• ঢাকা
  • রবিবার, ০৫ মে, ২০২৪, ২৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৫ শাওয়াল ১৪৪৫

আফগানিস্তানে নারীদের যতো নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে তালেবান


সংবাদ প্রকাশ ডেস্ক
প্রকাশিত: জুলাই ৪, ২০২৩, ০৫:১৪ পিএম
আফগানিস্তানে নারীদের যতো নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে তালেবান

আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখলের পর থেকেই নারীদের বিরুদ্ধে একের পর এক নিষেধাজ্ঞা জারি করে চলেছে তালেবান প্রশাসন। যদিও দ্বিতীয় দফা ক্ষমতায় এসে যুযোপযোগী শাসনব্যবস্থার কথা বলে নারীদের অধিকার রক্ষার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তারা। তবে বাস্তবে এর ছিটে ফোটাও লক্ষ্য করা যায়নি। উল্টো এসব নিয়মের বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে যখন নারীদের অবস্থা একেবারে নাজেহাল।

সরকারি কর্মচারী

ক্ষমতা গ্রহণের এক মাসের মধ্যে তালেবান সরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরিরত নারীদের অফিসে না এসে ঘরে বসে থাকার নির্দেশ দেয়। ২০২১ সালের ১৯শে সেপ্টেম্বর, কাবুল পৌরসভার নারী কর্মচারীদের বলা হয় শুধু তারাই অফিসে আসতে পারবে যাদের কাজগুলো কোনো পুরুষের পক্ষে করা সম্ভব নয়। এখন প্রায় সব সরকারি অফিসে এবং মন্ত্রণালয়ের নারী কর্মীরা ঘরে বসে রয়েছেন। শুধু মাসে একদিনে অফিসে গিয়ে বেতন তুলে আনেন তারা।

শিক্ষার অধিকার
আফগানিস্তানের বিশ্ববিদ্যালয়ে নারীদের নিষিদ্ধ করেছে তালেবান। তালেবানের উচ্চ শিক্ষামন্ত্রীর একটি চিঠিতে এ নিষেধাজ্ঞার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। মূলত ষষ্ঠ শ্রেণির পরেই মেয়েদের ঘরে থাকতে হবে বলে জানানো হয়েছে। তার পর তারা আর পড়াশোনার অধিকার পাবে না।

নারী বিষয়ক মন্ত্রণালয় বিলুপ্ত
২০০১ সালে নারীদের জন্য আলাদা একটি মন্ত্রণালয় খুলেছিল তখনকার সরকার। ২০২১ সালে ক্ষমতায় এসে সেই মন্ত্রণালয় বন্ধ করেছে তালেবান।

মেনে নিতে হবে গৃহনির্যাতন
তালেবান মিনিস্ট্রি ফর প্রোপাগেশন অব ভার্চু অ্যান্ড দ্য প্রিভেনশন অব ভাইস-এর নির্দেশনায় বলা হয়েছে, গৃহ নির্যাতনের স্বীকার হলেও নারীদের স্বামীর সংসার ছেড়ে যাওয়া যাবে না।

টিভি এবং অভিনয়

টেলিভিশন এবং চলচ্চিত্রে নারীদের চেহারা দেখানো সীমিত করে তালেবান। এর আগে ২০২১ সালের নভেম্বরে টিভি নাটকে নারীদের অভিনয় নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। নারী সাংবাদিক এবং উপস্থাপকদের ক্যামেরার সামনে মাথায় হিজাব পরার নির্দেশ দেওয়া হয়। নিরাপত্তার ভয়ে অনেক নারী মিডিয়া কর্মী কাজ ছেড়ে দেন। অনেকে বিদেশে পালিয়ে যান। এমনকি যেসব নারী নাটকে কণ্ঠ দিতেন তাদেরও ওপর বিধিনিষেধ দেওয়া হয়।

২০০১ সাল থেকে আফগানিস্তানে বিদেশি বিভিন্ন সিরিয়াল স্থানীয় ভাষায় ডাবিং করে প্রচার করা হচ্ছিল। শত শত নারী এগুলোতে নিয়মিত কণ্ঠ দিতেন। এসব বিদেশী সিরিয়াল তালেবান নিষিদ্ধ করে দেয়। ফলে চাকরি হারান শত শত নারী।

খেলাধুলায় অংশগ্রহণ
তালেবান নতুন করে ক্ষমতা নেওয়ার পর থেকে আফগান নারীরা কোনো ধরনের খেলাধুলায় অংশ নিতে পারেনি, কারণ নারীদের খেলাধুলার ওপর অলিখিত নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে।

২০২১ সালের ৮ই সেপ্টেম্বর তালেবান সরকারের সংস্কৃতি বিষয়ক উপমন্ত্রী আহমাদুল্লাহ ওয়াসিক বলেন, খেলাধুলায় মেয়েদের অংশগ্রহণ শুধু “অনুচিতই নয়, একইসাথে অপ্রয়োজনীয়”। কারণ, তার মতে, খেলাধুলো করতে গিয়ে মেয়েদের পক্ষে শরীর এবং মুখ ঢেকে রাখা সম্ভব নয়, ফলে তা শারিয়া বিরোধী।"

একা একা দূরে নয়
আফগানিস্তানের নারীরা ৭২ কিলোমিটারের (৪৫ মাইল) চেয়ে বেশি দূরে একা যেতে পারবেন না। যেতে হলে সঙ্গে কোনো পুরুষকে রাখতে হবে। তালেবান মিনিস্ট্রি ফর প্রোপাগেশন অব ভার্চু অ্যান্ড দ্য প্রিভেনশন অব ভাইস এক নির্দেশনায় কোনো চালক যাতে কখনো একা দূরে যেতে আগ্রহী নারীকে গাড়িতে না তোলেন সেই কথাও বলা হয়েছে।

