• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৯ রমজান ১৪৪৫

চেয়ার


কর্মকার অনুপ কুমার
প্রকাশিত: মার্চ ১৩, ২০২৩, ০২:৪১ পিএম
চেয়ার

কলেজ থেকে ফিরে কোনো রকম হাতমুখে জল দিয়ে মেঝেতে বসে ভাতের থালা হাতে নিয়ে পারলে নাক ও মুখ দিয়ে একসাথে দ্রুত খাবার শেষ করে ফেলে অনির্বাণ। ক্লাস থেকে ফিরতে দেরি হওয়ার কারণে গতকালও টিউশনি করতে যাওয়া হয়নি। এই নিয়ে এ মাসে চার দিন টিউশনি মিস গেল। এরপরে এ মাসে আর এক দিনও মিস গেলে ছাত্রীর মা হয়তো “আপনাকে আর আসতে হবে না” নামক শব্দাস্ত্রটি ব্যবহার করেই ফেলবেন। এই দুর্দিনের বাজারে টিউশনিটা চলে গেলে মেসে মিল চালানো দুষ্কর হয়ে পড়বে অনির্বাণের জন্য। গোগ্রাসে ভাত খেতে খেতে এসব কথা মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে তার।

গত মাসে মেসের ম্যানেজার ছিল অনির্বাণ। মেসের যতজন সদস্য তারা সবাই ক্রমানুসারে এক মাস করে ম্যানেজারি করবে। মিলের ব্যবস্থাপনা, কোন সদস্যকে কবে বাজার করতে হবে, খাবারের তালিকায় কোন কোন খাবার থাকবে, তা নির্ধারণ করে দেওয়া এবং সব সদস্যের কাছ থেকে মিল বাবদ টাকা তুলে হিসাবের দেনাপাওনা নিষ্পত্তি করা ও বাসা ভাড়া তুলে তা একত্র করে বাড়ির মালিকের কাছে ভাড়া পরিশোধ করা ইত্যাদি একজন মেস ম্যানেজারের কাজ। গত মাসের দায়িত্ব পাওয়ার পর ভাড়ার টাকা দিতে গিয়ে বাড়ির মালিকের কাছ থেকে আগামী মাস থেকে দুই হাজার টাকা করে বাড়তি ভাড়া দিতে হবে বলে মৌখিক নোটিশ শুনে এসেছে। এমন পরিস্থিতিতে মেস বাসায় জরুরি মিটিং বসল। আলোচনা করে সব সদস্য এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলো যে বাড়তি টাকা দিয়ে এ বাড়িতে আর নয়। যদি বাড়তি ভাড়াই গুনতে হয় তবে এর থেকে ঢের ভালো বাড়িতে থাকা যাবে। সম্মিলিত সিদ্ধান্তে গত মাসের ম্যানেজার অনির্বাণের কাঁধেই এসে পড়ল নতুন বাড়ি খোঁজার মূল দায়িত্ব।

টিউশনি শেষ করে মগবাজার চৌরাস্তার মোড়ে ঝিম ধরা চোখে কিছুক্ষণ ফুটপাতে দাঁড়িয়ে থাকে অনির্বাণ। স্কুলের এক শিক্ষকের কাছ থেকে অনির্বাণ একবার শুনেছিল, শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত মানুষেরা নাকি বেশি দিন বাঁচেন না। সেই থেকে কথাটা অনির্বাণের মাথায় জোঁকের মতো এঁটে আছে এবং ঢাকায় এসে নিজের পড়াশোনা ও থাকা-খাওয়ার জন্য অর্থের ব্যবস্থা করতে গিয়ে আয়ের পথ হিসেবে সেই শিক্ষকতা পেশাকেই বেছে নিতে হয়েছে। নিজেকে টিউশনিতে নিয়োজিত করার পর থেকে অনির্বাণ হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে কেন তার স্কুলের শিক্ষক সেদিন ওই কথাটা বলেছিলেন। মগবাজারের ফুটপাতে দাঁড়িয়ে অনির্বাণ চোখ বুজে অনুভব করছে, মাথার মধ্যের সেই চিন্তার জোঁকটা তার শিক্ষক সত্তার শ্রম চুষে চুষে প্রতিদিন বেঁচে আছে।

