উমর ভাই গিয়েছেন শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে। তখন বদরুদ্দীন উমর ছাত্র, অনার্সে পড়েন ফিলোসফিতে। যখন শুনলেন তিনি আবুল হাশিমের সন্তান, তখন তিনি আবুল হাশিম কীভাবে ভাষণ দিতেন, কী কী বলতেন, কবে কোন কথা কোন সভায় বলেছিলেন—সব গড়গড় করে বলতে থাকলেন। আবুল হাশিম যদিও বঙ্গবন্ধুর প্রিয়ভাজন কেউ না, বরং ধারনা করা হয় তিনি আবুল হাশিমকে খুব বেশি পছন্দ করতেন না, তাও তিনি কী দারুণভাবে মনে রেখেছেন দেখে উমর সাহেব অবাক হয়েছিলেন।
ভাসানী তাঁকে ন্যাপ করতে বলতেন। ন্যাপে যান নাই চাকরি ছাড়ার পরও। কিন্তু ভাসানীর সঙ্গে ঘুরেছেন অনেক জায়গায়। আবুল মকসুদের বাইরে ভাসানী নিয়ে গল্প আছে তাঁর কাছেও। গল্পটা শুনেছিলাম উমরের মুখেই। ভাসানী একবার তাকে বলতেছেন, “আমি সমাজতন্ত্র নিয়ে অনেক কিছু শুনি, আর শিখি ঢাকা ভার্সিটির এক প্রফেসর থেকে। তিনি দিনের পর দিন আমাকে সমাজতন্ত্র বোঝালেন। আমিও সব শিখে টিখে সমস্ত জায়গায় সমাজতন্ত্র চাই, দাবি মানতে হবে, দুনিয়ার মজদুর এক হও লড়াই করো বলে শহর কাঁপাতাম। এরপর চিন্তুা করলাম সেই প্রফেসরকে খুঁজে বের করি, অনেকদিন দেখি না। পরে জানলাম, অধ্যাপক আখলাকুর রহমান থাকেন ব্যাংকক, বিশ্ব ব্যাংকে মোটা মাইনের চাকরি করে।”
গোলাম আজমের বরাত দিয়ে ২০ই জুন ১৯৭০ সালে আজাদ পত্রিকায় সংবাদ বের হয়, তিনি বলছেন, “বাংলা ভাষার আন্দোলন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার দিক থেকে মোটেও সঠিক কাজ হয় নাই। এইটা আমাদের ভুল ছিল।`
প্রতিক্রিয়ায় বদরুদ্দীন উমর সেই তার পরেরদিন সম্পাদকীয় লিখেছিলেন। যার শিরোনাম ছিল, ‘মুসলিম লীগের উত্তরাধিকারী জামাতে ইসলামীর স্বরূপে আত্মপ্রকাশ।’ ছোট্ট সেই লেখার শেষ লাইনগুলো ছিল এরকম, “যে-কোন রাজনৈতিক সংগঠন অথবা ব্যক্তির সত্যিকার শ্রেণি চরিত্র তার বাস্তব কর্মসূচি ও বিভিন্ন বক্তব্যের মাধ্যমেই ধরা পড়ে। জামাতে ইসলামী এবং তার আমীর গোলাম আজমের ক্ষেত্রেও তার কোনো ব্যাতিক্রম হয়নি। ইসলামের ধ্বজাধারী খাজনাখোরদের এই দালালরাও ভাষা আন্দোলন সমন্ধে তাদের গণবিরোধী বক্তব্য হাজির করে নিজেদের স্বরূপকেই আজ পূর্ব বাংলার সচেতন জনগোষ্ঠীর সামনে উদঘাটিত করেছে।”
বদরুদ্দীন উমরের কিছু লেখা এত ভালো। বিদ্যাসাগর থেকে অমর্ত্য সেন, তাঁর ক্রিটিক অ্যানালাইসিস থেকে বাঁচেননি কেউ। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসকে ভালোবাসতেন খুব। কিন্তু ইলিয়াসের লেখারও কিছু সমালোচনা তাঁর আছে। বদরুদ্দীন উমর একটা স্পোর্টিং ভাব নিয়ে লেখেন। আপনারা ‘সংস্কৃতি’ পত্রিকার পুরোনো সংখ্যা পড়লে দেখবেন, প্রচুর আছে জবাব। লোকজন চিঠি লিখতেন, তিনি বিশাল বিশাল জবাব দিতেন। ইংরেজ শাসন, পাকিস্তান ও এই বাংলাদেশের রাজনীতি বুঝতে তাঁর বই পড়ার বিকল্প নেই।
নানাবিধ কারণে বদরুদ্দীন উমরের কলাম কম ছাপা হয়। গত ত্রিশ বছরে তার কলাম নিয়ে অনেকগুলো বই, সেগুলো পড়লেই আপনি সে সময়ে রাজনৈতিক সামাজিক খবরাখবর নিয়ে অনেক কিছু জানবেন। আগে ওনার বইও বিক্রি হতো অনেক। এখন বাংলাদেশে সবই ভাঙার দিকে।
জন্মদিনের শুভেচ্ছা হে মায়েস্ত্রো। একটা কিশোরকে আপনি রাজনীতি নিয়ে পড়াশোনায় যে আগ্রহী করেছেন, সেই উচ্ছ্বাসের দিনগুলোই জীবনের সম্পদ। বদরুদ্দীন উমর শতায়ু হন, এরকম কুল থাকেন। এই বাংলাদেশ এ সময়ে আপনার বেঁচে থাকাটা খুব প্রয়োজন।