ভ্রমণ বিধিনিষেধ
তালেবান ২০২১ সালের ডিসেম্বরে নারীদের যাতায়াত এবং ভ্রমণের ওপর বিধিনিষেধ জারি করে। নৈতিকতা বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে একটি নির্দেশনা জারি করা হয় যেখানে ট্যাক্সি ড্রাইভারদের বলা হয় হিজাববিহীন নারীদের যেন তারা যাত্রী হিসাবে না ওঠায়। তাছাড়া, পুরুষ সঙ্গী (বাবা, পুত্র, স্বামী বা ভাই) না থাকলে কোনও নারী ৪৫ মাইলের বেশি দূরে ভ্রমণ নিষিদ্ধ করা হয়।

২৭শে ফেব্রুয়ারি, ২০২২ এ তালেবান পুরুষ সঙ্গী ছাড়া নারীদের বিদেশভ্রমণ নিষিদ্ধ করে।

নারী-পুরুষ একসঙ্গে নয়
গত আগস্টে আফগানিস্তানের দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর কান্দাহারের দখল নিয়েই সেখানকার বিভিন্ন ব্যাংকে গিয়ে নারীদের বের করে দেয় তালেবান। পরে অন্যান্য শহরেও নারীদের কর্মস্থল ত্যাগের নির্দেশ দিয়েছে তারা। ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে তালেবানের এক সিনিয়র কর্মকর্তা বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেন, তারা মনে করেন, আফগান নারীদের পুরুষদের সঙ্গে বসে কাজ করা উচিত নয়।

২০২১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তালেবানের শিক্ষামন্ত্রী ঘোষণা করেন, দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ে নারী ও পুরুষকে আলাদা বসতে হবে এবং সবাইকে ‘ইসলামি পোশাক’ পরতে হবে।

ছাত্র ও ছাত্রীদের আলাদা করে দেওয়া

ক্ষমতা নেওয়ার এক মাসের মধ্যে তালেবান বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে তাদের নারী ও পুরুষ শিক্ষার্থীদের পৃথক শিক্ষাদানের নির্দেশ দেয়। প্রথম দিকে ক্লাসরুমে নারী ও পুরুষ শিক্ষার্থীদের দুই পাশে বসিয়ে মাঝখানে পর্দা ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। পরে শ্রেণীকক্ষ আলাদা করে দেওয়া হয়। এরপর নারী ও পুরুষ শিক্ষার্থীদের জন্য আলাদা আলাদা দিন ধার্য করে দেওয়া হয়। এরপর নারীদের বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়া বন্ধ করে দেয়।

বিদেশী ভাষা এবং ধর্ম শিক্ষা
২০২২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে কাবুল এবং অন্যান্য প্রদেশে বিদেশী ভাষা শিক্ষার কিছু প্রতিষ্ঠান বিবিসিকে জানায় তালেবান এগুলো একরকম জোর করে বন্ধ করে দিয়েছে। শর্ত দেওয়া হয়েছে নারী এবং পুরুষ শিক্ষার্থীদের পৃথক ক্লাসের ব্যবস্থা করতে হবে, এবং নারীদের জন্য শুধু নারী প্রশিক্ষক নিয়োগ করতে হবে। অনেক পরিবার অভিযোগ করেছে অনেক মসজিদ ধর্ম শিক্ষার ক্লাস থেকে মেয়েদের বাড়ি ফিরিয়ে দিয়েছে।

এনজিও
২০২২ সালের ২৪শে ডিসেম্বর তালেবান সরকার সমস্ত জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক বেসরকারি সাহায্য সংস্থা বা এনজিওতে নারীদের নিয়োগ নিষিদ্ধ করে।

সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে এক চিঠিতে এসব প্রতিষ্ঠানকে বলা হয়, পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত তারা যেন তাদের নারী কর্মীদের সাময়িকভাবে বরখাস্ত করে। তালেবানের যুক্তি ছিল এসব প্রতিষ্ঠানে হিজাবসহ ইসলামের অন্যান্য বিধি-নিষেধ অনুসরণ করা হচ্ছে না।

এছাড়া হেরাত প্রদেশে বাগান বা সবুজ জায়গাসহ (পার্কে) রেস্তোরাঁগুলোতে নারীদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সম্প্রতি ধর্মীয় বিশেষজ্ঞরা বাগানের মতো সবুজ খোলামেলা স্থানে নারী-পুরুষের ঘুরে বেড়ানোর অভিযোগ তোলার পরই এসব জায়গায় নারী ও পরিবারের আগমন নিষিদ্ধ করে তালেবান প্রশাসন।

পবিত্র রমজান মাসে ‘গান’ সম্প্রচারের অভিযোগে আফগানিস্তানের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে নারীদের পরিচালিত একটি রেডিও স্টেশন বন্ধ করে দিয়েছে তালেবান সরকার। একজন তালেবান কর্মকর্তা এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। বন্ধ করে দেওয়া ওই রেডিও স্টেশনের নাম সাদাই বানোওয়ান। যার অর্থ নারীর কণ্ঠ।

সর্বশেষ এ তালিকায় যুক্ত হয়েছে রাজধানী কাবুলসহ অন্যান্য প্রদেশে মেয়েদের রূপচর্চা কেন্দ্র বা বিউটি পার্লার বন্ধের নির্দেশনা। এ ব্যাপারে একটি মৌখিক ডিক্রি জারি করা হয়েছে।

এই প্রতিবেদনটির সকল তথ্য সংবাদমাধ্যম বিবিসি থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে।

Link copied!