পকেটে থাকা মোবাইল ফোনটা বেজে ওঠে অনির্বাণের। পকেট থেকে ফোনটা হাতে নিয়ে দেখে মেসের সদস্য রাজুদা ফোন করেছে। অনির্বাণ অনুমান পারে সে ফোনটা রিসিভ করলেই রাজুদা এখন কী বলবেন। রাজুদা লোকটা একটু আপোষী চরিত্রের, কথায় কথায় মিষ্টি লাগিয়ে পৃথিবীর সবকিছুর সাথে আপস করতে সদা প্রস্তুত থাকেন। পেশায় বিমা কর্মী। তাই মিষ্টি কথাই তার পেশার গুরুত্বপূর্ণ পাথেয়। কিন্তু পেশাগত সে আচরণটা রাজুর চরিত্রে স্থায়ীভাবে ঢুকে গেছে। মাঝে মাঝে অনির্বাণের কাছে রাজুর এই চরিত্রটা বিরক্ত লাগে। কিন্তু কী আর করা? একই মেসে থাকতে হলে অনেক অপছন্দের বিষয়েও মানিয়ে নিতে হয়। অনির্বাণ ফোনটা রিসিভ করে
—হ্যালো অনির্বাণ। কোথায় আছ ভায়া?’
—দাদা আমি টিউশনি করে বের হলাম মাত্র। মগবাজার চৌরাস্তায় আছি।’
—বাসা দেখতে যাবে নাকি আজ?’
—হ্যাঁ দাদা যাব। পড়িয়ে বের হলাম তো, মাথাটা ঝিমঝিম করছে। একটু পরে বাসা দেখার উদ্দেশ্যে নামব।’
—আচ্ছা কোন দিকে যাবে আজ? মানে আমি আজকে সন্ধ্যায় ফ্রি আছি। বলতে পারো বাসা দেখার জন্যই সময়টা করে রেখেছি। তুমি চাইলে আমি তোমার সাথে বাসা দেখতে যেতে পারি।’
অনির্বাণ বুঝতে পারে রাজুর হাতে কোনো কাজকর্ম নেই। তাই সুযোগটা কাজে লাগিয়ে তার সাথে বাসা দেখতে বের হতে চাচ্ছে। এটাও রাজুর কাজের একটা ফন্দি। বিষয়টা এমন, বাসা দেখতে যাবার সুযোগে বাড়ির মালিকদের সাথে দেখা করা ও কথা বলা যায় খুব সহজে, সে সুযোগটা কাজে লাগিয়ে যদি একটা ইনস্যুরেন্স পলিসি করার জন্য রাজি করাতে পারে তবে বাড়ি ভাড়া পাক আর নাপাক পেশাগত উদ্দেশ্য তো সফল হবে। অনির্বাণ এসবই বুঝতে পারে। কিন্তু আজ খুব ক্লান্ত লাগছে অনির্বাণের। একা যাবার থেকে কেউ একজন সাথে থাকলে মন্দ লাগবে না ভেবে রাজুকে বলল—
—বেশ তো। চলে আসুন না। আমি মগবাজার মোড়ে দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছি এক কাপ। আপনি আসুন। আমি টংয়ে অপেক্ষা করছি।’

