• ঢাকা
  • রবিবার, ০৫ মে, ২০২৪, ২২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৫ শাওয়াল ১৪৪৫

কাছে-দূরের মেহেদি হাসান


আরাফাত শান্ত
প্রকাশিত: জুন ১৩, ২০২৩, ১১:৪০ এএম
কাছে-দূরের মেহেদি হাসান

কথিত আছে, মেহেদি হাসান চরস খেতেন। তাঁর নেশা বলতে ছিল এটাই। তো একজন অভিযোগ দিলেন তাঁর ওস্তাদের কাছে যে মেহেদি হাসান তো চরস খায়, আপনি কিছু বলেন না। ওস্তাদ শুনে হেসে বলেছিলেন, “তুমি সারা বছর চরস খেয়ে যদি মেহেদির মতো একটা কণ্ঠ বানাতে পারো, তাহলে তুমিও খাও, কে মানা করেছে।”

সংগীতের উৎসাহ তাঁর পরিবার থেকেই প্রাপ্ত। তাঁর বাবা ওস্তাদ আজিম খান ও চাচা ইসমাইল খান ছিলেন প্রথম শিক্ষাগুরু। ১৯২৭ সালে রাজস্থানে জন্ম তাঁর। কিশোর বয়স থেকেই তিনি ‘প্রডিজি’। জনশ্রুতি আছে, একবার বারোদার মহারাজার দরবারে প্রায় ৪০ মিনিট ‘রাগ বসন্ত’ পরিবেশন করে উপস্থিত সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন তিনি, তখন তার বয়স ছিল নাকি মাত্র ৮ বছর।

সংগীত তাঁর রক্তে। শিখতেন, স্বর সাধনা করতেন। কিন্তু এমন সময় এলো ভয়াল দেশভাগ। পার্টিশনে ওনারা পরিবারের সবাই পাকিস্তানে চলে যান। পাকিস্তানের সঞ্চিয়াল জেলার ছিচা ওয়াতনি এলাকায় বসতি গড়েন। অভাব-অনটনের পরিবারে বড় ছেলে তিনি, ২০ বছরের তরুণ মেহেদির জন্য তাই তখন জীবনটা ছিল বেশ অস্বস্তিকর। পরিবারের অভাব-অনটন কিছুটা লাঘবের জন্য মেহেদি চাকরি নেন সাইকেল মেরামতের দোকানে। শিখলেন ট্রাক্টর আর গাড়ির মেকানিকের নানা কাজ। তেল-কালি-ঝুলির মধ্যে জীবিকা নির্বাহ করলেও, সংগীতচর্চা থেকে অবশ্য তিনি দূরে সরে থাকেননি। বরং গান হয়ে ওঠে তার একলা মনের খোরাক। সময়-সুযোগ পেলেই সংগীতের কঠোর সাধনা তিনি করে গেছেন নিয়মিতই। অচেনা, অজানা বন্ধু-বান্ধবহীন পরিবেশে সংগীত হয়ে ওঠে তার বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা।

উর্দু গানের কিংবদন্তি এ শিল্পীর উর্দু ভাষাতে ছিল না সে রকম দখল। তিনি সেভাবে পড়েনওনি উর্দু সাহিত্য। শুধু শুনে গেছেন। কিন্তু তাঁর গান শুনলে কে বলবে সেই কথা। ১৯৫৭ সালে রেডিও পাকিস্তানে অডিশনের সুযোগ পান মেহেদি হাসান। অডিশনে একের পর এক গাইলেন ঠুমরি, রাগ-খাম্বাজ, পিলু, দেশ ইত্যাদি বিভিন্ন ঘরানার শাস্ত্রীয় সংগীত। তার অসাধারণ সুরের জাদুতে মুগ্ধ হন বিচারকগণ। তাকে ৩৫ রুপি সম্মানীতে ‘এ’ গ্রেডের ঠুমরি শিল্পী হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়। রেডিওতে গান গাওয়ার সুবাদে তার পরিবারের যেমন আর্থিক সংকট লাঘব হয়, তেমনি সংগীত জগতে ধীরে ধীরে পরিচিতি লাভ শুরু করেন মেহেদি হাসান।

