• ঢাকা
  • সোমবার, ২৯ এপ্রিল, ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫
ঘটছে সংঘাত-সংঘর্ষ

স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মানতে পারছে না তৃণমূল আ. লীগ


সফিকুল ইসলাম
প্রকাশিত: ডিসেম্বর ২০, ২০২৩, ০৫:২৮ পিএম
স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মানতে পারছে না তৃণমূল আ. লীগ
মঙ্গলবার জামালপুরের সরিষাবাড়িতে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে নৌকা ও স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থকেরা। ছবি- সংগৃহীত

আগামী ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। প্রতীক বরাদ্দ পেয়ে সোমবার থেকে প্রচার কাজে নেমে পড়েছে প্রার্থী ও তার নেতা-কর্মী-সমর্থকরা। প্রচারে নেমেই সংঘাতে জড়াচ্ছে আওয়ামী লীগ ও স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থকেরা। সারা দেশের অনেক সংসদীয় আসনেই ঘটছে এই অপ্রীতিকর ঘটনা।

নির্বাচনে সারা দেশে প্রায় ১ হাজার ৯০০ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এর মধ্যে স্বতন্ত্র প্রার্থীর সংখ্যাই বেশি। দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে আওয়ামী লীগের অনেক নেতা স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন। কৌশলগত কারণে দলটি স্বতন্ত্র প্রার্থীদের স্বাগত জানিয়েছে। কিন্তু এ বিষয়টি মানতে পারছে না তৃণমূল আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা। যে কারণে প্রচার কাজে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের নানা রকমের প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়তে হচ্ছে।

গতকাল মঙ্গলবার (১৯ ডিসেম্বর) সকালে বেনাপোল স্থলবন্দরে প্রচার চালানোর সময় স্বতন্ত্র প্রার্থীর উপর নৌকার সমর্থকরা হামলা করে বলে অভিযোগ ওঠে।  সেই ঘটনার জেরে স্বতন্ত্র প্রার্থী আশরাফুল আলম লিটনের পক্ষে ও বিপক্ষের আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী ও শ্রমিকদের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও হামলার ঘটনা ঘটে। সংঘর্ষে স্বতন্ত্র প্রার্থী লিটনসহ ১০ জন আহত হয়। এ ঘটনায় উভয় পক্ষ দফায় দফায় প্রতিবাদ মিছিল করে। তারা একে অপরের বিরুদ্ধে পাল্টাপাল্টি অভিযোগও করেন।

ওই ঘটনায় শার্শা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নয়ন কুমার রাজবংশী জানান, ঘটনাস্থল পরিদর্শন করা হয়েছে। আচরণবিধি লঙ্ঘন করা জরিমানা করা হয়েছে। সবাইকে সুষ্ঠুভাবে প্রচার চালানোর আহ্বান জানানো হয়েছে। যশোরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বেলাল হোসাইন জানান, স্বতন্ত্র প্রার্থীর নির্বাচনী প্রচারে আচারণবিধি লঙ্ঘন হয়েছে, সেই বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।

একইদিন পাবনা-১ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী ও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক অধ্যাপক আবু সাইয়িদের নির্বাচনী প্রচারে বাধা দিয়ে অবরুদ্ধ করে রেখেছিল আওয়ামী লীগ কর্মীরা। দুই ঘণ্টা পর সাঁথিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আলপনা ইয়াসমিনের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়। মঙ্গলবার বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে  সাঁথিয়া বাজারের বোয়ালমারী মোড়ে এ ঘটনা ঘটে। 

এ বিষয়ে সাঁথিয়া উপজেলা ভাইস-চেয়ারম্যান সোহেল রানা খোকন বলেন, “নির্বাচনের প্রচারে বাধা দেওয়ার অভিযোগ সত্য নয়। আজকে নৌকার প্রার্থী শামসুল হক টুকুর নির্বাচনী প্রোগ্রাম ছিল। সেই প্রোগ্রামকে বাধাগ্রস্ত করতেই অধ্যাপক আবু সাইয়িদ আজকে এই এলাকায় এসেছিল। তারাই আমাদের মিছিলের সামনে গাড়ি রেখে বাধাগ্রস্ত করেছিল।”