মিনিট কুড়ির মধ্যে টংদোকানে রাজুর আবির্ভাব ঘটল। ইচ্ছা না থাকলেও নিছক ভদ্রতার খাতিরে রাজুকে চা খাবার আমন্ত্রণ জানাতে হচ্ছে অনির্বাণকে,
—দাদা চা বলি আপনার জন্য?’
—না না, ঠিক আছে। তুমি তো জানো আমি আবার বাইরে তেমন কিছু খাই না।’
কথাটা শেষ করতে না করতেই রাজু কিছুটা মজার ছলে অনির্বাণকে উদ্দেশ্য করে বলল,
—তা তোমার ব্যাপারটা কী ভায়া বলো তো? আজকে টিউশনির বাসায় জলখাবার কিছু দেয়নি না নাকি?’
অনির্বাণ একদিকে ঠোঁট বাঁকা করে অনিচ্ছার হাসি মুখে নিয়ে বলল,
—না, বিষয়টা ঠিক সে রকম নয় দাদা। কলেজ থেকে ফিরতে দেরি হয়ে গেছে। মেসে ঢুকে কোনো রকম নাকেমুখে দুটো দিয়ে সাথে সাথে দৌড় দিয়েছি টিউশনির বাসায়। দুই মিনিট বিশ্রামেরও সময় পাইনি। তার ওপর টিউশনি করানো মানে তো অনর্গল কথা বলা। তাই মাথাটা একটু ধরেছে। আপনি আসতে একটু সময় নিচ্ছিলেন তাই এক কাপ চায়ে চুমুক দিয়ে একটু সতেজ হয়ে নিলাম।
—তা আজকে কোন এলাকায় বাসা দেখার পরিকল্পনা করলে?’
—আজ খুব বেশি ঘোরাঘুরি করতে পারব না দাদা। আজকে মগবাজার ওয়্যারলেস মোড় এলাকাটাই ঘুরে দেখতে চাই শুধু।
—বেশ তবে চলো।’

মগবাজার চৌরাস্তা থেকে ওয়্যারলেস মোড় পর্যন্ত হেঁটে আসার সময়টুকু রাজু অনর্গল কথা বলেই চলল। অনির্বাণ মনে মনে প্রচণ্ড বিরক্ত এবং রাজুর এই অহেতুক কথা বলার চাপটা এই মুহূর্তে একেবারেই নিতে পারছে না সে। রাজু বলেই চলল,
—বুঝলে অনির্বাণ, এই যে আমরা ঢাকা শহরে কোনোমতে দুটো খেয়েপরে মেসে মেসে জীবনের একটা অংশ কাটিয়ে দিচ্ছি তার একটা বড় কারণ কিন্তু জীবনে একটা চেয়ার অর্জন করা। সেটা হোক চাকরি বা ব্যবসা। একটা জুতসই চেয়ার অর্জন করার আগ পর্যন্ত কিন্তু আমাদের এই সংগ্রাম আমরা সবাই চালিয়ে যাই।
রাজু তার কথার খই ফুটিয়েই চলল। এ বিরক্তি কাটানোর আর কোনো উপায় না পেয়ে ওয়্যারলেস মোড়ের দিকে জোরে হাঁটা ধরল অনির্বাণ।

ওয়্যারলেস মোড়ের ডাক্তার গলির মুখে এসে দাঁড়াল দুজন। কয়েকটা বাড়ি ভাড়ার বিজ্ঞাপন সেঁটে দেওয়া আছে গলির মুখেই। সে বিজ্ঞাপনগুলোতে উল্লেখ করা মুঠোফোনের নাম্বারগুলোতে এক এক করে ফোন দেওয়া শুরু করল অনির্বাণ ও রাজু। অধিকাংশ বাড়িওয়ালার এক কথা, “ব্যাচেলর ভাড়া দেব না।’

ঢাকা শহরে ব্যাচেলরদের জন্য ঘর ভাড়া পাওয়া রীতিমতো একটা যুদ্ধ। বিনা শর্তে এ যুদ্ধে সফল হওয়ার মতো ব্যাচেলর খুব কম আছে বলতে হবে। কারণটা খুব সহজ, যে বা যারা ব্যাচেলরদের ঘর ভাড়া দিতে রাজি হয়, তাদেরকে দেওয়া হয় নানা রকম নিয়মাবলির একটা দীর্ঘ তালিকা। সে তালিকা মেনে চলতে পারলে বাড়িতে থাকতে পারবে নতুবা তার পরের মাসেই নেমে যাওয়ার নোটিশ পেতে হবে। অনির্বাণ এসব নীতিমালার কথা নিজের মধ্যে এখন আয়ত্ত করে নিয়েছে এবং বিষয়টিতে অনির্বাণের উপলব্ধি এই যে বাড়িওয়ালাদের দৃষ্টিতে ঢাকা শহরে ব্যাচেলররা হচ্ছে অযাচিত একধরনের প্রাণী, যাদের ঘর ভাড়া দিয়ে যা খুশি তা নিয়মাবলির জাঁতাকলে পিষে মাস শেষে অর্থ আদায় করা যায়।

