোনো কোনো মন্ত্রী-এমপি। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মতো স্থানীয় সরকার নির্বাচনও প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক করতে এবার উপজেলায় নৌকা প্রতীক দিচ্ছে না আওয়ামী লীগ। প্রার্থিতা উন্মুক্ত করে দেওয়ার সুবাদে উপজেলা নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখতে চান এমপিরা। এ জন্য চেয়ারম্যান পদে নিজের আত্মীয়-স্বজন ও পরিবারের সদস্যদের মাঠে রাখছেন তাঁরা। এ ক্ষেত্রে দলের নিষেধও শুনছেন না অনেকেই। বিষয়টি নিয়ে ৩০ এপ্রিল আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির বৈঠকে বিশদ আলোচনা হবে বলে দলীয় একটি সূত্র জানিয়েছে। সেখানে যেসব এমপি দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করবেন, তাঁদের বিষয়ে কী কী সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে, সেই সিদ্ধান্তও নেওয়া হতে পারে।

আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মুহাম্মদ ফারুক খান বলেন, দল থেকে যে সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়েছে, তা মানা সকলের জন্য বাধ্যতামূলক। তা মানা না হলে দলীয় গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর এক সদস্য বলেন, যেসব এমপি-মন্ত্রী দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে নিজের স্বজনদের উপজেলা নির্বাচনের মাঠে রাখবেন, তাঁরা ভবিষ্যতে রাজনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। দল তাঁদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেবে। আগামী নির্বাচনে তাঁদের মনোনয়নও হুমকির মুখে পড়তে পারে।

আওয়ামী লীগের চট্টগ্রাম বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন বলেন, এখন আমরা চেষ্টা করছি এমপিদের স্বজনেরা যাতে মনোনয়ন প্রত্যাহার করে। যদি কেউ প্রত্যাহার না করে, তাহলে যাতে কোনো এমপি উপজেলা নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার করতে না পারে, সেই ব্যাপারে সাংগঠনিক পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

Link copied!