• ঢাকা
  • শুক্রবার, ০৩ মে, ২০২৪, ১৯ বৈশাখ ১৪৩১, ২৩ শাওয়াল ১৪৪৫

অর্থনীতির চ্যালেঞ্জ যেভাবে মোকাবিলা করতে হবে সরকারকে


মো. মির হোসেন সরকার
প্রকাশিত: জানুয়ারি ১৪, ২০২৪, ০৯:৫৪ পিএম
অর্থনীতির চ্যালেঞ্জ যেভাবে মোকাবিলা করতে হবে সরকারকে
যেভাবে সরকারকে অর্থনীতির চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে

নতুন সরকারের পুরোনো চ্যালেঞ্জের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ যেটি, তা হলো অর্থনীতি। উচ্চ মূল্যস্ফীতি, নাগরিকদের জীবনযাত্রার উচ্চ ব্যয় নিরসন, ডলারের বিনিময় হারের পাগলা ঘোরা থামানো, রিজার্ভে ভারসাম্য রক্ষা, জ্বালানিসংকট নিরসন, বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময়ের হারে অস্থিতিশীলতা আনা। অর্থনীতিতে এসবই এখন মূল চ্যালেঞ্জ। গেল বছর এ সমস্যাগুলো সমাধানে সরকারের পক্ষ থেকে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করা হলেও পুরোপুরি রোধ করা বা নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়নি।

অর্থনীতিবিদদের মতে, বৈশ্বিক ও স্থানীয় অর্থনৈতিক সংকটের ধারাবাহিকতায় এ সরকারকে বহু চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। পুরোনো চ্যালেঞ্জগুলো সরকারের সামনে নতুন করে আবির্ভূত হবে। অর্থনীতিতে এ সমস্যা যতটা চেনা, ততটাই ঝুঁকির। নির্বাচনী ইশতেহারে উল্লেখিত সামষ্টিক অর্থনীতির পাশাপাশি আর্থিক খাতে যে সুশাসনের কথা বলেছে, দুর্নীতি আছে- এগুলো আরও বেশি দেদীপ্যমান হবে। নতুন বছরে দৃঢ় প্রত্যয়ের সঙ্গে এগুলো বাস্তবায়ন করতে হবে। সংস্কার কার্যক্রম চালানো প্রয়োজন হবে।

জানতে চাইলে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)র গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম সংবাদ প্রকাশকে বলেন, সবেমাত্র সরকার গঠন হয়েছে। এখনও কাজ শুরু করেনি। তবে যেটা হতে পারে- অর্থনীতিতে চ্যালেঞ্জগুলো নতুন করে রিথিং করা দরকার আছে। সনাতনী যে পন্থায় চ্যালেঞ্জগুলো যেভাবে দেখা হয় তার থেকে ভিতরে গিয়ে চ্যালেঞ্জগুলো অনুধাবন করা। চ্যালেঞ্জগুলোকে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় আমরা চিন্তা করি, সেই স্বাভাবিক চিন্তা থেকে বেরিয়ে গিয়ে চ্যালেঞ্জের জটিলতাগুলো কমপ্লেক্সসিটিগুলো এবং সমাধানের পদ্ধতিগুলো তাদের অনুধাবন করার বিষয়।

তিনি আরও বলেন, সচরাচর স্বল্প সময়ে কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করে চেষ্টা করা হয় এবং কিছুদিন পর দেখা যায় সেটা ফল দেয় না। এ ধরনের উদ্যোগগুলো থেকে বেরিয়ে দীর্ঘ মেয়াদি স্থায়ী সমাধান দরকার। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো এগুলো ফরমাল সাপ্লাই চেনে উন্নিত করা। যাতে সমস্ত ধরনের কার্যক্রমগুলো রেজিস্টার্ড, লাইন্সেধারী এজেন্সরাই যেন করে, অন্যরা যেন এই মার্কেটে পার্টিসিপেট করতে না পারে। সকল ধরনের তথ্য-উপাত্তগুলো যেন ডকুমেন্টেড থাকে। সরকারের যেকোনো এজেন্সি যেন চাইলেই যেন তারা সেগুলো দিতে পারে। কি দামে কিনছে এবং কি দামে বিক্রি করছে।