ডাক্তার গলির মুখেই একটা পনেরো তলা ভবন, তার লোহার ফটকে বাড়ি ভাড়ার বিজ্ঞাপন লাগানো। 
বিজ্ঞাপন দেখে রাজু বলল,
—অনির্বাণ, চলো এখানে একটু খোঁজ নেওয়া যাক।’
অনির্বাণ ভালো করেই জানে যে রাজুর এ বাড়িতে ঢোকার একমাত্র উদ্দেশ্য বাড়ি ভাড়া নয়। অনির্বাণ বলল,
—দাদা, এত বড় বাড়িতে মনে হয় না ব্যাচেলর ভাড়া দেবে। বৃথা চেষ্টা করা হবে বলে মনে হচ্ছে।’
—আরে চলোই না। অন্ততপক্ষে দারোয়ানের সাথে তো আলাপ করে দেখা যাক কী বলে। আলাপ না করেই হতাশ হওয়াটা ঠিক হবে না।’
অগত্যা বাড়িতে ঢুকতেই হলো। প্রাথমিকভাবে দারোয়ানের সাথে কথা বলে জানা গেল এ বাড়িতে ব্যাচেলর বেশ কয়েকটা ফ্ল্যাট আছে। এ তথ্যটা নিয়ে যতটা না আশার আলো দেখা গিয়েছিল, তার পরে যে তথ্য জানা গেল তাতে ততটাই অন্ধকারে ডুবে যেতে হলো অনির্বাণ ও রাজুকে। সে তথ্যটা হলো, এ বাড়িতে ব্যাচেলর ঘর ভাড়া পাওয়া যায় কিন্তু সেটা ভবনের দশতলা থেকে পনেরো তলায় যে ফ্ল্যাটগুলো আছে, সেখানে এবং এ ভবনে এখনো লিফট লাগানো হয়নি।

এতক্ষণে অনির্বাণের কাছে পরিষ্কার হলো, কেন এমন ফ্ল্যাটবাড়িতে ব্যাচেলর ভাড়া দেওয়া হচ্ছে। রাজু অতি উৎসাহী হয়ে দারোয়ানের কাছে জানার চেষ্টা করল, কেন এত উঁচু ভবনে লিফট লাগানো হয়নি। তাতে কথায় কথায় আরও মারাত্মক তথ্য পাওয়া গেল। জানা গেল এ বাড়িটি যে ডেভেলপার প্রতিষ্ঠান বানিয়েছে, তারা কোনো এক মামলার কারণে পলাতক। অগত্যা যারা ফ্ল্যাট বুকিং দিয়েছিলেন, তারা প্রশাসনের সহায়তায় যে যার ফ্ল্যাট দখল নিয়েছেন। নবম তলা পর্যন্ত ফ্ল্যাট মালিকেরা অনেকেই পরিবার নিয়ে থাকেন। কিন্তু এত বড় ভবনে এর ওপরে তো লিফট ছাড়া পরিবার নিয়ে বসবাস করা যায় না। তাই ওপরের ফ্ল্যাট মালিকেরা নিরুপায় হয়ে ব্যাচেলর বাসা হিসেবে ঘর ভাড়া দিয়েছেন।

ওই বাড়ি থেকে আশাহত হয়ে বের হয়ে এলো অনির্বাণ, তবে রাজু ঠিক আশাহত কি না, সেটা এই মুহূর্তে ঠিক বুঝতে পারছে না সে। বাইরে বেরিয়ে রাজু অনির্বাণকে জিজ্ঞেস করল,
—কী বুঝলে?
অনির্বাণের সোজা উত্তর—
—দাদা এখানে বোঝাবুঝির তো কিছু দেখছি না।’
—না, মানে ভেবে দেখো, এত সুন্দর ফ্ল্যাট ব্যাচেলর হিসেবে ভাড়া দিচ্ছে। সমগ্র ঢাকা খুঁজলেও ব্যাচেলরদের জন্য এমন সুন্দর ফ্ল্যাট পাওয়া যাবে না কিন্তু। একটু ইতিবাচকভাবে ভাবলে কিন্তু ভাবা যেতে পারে বিষয়টা।
অনির্বাণ শুরুর দৃঢ়তায় উত্তর দিল
—দাদা কী বলেন আপনি এসব! এই দশতলার ওপরে প্রতিদিন কতবার ওঠানামা করা যায়? তা ছাড়া আপনি তো শুনলেন যে এ বাড়ির প্রমোটার কী এক মামলা খেয়ে পলাতক। বিষয়টা আপনি বুঝতে পারছেন? সোজা বাংলায়, এ বাড়ির কোনো বাপ-মা নেই। ফ্ল্যাট মালিকেরা যে যার খুশিমতো এ বাড়ি চালাচ্ছেন। ন্যূনতম নিরাপত্তার কথা ভাবলেও তো এমন বাড়িতে ওঠা যায় না।
কথাগুলো বলে অনির্বাণ ডাক্তার গলি ধরে সোজা হাঁটা দিল। হাঁটার ভঙ্গিতে রাজু অনুমান করতে পারল যে অনির্বাণ রাজুর ওপর বেজায় রকমের বিরক্ত।