একইভাবে সংঘর্ষ হয় জামালপুরের সরিষাবাড়ী উপজেলায়। সেখানে দুই প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। মঙ্গলবার (১৯ ডিসেম্বর) দুপুরে স্টেশন রোড এলাকায় নৌকা প্রতীকের সমর্থক ও স্বতন্ত্র ট্রাক প্রতীকের সমর্থকের মধ্যে এই ঘটনা ঘটে।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, স্টেশন রোড এলাকায় স্বতন্ত্র (ট্রাক) প্রার্থী আবদুর রশীদের সমর্থক মিঠুর সঙ্গে আওয়ামী লীগ মনোনীত (নৌকা) প্রার্থী প্রকৌশলী মো.মাহবুবুর রহমান হেলালের সমর্থকদের সংঘর্ষ হয়। দলীয় প্রতীক নিয়ে কথা-কাটাকাটির এক পর্যায়ে এই সংঘর্ষ শুরু হয়। এ সময় উভয়পক্ষের ৪ জন আহত হয়। আহতরা হলেন- লুৎফর রহমান, ফারুক হোসেন মিঠু ও সাবেক কমিশনার বেলাল হোসেন।

এ বিষয়ে নৌকার প্রার্থী মাহবুবুর রহমান হেলাল (নৌকা প্রতীক) সাংবাদিকদের জানান, স্বতন্ত্র প্রার্থী অধ্যক্ষ আবদুর রশীদের লোকজন প্রথমে পরিকল্পিতভাবে কমিশনার বেলালের উপর আক্রমণ চালালে উভয় পক্ষের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় কমিশনার বেলাল ও লুৎফর আহত হয়। সংবাদ পেয়ে ঘটনাস্থলে পুলিশ এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। তবে এ ঘটনায় স্বতন্ত্র প্রার্থী অধ্যক্ষ আবদুর রশীদ (ট্রাক প্রতীক) সাংবাদিকদের জানান, নৌকা সমর্থকরা আমার কর্মী মিঠুকে অতর্কিতভাবে হামলা করে গুরুতর আহত করেন। এছাড়াও ফারুক হোসেনকে মারপিট করেছে। এ ঘটনায় মিঠু সরিষাবাড়ি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছে।

টাঙ্গাইলের ভুঞাপুরে আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থী ইউনুস ইসলাম তালুকদারের নির্বাচনী সভায় হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। মঙ্গলবার দুপুরে ভুঞাপুর কাচার বাজারস্থ ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্স কার্যালয়ের সামনে নির্বাচনী সভা চলাকালে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী তানভীর হাসান ছোট মনিরের অনুসারীরা হামলা চালায় বলে অভিযোগপত্রে উল্লেখ করেন তিনি। এরপর বিকেলে গাড়িযোগে নির্বাচনী প্রচারের সময় আবারও হামলার শিকার হন এই স্বতন্ত্র প্রার্থী। দুইবারের হামলার ঘটনায় পরিস্থিতি উত্তপ্ত রয়েছে সেখানে। ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে থানা ও নির্বাচন কমিশনে অভিযোগ দিয়েছেন স্বতন্ত্র ওই প্রার্থী।

অন্যদিকে বরিশাল ৫ আসনেও ঘটে এমন ঘটনা। স্থানীয় ও আহতদের সূত্রে জানা গেছে, পলাশপুরে সোমবার রাতে নির্বাচনী অফিস উদ্বোধন অনুষ্ঠানে রওয়ানা করেন স্থানীয় আওয়ামীলীগ কর্মী ও নৌকা প্রতীকের সমর্থক আব্দুল হালিম। পথিমধ্যে স্বতন্ত্র প্রার্থী সাদিক আব্দুল্লাহর সমর্থকরা তার পথরোধ করে ওই অনুষ্ঠানে যেতে বাধা দেয়। এক পর্যায় দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে। এসময় আব্দুল হালিমকে কুপিয়ে জখম করে প্রতিপক্ষরা। বাধা দিলে তার তিন সন্তানকেও কোপায় হামলাকারীরা। ঘটনার সময় একটি মটরসাইকেলে আগুন ধরিয়ে দেয় প্রতিপক্ষ। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে গেলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়। 