গত বছরে দেশে ডলার সংকট চরম আকার ধারণ করে। এর প্রভাব সর্বত্র পড়লেও সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়ে দেশের ছোট উদ্যোক্তরা। কারণ কাঁচামাল আমদানিসহ নানা ধরনের চাপে পড়তে হয় তাদের। শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ চিকিৎসার জন্য বিদেশে গেলেও বাজার থেকে ডলার পেতে কষ্ট হয় তাদের। অনেক সময় বেশি দাম দিয়েও পাওয়া যায়নি। এ রকম একটি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাধারণত ইশতেহারে অঙ্গীকার করা হয়, কিন্তু এর বিস্তারিত বলা হয় না। নতুন সরকারে দায়িত্ব নিতে যাওয়া দলটির ইশতেহার ব্যতিক্রম। সরকারের প্রধান কাজ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা। প্রথমত, সুদ হার ব্যবহার করে চাহিদার মূল্যস্ফীতির মোকাবিলা করতে হবে। দ্বিতীয়ত, কৃষি ও শিল্প উৎপাদন বৃদ্ধি করে সরবরাহের দিকটি ঠিক রাখতে হবে। পাশাপাশি যারা মূল্যস্ফীতির শিকার, নিম্ন আয়ের মানুষ ও অনানুষ্ঠানিক কাজ করে এমন অতিদরিদ্র মানুষের জন্য সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি জোরদার করতে হবে। বিশেষ করে কম দামে চাল বিক্রি করা, বিভিন্ন ভাতা জোরদার ও অব্যাহত রাখতে হবে।

আওয়ামী লীগ গত সরকারে থাকা অবস্থায় দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঘটে। এতে বৈশ্বিক অর্থনীতি টালমাটালসহ দেশের অর্থনীতিতেও এর বড় প্রভাব পড়ে। করোনার পরবর্তী সময়ে দেশের অর্থনীতি যখন স্বাভাবিক হতে শুরু করে তখনই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ অর্থনীতিতে নতুন করে মরার উপরে খাঁড়ার ঘা হয়ে দাঁড়ায়। এ যুদ্ধ শুরুর পর থেকেই বিশ্বব্যাপী ডলার সংকট দেখা যায়। যা এখনও চলমান। ডলার সংকটের কারণে সাধারণ ব্যবসায়ীরা ব্যাংকে এলসি (ঋণপত্র) খুলতে পারছেন না। সময়মতো অনেক পণ্য আমদানি করা সম্ভব হচ্ছে না। বাজারে পণ্য সংকট দেখা দিয়েছে। ব্যবসা বাণিজ্যে নেতিবাচক ধারা চলছে। হিসাবমতো রাজস্ব পরিশোধ করতে পারছেন না অনেকে। এতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনিবআর) রাজস্ব আদায়ে এরই মধ্যে বড় ধরনের ঘাটতি দেখা দিয়েছে।

অর্থনীতির সঙ্গে রাজস্ব আহরণের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির প্রবৃদ্ধি হার ১ শতাংশ বাড়লে রাজস্ব বাড়ে ৪ শতাংশ হারে। অর্থনীতির দুরবস্থা হলে রাজস্ব আয়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।

জানা গেছে, চলতি অর্থবছরে এনবিআরের মাধ্যমে রাজস্ব আহরণের মোট লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় ৪ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে আলোচ্য অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে আদায় হয়েছে ১ লাখ ৩২ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা। অর্থাৎ লক্ষ্যমাত্রার প্রায় ৩১ শতাংশ আদায় হয়। বাকি ৬৯ শতাংশ আদায় করতে হবে ডিসেম্বর থেকে জুন পর্যন্ত। এ হিসেবে নতুন বছরের ছয় মাস সরকার যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে তা অর্জন করতে হলে আদায় বাড়াতে হবে বা প্রবৃদ্ধি হতে হবে ৩০ শতাংশের বেশি।

রাজস্ব বোর্ডের হালনাগাদ পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে অক্টোবরে আমদানি শুল্কে ঘাটতি হয়েছে ৫ হাজার ৭৮২ কোটি টাকা, ভ্যাটে ৪ হাজার ৫৬৫ কোটি টাকা এবং আয়কর ও ভ্রমণ কর খাতে ৬ হাজার ১১ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে তিন খাতে পাঁচ মাসে মোট ঘাটতি দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৬ হাজার ৪৫৯ কোটি টাকা।

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, নতুন বছরে সরকারের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ আয় বাড়ানো ও ব্যয় কমানো। চলতি বাজেট থেকে ১ লাখ কোটি টাকা ছেঁটে ফেলতে হবে। মূল্যস্ফীতি কমানো সরকারের জন্য কঠিন চ্যালেঞ্জ। ডলার সংকট দূর করতে হবে।

Link copied!