প্রথম দিকে তিনি আসর জমাতে পারতেন না। কেউ কেউ তাঁকে একঘেয়ে বলত। এ সময় তিনি ঝুঁকে পড়েন উর্দু কবিতার প্রতি। কিছু কবিতাও লেখেন তিনি উর্দুতে এবং তাতে সুর করেন। একবার রেডিওর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অনুরোধে পরীক্ষামূলকভাবে দুটো গজল পরিবেশন করেন, আর তাতেই তার জীবনের মোড় ঘুরে যায়। তিনি রেডিওতে আরও বেশ কয়েকটি গজল পরিবেশনের মাধ্যমে শ্রোতাদের মন কাড়েন। গজল শিল্পী হিসেবে হিসেবে তিনি ব্যাপক পরিচিতি পেতে থাকেন তখন থেকেই। ‘ম্যায় হোস ম্যায় থা তো ফির’, ‘রাফতা রাফতা ও মেরি হাস্‌তি কা সামান হো গ্যায়ি’, ‘খুবাকু ফেইল গেয়ি’, ‘মহব্বত করনে ওয়ালে’, ‘দুনিয়া কিসিকে পেয়ার’, ‘জিন্দেগি মে তো সাবহি পেয়ার কিয়া কারতি হে’, ‘বাত কারনি মুঝে মুশকিল’, ‘খুলি জো আঙ্গা ওহ থা’, ‘আব কি বিচরে’ সহ বহু গজল তাকে এনে দেয় গজলের মুকুটহীন সম্রাটের সম্মান। সংগীত ও গজল হয়ে ওঠে তার আমৃত্যু সঙ্গী।

১৯৬২ সালে পাকিস্তানের উর্দু চলচ্চিত্রে প্রথম প্লে ব্যাক করার সুযোগ পান মেহেদি হাসান। তার গাওয়া ‘জিস নে মেরে দিল কো দর্দ দিয়া’ গানটি শ্রোতাদের বেশ প্রশংসা কুড়িয়েছিল। ১৯৬৪ সালে ‘ফারাঙ্গি’ ছবিতে কবি ফয়েজ আহমদ ফয়েজের সৃষ্টি ‘গুল সে রাংগ ভারে’ গজল গানটির প্লে ব্যাক শিল্পী হিসেবে তিনি ব্যাপক খ্যাতি অর্জন করেন। এরপর আর তাকে থেমে থাকতে হয়নি। একের পর এক জনপ্রিয় গানের প্লেব্যাক শিল্পী হিসেবে চলচ্চিত্র জগতে তিনি স্থায়ী আসন করে নেন। পাকিস্তানের চলচ্চিত্রে শতাধিক গান গেয়েছেন এই শিল্পী। আমার ব্যক্তিগতভাবে বেশি প্রিয়, নায়ক ওয়াহিদ মুরাদের লিপে, ‘মুজে তুম নাজার ছে গিরা তো রাহে হো।’ এ রকম গান শুনলেই মনটা প্রশান্তিতে ভরে যায়।

হাজার হাজার দর্শকের সামনে পাকিস্তানে গজল পরিবেশন করা শিল্পী তিনি। লতা মঙ্গেশকর তার সংগীত শুনে বলেছিলেন, “স্বয়ং ঈশ্বর যেন তার কণ্ঠে অবস্থান করেন।” আরেক কিংবদন্তি জগজিৎ সিং বলেছিলেন “তার মাপের গজল শিল্পী আরেকজন তৈরি হওয়া অসম্ভব।” শিল্পী আবিদা পারভীনের মতে, ‘মেহেদি হাসান গাইলে তিনি সুরগুলো চোখে দেখতেন।’ আরেক মহান গায়ক মো. রফি বলেছিলেন, “জনগণের জন্য আমরা গান করি, আর আমাদের জন্য গান করেন মেহেদী হাসান।” উর্দু গজল ছাড়াও বাংলা গানেও রয়েছে তাঁর স্মরণযোগ্য অবদান। তাঁর গাওয়া বাংলা গান, ‘হারানো দিনের কথা মনে পড়ে যায়’, ‘ঢাকো যত না নয়ন দুহাতে’, ‘তুমি যে আমার’ প্রভৃতি গান বাংলাদেশের সংগীতপ্রেমীরা চিরদিন মনে রাখবে। এমন শিল্পীদের কখনোই দেশ কালের সীমায় বাঁধা যায় না। এরা সর্বদেশের, সর্বকালের, সর্বমানবের। 
আশির দশকের শেষ দিক থেকেই তিনি নিজেকে গুটিয়ে নেন অসুস্থতার জন্য। শেষ ভারতে গেয়েছিলেন ২০০০ সালে। দীর্ঘদিন অসুস্থতার পর অবশেষে এই নশ্বর পৃথিবী থেকে তাঁর মহাপ্রয়াণ ঘটে ২০১২ সালের আজকের দিকে। মৃত্যুদিনে টানা শুনেই যাচ্ছি, ‘মোহাব্বত কারনে ওয়ালে কাম না হোঙ্গে/ তেরে মেহফিল নে লেকিন হাম না হোঙ্গে।’

Link copied!