শ্রাবণ মাসের সন্ধ্যা। এ মাসের আকাশের ওপর ভরসা করা আর শেয়ালের কাছে মুরগির ছানা বর্গা দেওয়া একই কথা। ঘটনা ঘটলও একেবারে তাই, একে তো অনির্বাণ রাজুর ওপর প্রচণ্ড রকমের বিরক্ত তার ওপর হঠাৎ করে মাথার ওপর বিনা নোটিশে বৃষ্টি পড়া শুরু করে দিল। চারদিকে প্রচণ্ড বাজ পড়ছে। অনির্বাণ বৃষ্টি থেকে একটু আশ্রয়ের জন্য চারদিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে যাচ্ছে। এমন সময় অনির্বাণ শুনতে পাচ্ছে পেছন থেকে রাজু ডাকছে,
—এই অনির্বাণ! আরে এই যে এদিকে! এদিকে এসো।’
অনির্বাণ পেছনে ফিরে তাকিয়ে দেখে রাজু একটা বাড়ির গেটে দাঁড়িয়ে অনির্বাণকে ডাকছে। অনির্বাণ কোনো দিক চিন্তা না করে বৃষ্টি থেকে বাঁচার জন্য এক দৌড়ে সে গেট থেকে বাড়ির ভেতরে ঢুকে গেল।

বাড়িটা পুরোনো, পুরোনো বলতে মুক্তিযুদ্ধকালীন বা তার আশপাশের সময়ের হবে বলে অনুমান করা যায়। আধভেজা হয়ে বাড়ির দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে অনির্বাণ ও রাজু। এতক্ষণে অনির্বাণ খেয়াল করল যে এ বাড়ির গেটে একজন দারোয়ান আছে এবং তার বুঝতে বাকি রইল না যে রাজু দারোয়ানের অনুমতি নিয়েই ভেতরে প্রবেশ করতে পেরেছে। অনির্বাণ রাজুর দিকে তাকিয়ে বলল,
—কী দাদা, এ বাড়িতেও কি বাড়ি ভাড়ার সাইনবোর্ড লাগিয়েছে নাকি?
—তবে আর বলছি কি! আমি তো দারোয়ানের সাথে কথা বলছিলাম এর মধ্যে বৃষ্টি নেমে পড়ল। তুমি তো পেডছনে খেয়াল না করে সামনে হেঁটেই চলেছ। তাই তোমাকে ডেকে পেছনে ফেরালাম।
অনির্বাণ ও রাজুর কথা চলছিল, এই মুহূর্তে একটা লোক বাড়ির ভেতর থেকে দরজা খুলে ওদের সামনে জানতে চাইল,
—আপনারা কার কাছে এসেছেন?’
রাজু উত্তর দিল—
—বাইরে একটা বাসা ভাড়ার বিজ্ঞাপন দেখলাম।
—ও আপনারা বাড়ি ভাড়ার জন্য এসেছেন?’
—হ্যাঁ। কত তলায় ভাড়া হবে?’
—চারতলার পেছনের দিকের ঘরটা ভাড়া হবে। আপনারা ব্যাচেলর?’
পাশ থেকে রাজু দ্বিধাগ্রস্ত স্বরে উত্তর দিল,
—আজ্ঞে হ্যাঁ। আমরা ব্যাচেলর।’
লোকটা বলল,
—ব্যাচেলর হলেও কোনো সমস্যা নেই। এ বাড়ির মালিক ব্যাচেলদেরও বাড়ি ভাড়া দেন।
কথাটা শুনে অনির্বাণ ও রাজু একে অপরের দিকে স্বস্তি নিয়ে তাকাল। রাজু খুব বিনয়ের সাথে লোকটার কাছে জানতে চাইল,
—ভাই আপনার নাম?’
—আমার নাম জামাল। আমি এ বাড়ির কেয়ারটেকার।’
অনির্বাণ জামালের কাছে জানতে চাইল,
—জামাল ভাই, যে ঘরটা ভাড়া হবে সে ঘরটা কি আমরা একটু দেখতে পারি?’
—নিশ্চয়ই পারেন। আপনারা আগে ঘরটা দেখুন। পছন্দ হলে আমি বাড়িওয়ালার সাথে কথা বলিয়ে দেব। আসুন আপনারা আমার সাথে।’