এরআগে কুমিল্লা-১১ (চৌদ্দগ্রাম) আসনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী ও বর্তমান সংসদ সদস্য মুজিবুল হকের সমর্থকদের বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র প্রার্থী সাবেক মেয়র মিজানুর রহমানের প্রচার কাজে হামলার অভিযোগ উঠে। গত সোমবার সন্ধ্যা ৭টায় চৌদ্দগ্রাম উপজেলার কাশিনগর ইউনিয়নে কাশিনগর বাজারে উভয় পক্ষের গণসংযোগের সময় প্রতিপক্ষের হামলায় ২জন আহত হয়েছে বলে দাবি করেন ফুলকপি প্রতিকে নির্বাচনে অংশ নেয়া আওয়ামী লীগ নেতা মিজানুর রহমান।

পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা যায়, সোমবার সন্ধ্যা ৭টার দিকে স্বতন্ত্র প্রার্থী মিজানুর রহমান মিজান গণসংযোগে কাশিনগর বাজারে গেলে বর্তমান সংসদ সদস্য মুজিবুল হক মুজিবের নেতাকর্মীরা ককটেল বিষ্ফোরণ করে ধাওয়া দেয়। পরে উভয় পক্ষ সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। এ ঘটনায় মিজানের ২ অনুসারী আহত হয়। আহতদের চৌদ্দগ্রাম উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়েছে।

পিরোজপুর-১ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী এ কে এম এ আউয়ালের সমর্থকদের ওপর হামলার ঘটনায় থানায় মামলা হয়েছে। সোমবার (১৮ ডিসেম্বর) সকালে স্বতন্ত্র প্রার্থী ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এ কে এম এ আউয়ালের ছোট ভাই সদর উপজেলা চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান খালেক বাদী হয়ে মামলা করেন।

চট্টগ্রাম-১৪ (চন্দনাইশ-সাতকানিয়া আংশিক) স্বতন্ত্র প্রার্থী আব্দুল জাব্বার চৌধুরী তার গণসংযোগে হামলার আশঙ্কায় নিরাপত্তা চেয়ে জেলা রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে অভিযোগ দায়ের করেছে। সোমবার বিকেলে চট্টগ্রাম জেলা রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে এই আসনের নৌকা প্রতীকের প্রার্থীর ছোট ভাইসহ স্থানীয় ৫ নেতার বিরুদ্ধে এই অভিযোগ করেন।

এদিকে, ভোলা সদর উপজেলার ভেদুরিয়া ইউনিয়নে স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থকদের ওপর আওয়ামী লীগ সমর্থীত নৌকার প্রার্থী আবদুল হাইয়ের সমর্থকদের হামলায় অন্তত ২৫ জন আহত হয়েছে। সোমবার দুপুর ১টার দিকে ভেদুরিয়া ইউনিয়নের ১ নং ওয়ার্ড ব্যাংকের হাট কলেজ চর-রোমিজ এলাকায় হামলার ঘটনা ঘটে। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে। এ সময় সেখান থেকে তিনজনকে আটক করে পুলিশ।

বিশ্লেষকরা বলছেন, আওয়ামী লীগ আন্তর্জাতিকভাবে এই নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করতে চায়। এ কারণে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মাঠে রাখার কোনো বিকল্প ছিল না। জাতীয় পার্টি বা অন্যান্য যে রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছে, তারা আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তুলতে পারত না। ফলে নির্বাচন হতো একপেশে, আকর্ষণহীন এবং ভোটারদের উপস্থিতি থাকত কম। এরকম নির্বাচন জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্যতার সঙ্কটে ভুগতো। এ কারণেই আওয়ামী লীগ স্বতন্ত্র প্রার্থীদের জন্য উদারনীতি গ্রহণ করেছে। তবে এই উদারনীতি আওয়ামী লীগের জন্য সঙ্কটের কারণ হতে পারে বলে মনে করছেন কেউ কেউ।

Link copied!