• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল, ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ শাওয়াল ১৪৪৫

মেহমান বেশে চুরি, চক্রে জড়িত নারী


মো. মির হোসেন সরকার
প্রকাশিত: এপ্রিল ৬, ২০২৪, ০৯:৫৪ পিএম
মেহমান বেশে চুরি, চক্রে জড়িত নারী

কাঁধে ভ্যানিটি ব্যাগ, সঙ্গে ৮-১০ বছর বয়সী এক ছেলে আর ২৩-২৬ বছর বয়সী মেয়ে। তাদের নিয়ে লিফটের আটতলায় ঢোকেন চল্লিশ বছর বয়সী নারী। কলিং বেল না বাজিয়ে মেয়েকে বাইরে রেখে শিশুটিকে নিয়ে বাসায় প্রবেশ করেন। আচার-আচরণ দেখে মনে হবে বাড়িওয়ালার সঙ্গে দীর্ঘদিনের সম্পর্ক। তবে বাস্তবে ঘটনা উল্টো। আসলে চুরি করার জন্যই তারা বাসায় ঢোকে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই নগদ টাকা, ডলারসহ প্রায় পাঁচ লক্ষাধিক টাকার মূল্যবান জিনিসপত্র নিয়ে সকটে পড়ে। এমন ঘটনা ঘটেছে রাজধানীর মিরপুর ডিওএইচএস এলাকায়।

চুরি হওয়া বাসার এক সদস্য বললেন, “প্রথম যখন সিসিটিভি ফুটেজে দেখি তখন শিশুটি ভেতরে ঢুকে পড়েছে। আমি বাবাকে বলেছিলাম, হয়তো অন্য কোনো বাসার মেহমান আমাদের বাসায় ভুল করে ঢুকে পড়েছে। তাদের গতিবিধি দেখে প্রথমে নেগেটিভ চিন্তা ভাবনা মাথায় আসা মুশকিল। পরে আমার কাছে মনে হয়েছে এই বেশভুশাই তাদের সফলতার প্রধান চাবিকাঠি।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ২ এপ্রিল মিরপুরের ডিওএইচএস এলাকার বহুতল ভবনে ঢুকে পড়ে এই চোর চক্রটি। প্রথমে তারা বাসায় ঢুকে লোকজনের গতিবিধি লক্ষ করে। তারপর সুযোগ মতো আলমারি থেকে মূল্যবান জিনিসপত্র চুরি করে পালিয়ে যায়। পরে সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করে একটি টেলিভিশনে সংবাদ প্রচার হলে চক্রটির সন্ধান পাওয়া যায়। নারায়ণগঞ্জের সিদ্দিরগঞ্জের সানারপাড়ায় অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

পুলিশ সূত্র সংবাদ প্রকাশকে জানায়, ওই নারীর নাম সেলিনা। সঙ্গের মেয়েটি তার ভাইয়ের স্ত্রী নূপুর। শিশুটি নূপুরের ছেলে। চক্রটির মূল পেশাই চুরি। দীর্ঘদিন ধরে ঢাকার বিভিন্ন আবাসিক এলাকার বাসাবাড়িতে তারা চুরি করে আসছিল। মিথ্যা তথ্য দিয়ে আত্মীয়তার কথা বলে যেকোনো বাসা টার্গে করতো। তার সেখান থেকে নগদ টাকা, স্বর্ণাঙ্কার নিয়ে চম্পট দিত।

অভিযানের দায়িত্বে থাকা গুলশান থানার উপ-পরিদর্শক রাজু আহমেদ সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “ফেসবুকের একটি কমেন্টকে কেন্দ্র করে মাঠে নামি আমরা। এরপর নারায়ণগঞ্জের সানারপাড়ায় অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। এর আগেও তারা এ কাজে জড়িত ছিল। তারা যে নাম বলেছে সে নামে কোনো মামলায় রেকর্ড নেই। তাদের কাছে কোনো এনআইডি কিংবা জন্ম নিবন্ধন কার্ড পাইনি। তারা যেসব নাম বলেছে সেগুলো আসল নাকি ছদ্মনাম সেটা বের করার চেষ্টা করছি। তবে তাদের সম্পর্কের বিষয়টি সত্য বলে জেনেছি। তারা তিনজনই এক বাসায় থাকতেন। পরবর্তীতে চক্রটিকে আদালতে পাঠিয়ে তিনদিনের রিমান্ডের আবেদন করলে আদালত মঞ্জুর করেন”।

তবে চক্রটি শুধু মিরপুরের ডিওএইচএসের বহুতল ভবনেই চুরি করেনি, তাদের চুরির আরও কিছু ভয়ংকর তথ্য এসেছে সংবাদ প্রকাশের কাছে। গত ১৮ ফেব্রুয়ারি কুমিল্লার ডিওএইচএস এলাকাতেও চুরি করেছিল তারা। তারও আগে গুলশানের একটি বাসার সিসিটিভি ফুটেজে তাদের দেখা মেলে। যেখানে একই কায়দায় চুরি করে চক্রটি। এছাড়াও গত ৩১ মার্চ বারিধারার চুরির ঘটনাতে তারা জড়িত ছিল। মিরপুর ৬০ ফিটের একটি বাসাতেও তারা চুরি করে। টিকাটুলির আরেকটি চুরির ঘটনার ছবিতেও দেখা গেছে তাদের। সে সময় চোরাই মালামালসহ বাড়ির বাসিন্দারা আটক করে তাদের। পরে তুলে দেওয়া হয় পুলিশের হাতে। যদিও থানায় এ সংক্রান্ত কাগজপত্র পাওয়া যায়নি।

অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আত্মীয়তার বেশভূষা ধরে বাসায় ঢুকে চুরি করার ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা বিভিন্ন সময় অভিযান চালিয়ে অনেককেই গ্রেপ্তার করে। কিছুদিন জেল খেটে তারা ছাড়া পেয়ে যায়। আইনি জটিলতাও আছে। এ ধরনের অপরাধ প্যানেল কোডে খুব গুরুতর নয়। অথচ সময়ের বিবেচনায় এসব ভয়ংকর হয়ে দাঁড়িয়েছে।

জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “আত্মীয়তা, পূর্ব পরিচিতি অথবা নতুন করে সম্পর্ক তৈরি করে বিশ্বাস অর্জন করে বাসায় কিংবা অফিসে চুরি, ডাকাতি, হত্যা অথবা অপহরণের মতো অপরাধ সংগঠিত হচ্ছে। আমাদের বৈচিত্র হলো- কেউ ভালো ব্যবহার কিংবা নিজে এসে সামাজিক সম্পর্ক তৈরি করতে চাইলে তাদের ভালো মানুষ হিসেবে গণ্য করি। কিন্তু এখন তথাকথিত ভালো মানুষের উপমা দিয়ে সামাজিকভাবে বিষয়গুলো চিন্তা করার সুযোগ নেই। আইনগত যে জটিলতা বা ত্রুটি আছে সময়ের প্রেক্ষাপটে এটাকে সংশোধন করে কঠিন দৃষ্টান্ত বা আইন প্রয়োগের বাস্তবতা তৈরি করতে না পারলে এই জায়গা থেকে খুব সহজেই পরিত্রাণ মিলবে না।

Link copied!