চারতলায় গিয়ে দেখা গেল বেশ বড় ঘর। ঘরটা ভাড়া নিতে পারলে বেশ চমৎকারভাবে থাকতে পারবে ওরা। অনির্বাণ জামালের কাছে জানতে চাইল,
—এখানে ঘরের ভাড়া কত জামাল ভাই?’
—এখানে আগেও একদল ব্যাচেলরই ছিল। ওরা ষোলো হাজার টাকা ভাড়া দিত। বাকিটা আপনাকে বাড়িওয়ালার সাথে কথা বলে নিতে হবে।’
রাজু বলল,
—বাড়িওয়ালার সাথে কথা বলতে হবে তাহলে। চলুন জামাল ভাই, বাড়িওয়ালার সাথে কথা বলার ব্যবস্থা করে দিন আমাদের।’

সিঁড়ি ধরে নিচে নামার পথে রাজু ও অনির্বাণের মধ্যে ভাড়া নিয়ে কিছু কথোপকথন হলো এবং সে কথোপকথনের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় এই যে ঘর তাদের পছন্দ হয়েছে কিন্তু ভাড়া তো বাজেটের তুলনায় বেশি। দুজনেই এই সিদ্ধান্তে একমত হলো যে বাড়িওয়ালার সাথে কথা বলে দেখা যাক কিছু করা যায় কি না।

জামাল ওদের বাড়ির দ্বিতীয় তলার একটা বৈঠক ঘরে নিয়ে বসাল। ঘরটা বেশ ছিমছাম করে গোছানো। অনির্বাণ লক্ষ করল যে চেয়ারগুলোতে তারা বসেছে, সেগুলো বেশ পুরোনো তবে বেশ যত্নে এগুলোকে সংরক্ষণ করা হয়েছে। বৈঠক ঘরে আধুনিক সোফা আছে কিন্তু চেয়ারগুলো সে জন্য ব্রাত্য হয়ে যায়নি মোটেই। এ ধরনের ছিমছাম গোছানো বৈঠক ঘর দেখলে অনির্বাণের ঠিক ঈর্ষা হয়, সেটা বলা যাবে না তবে, বুকের মধ্যে একধরনের হাহাকার অনুভব করে সে। সে হাহাকারটা একটা দীর্ঘশ্বাসের সাথে জানান দিয়ে যায়— এমন একটা গোছানো বৈঠক ঘর কি আমার কোনো দিন হবে?

অনির্বাণ অনুমান করতে পারছে ঘরের ভেতর থেকে বেশ বয়স্ক একজন লোক ধীরপায়ে এগিয়ে আসছে বৈঠক ঘরের দিকে। মাথায় পরিপূর্ণ পাকা চুলের অধিকারী এক ভদ্রলোক বৈঠক ঘরে প্রবেশ করল। ঘরে প্রবেশের সাথে সাথেই ভদ্রলোক অনির্বাণ যে দিকটাতে বসেছে, সেদিকে তাকিয়ে বেশ বিরক্ত হয়ে বলল,
—আপনি এ চেয়ারটাতে বসেছেন কেন? ও পাশটাতে এসে বসুন।’
এতক্ষণে অনির্বাণ খেয়াল করে দেখল সে যে দিকটাতে বসে আছে, সে দিকটাতে কেবল একটাই চেয়ার রাখা আর রাজু যে দিকটাতে বসে আছে সেদিকে সারিবদ্ধ পাঁচটা চেয়ার আছে। অনির্বাণ কিছুটা বিব্রত হয়ে সরে গিয়ে রাজুর পাশে বসল।

—আপনারা ঘর ভাড়ার জন্য এসেছেন তাহলে?’
রাজু উত্তর করল,
—হ্যাঁ।’
—তা জামাল আপনাদের ঘর দেখিয়েছে?’
—হ্যাঁ, জামাল সাহেব আমাদের ঘর দেখিয়েছেন।’
ভদ্রলোক রাজুর দিকে না তাকিয়েই কথাগুলো বলছিল। রাজু ঘর দেখানোর কথা বলতেই লোকটা অদ্ভুতভাবে রাজুর দিকে তাকিয়ে বলল,
—জামাল তো সাহেব নয়। ও এ বাড়ির কেয়ারটেকার। তা আপনাদের ঘর পছন্দ হয়েছে?’
—হ্যাঁ, পছন্দ হয়েছে ঠিকই কিন্তু...’
—কিন্তু কী?’
—ভাড়াটা একটু আমাদের বাজেটের তুলনায় বেশি মনে হচ্ছে।’
বাড়িওয়ালা ভদ্রলোক জানতে চাইলেন
—আপনারা থাকবেন কতজন?’
অনির্বাণ উত্তর দিল,
—আমরা ছয়জন মেম্বার।’
—দেখুন আপনারা ব্যাচেলর। তাতে আমার কোনো অসুবিধা নেই। ঢাকা শহরে ব্যাচেলরদের বাড়ি ভাড়া পাওয়া যে কী মুশকিলের বিষয়, তা আমি জানি। আমি আমার বাড়িতে ব্যাচেলর ভাড়া দিই। কিন্তু আমার বাড়িতে থাকতে হলে আপনাদের শৃঙ্খলার সাথে থাকতে হবে।’
কথাটা বলতে বলতে লোকটা দুটো কাশি দিয়ে ঘরের ভেতরের উদ্দেশ্য করে জামালকে ডেকে বলল,
—জামাল, ওনাদের জলখাবার কিছু দে।’
জলখাবারের কথা শুনে অনির্বাণ ও রাজু দুজনেই একে অপরের দিকে উৎসুক দৃষ্টিপাত করল। কারণটা খুব সহজ, এই নিষ্ঠুর ঢাকা শহরে যেখানে ব্যাচেলরদের ঘর ভাড়াই দিতে চায় না, ভাড়া না দেবার কথাটা ন্যূনতম ভদ্রতার সুরেও বলে না, সেখানে এই ভদ্রলোক ওদের ঘর ভাড়া দিতে তো রাজি হচ্ছেনই উপরন্তু বৈঠক ঘরে বসিয়ে জলখাবার খাওয়াচ্ছেন।

বাড়িওয়ালা ভদ্রলোক আবার জিজ্ঞেস করলেন,
—আপনারা কে কী করেন?’
অনির্বাণ উত্তর দিল,
—আমি ছাত্র, অনার্স তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। আর রাজুদা চাকরিজীবী।’
ভদ্রলোক একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন,
—স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় আমিও ছাত্র ছিলাম। তখন আমার বয়স আপনার মতো ছিল। দেশমাতার মুক্তির সংগ্রামে আমি নিজেকে নিয়োজিত করেছি সে সময়ে। তখন আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। এই যে বাড়ি দেখছেন, এটা আমার বাবার তৈরি করা। আমি জীবনে তেমন কিছুই করতে পারিনি। কিন্তু দেশের মুক্তিসংগ্রামে অংশগ্রহণের যে মহান সুযোগ আমার জীবনে এসেছিল, তা আমি দায়িত্বের সাথে গ্রহণ করেছিলাম।’
লোকটা মুক্তিযোদ্ধা শুনে অনির্বাণের মধ্যে একটা শ্রদ্ধাবোধ জাগ্রত হয়ে উঠল। অনির্বাণ অত্যন্ত বিনয়ের সাথে বলল,
—আপনি দেশের জন্য যা করেছেন তার থেকে একজন মানুষের জীবনে বড় কাজ আর কী হতে পারে।’
—সেটা আপনি মনে করেন। কিন্তু বিত্তবৈভবের প্রতি আকর্ষণকেই তো সকলে এখন জীবনের মানে মনে করে। আমি দেশের তালিকাভুক্ত মুক্তিযোদ্ধা। এটাই আমার বড় পরিচয়। আমি যুদ্ধ করেছি একটা স্বাধীন পতাকার জন্য। কোনো রাষ্ট্রীয় বিশেষ সুবিধায় জীবন অতিবাহিত করার চিন্তা আমাদের সংগ্রামী চেতনার মধ্যে ছিল না। দেশের প্রতি আমি দায়িত্ব পালন করেছি, এটাই আমার একমাত্র প্রাপ্তি।’
ভদ্রলোকের কথা শুনে রাজু চুপ হয়ে আছে। অনির্বাণ কিছু একটা বলতে যাবে, এমন সময় ভদ্রলোক আবার বললেন,
—আপনাকে এই চেয়ার থেকে উঠে এপাশে বসতে বলাতে আপনি হয়তো মনে মনে আমার প্রতি রাগ করতে পারেন। কিন্তু এই চেয়ারটাতে আমি কাউকে বসতে দিই না।’
অনির্বাণ বিনয়ের সাথে বলল,
—না না, আমি কিছু মনে করিনি।’
—কিছু মনে না করলেও এর কারণটা আপনার জানার অধিকার আছে। আমি তখন ছাত্ররাজনীতির সাথে জড়িত ছিলাম। একাত্তরের শুরুর দিকের উত্তাল ঢাকা। তখন একবার আমাদের এই বাড়িতে তিনি এসেছিলেন এবং এই বৈঠকখানায় ওই চেয়ারটাতে বসে আমাদের সকলের সাথে বৈঠক করেছিলেন।’
—তিনি বলতে...?’
অনির্বাণের মুখে প্রশ্নটা করা শেষ হবার আগেই ভদ্রলোক চেয়ারটার দিকে আঙুল নির্দেশ করে বললেন,
—তিনি বঙ্গবন্ধু।’
ভদ্রলোকের মুখে কথাটা শুনে অনির্বাণের শরীরের প্রতিটা রোমকূপে বিদ্যুৎ খেলে গেল। 
—একটা মানুষ তাঁর জীবনের সবটা দিয়ে বাঙালি জাতিকে সংগঠিত করে গেছেন, এই স্বাধীন দেশটা উপহার দিয়ে গেছেন আমাদের। অথচ ভাবুন পঁচাত্তরে অমানুষগুলো কী নির্মমভাবে সেই মানুষটার বুকে...’
ভদ্রলোক কথাটা শেষ করতে পারলেন না। তার দুচোখ ভিজে গলাটা ধরে এলো।

জামাল একটা ট্রেতে করে জলখাবার নিয়ে ঘরে ঢুকল। জলখাবারের সময়টাতে বাড়ি ভাড়া নিয়ে আর কোনো কথা বলা হলো না অনির্বাণ ও রাজুর। শুধু বিদায় নেওয়ার সময় বাড়িওয়ালা বলে দিলেন,
—আপনারা যদি ঘর ভাড়া নিতে চান তবে আমাকে এক সপ্তাহের মধ্যে জানাবেন।’

মগবাজার ওয়্যারলেস মোড়ে দাঁড়িয়ে আছে অনির্বাণ, রাজু পাশের দোকান থেকে সিগারেট ধরাল একটা। দুজনের মুখে কোনো কথা নেই। রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে অনেক মানুষ, তারা কেউ জানে না, ওরা এই মুহূর্তে কী ঠিক ভাবছে? ওরা কি এ বাড়িতে ঘর ভাড়া নেওয়ার কথা ভাবছে নাকি অবচেতনে হৃদয় চক্ষু দিয়ে দেখতে পাচ্ছে ওই বৈঠকখানার চেয়ারে বসে আছেন বঙ্গবন্ধু আর তাঁর সামনে বসে আছে একদল যুবক।

Link copied!