কথা হচ্ছিল গৃহকর্মী বিলকিসের সঙ্গে। চার মাসের গর্ভবতী তিনি। তবুও যেন তার বিশ্রাম নেই। এই শরীরে ৯ তলা অ্যাপার্টমেন্ট ভবনের তিনটি ফ্ল্যাটে প্রতিদিন কাজ করেন। শরীর কুলোয় না। হাঁপিয়ে ওঠেন একটুতে। তবুও কাজ ছাড়েন না। কাজ ছাড়লেই যে, বেতন পাবেন না। আর বেতন না পেলে খাবার জুটবে না। এর কারণে বেকার স্বামীর নির্যাতনের শিকার হতে হবে তাকে।
বিলকিসের ভাষ্য, “আমার বেডা (স্বামী) কোনো কাম করে না। ঘোরে ফেরে খায় দায়। কিছু কইলে মারতে আসে। অনেকবার কইছি কয়ডা দিন কাজ বন্ধ রাহি (রাখি)। হ্যায় কয়, খাওন কি তোর বাপে দেবে? আপনি কন, এই শরীলে (শরীরে) কাম করা যায়!”
বিলকিস আরও জানালেন, তার দুই মেয়ে। তৃতীয় সন্তানও যদি মেয়ে হয় তাহলে তার দায়িত্ব নেবেন না তার স্বামী। বিলকিসের কথায়, “আমি তো জানি না পোলা (ছেলে) না মাইয়া (মেয়ে) হবে। আমার দোষ কিসের? আমি ইচ্ছা কইরা তো কিছু করতাছি না। চিন্তায় আছি। জানি না কি হবে!”
শুধু বিলকিস নন—প্রতিদিন এমন হাজারো বিলকিস বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার হন। নারী নির্যাতন প্রতিরোধ আইন থাকার পরও নারীর প্রতি সহিংসা কমছে না। বরং পাল্লা দিয়ে বাড়ছে।
প্রতি বছর বাংলাদেশে ২৪ আগস্ট ‘জাতীয় নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস’ পালিত হয়। এই দিবস পালনের প্রেক্ষাপট অত্যন্ত হৃদয়বিদারক।
২৬ বছর আগে ১৯৯৫ সালের এই দিনে দিনাজপুরে ১৩ বছর বয়সী কিশোরী ইয়াসমিনকে কয়েকজন পুলিশ সদস্য ধর্ষণের পর হত্যা করে। ওই ঘটনায় দিনাজপুরসহ সারাদেশের মানুষ ফুঁসে ওঠে। দিনাজপুরে বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলিতে প্রাণ হারায় সাতজন। শেষ পর্যন্ত বিচারে তিন পুলিশ সদস্যের ফাঁসির দণ্ড কার্যকর করা হয়।
শীর্ষস্থানীয় নারী সংগঠন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ ১৩টি বাংলা ও ইংরেজি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে সারা দেশে নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতনের তথ্য সংরক্ষণ করে। সংরক্ষিত তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০২০ সালের প্রথম ছয় মাসে ধর্ষণ, গণধর্ষণ, হত্যাসহ নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতনের মতো বিভিন্ন অপরাধের সংখ্যা ছিল ১৪৫১। চলতি ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত এ ধরনের অপরাধ সংঘটিত হয়েছে ১৭৯৪টি। এ হিসাবে বৃদ্ধির হার প্রায় ২৪ শতাংশ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যে লক্ষ্যে ‘জাতীয় নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস’ পালন করা হচ্ছে সেই লক্ষ্য এখনো পূরণ করা সম্ভব হয়নি। তাদের মতে, নারীর প্রতি পুরুষের কতৃত্ব স্থাপনের প্রবণতার কারণে নারী নির্যাতন কমছে না। তারা এটাও মানছেন, বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশে নারী নির্যাতন শূণ্যের কোঠায় নামিয়ে আনা দুরূহ কাজ বলা যায়।
মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু জানিয়েছেন, সাম্প্রতিক সময়ে নারী নির্যাতন বেড়ে গেলেও করোনাভাইরাসের কারণে তথ্য প্রবাহে বিঘ্ন ঘটায় প্রকৃত চিত্র উঠে আসছে না।
তিনি বলেন, “পত্রিকায় যে তথ্যগুলো পাচ্ছি, সে তথ্যগুলোই আমরা দিচ্ছি। কিন্তু গণমাধ্যমে সব তথ্য তো উঠে আসছে না। বিশেষ করে লকডাউনে খুব কম রিপোর্ট হয়েছে। তবে আমরা যারা এসব নিয়ে কাজ করছি, তারা দেখছি ধর্ষণসহ অন্যান্য নির্যাতনের ঘটনা আগের চেয়ে অনেক বেশি বেড়ে গেছে।”
জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির নির্বাহী পরিচালক অ্যাডভোকেট সালমা আলী বলেন, “দেশে নারী নির্যাতন আইন আছে। কিন্তু আইন দিয়ে তো সবকিছু হয় না। নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা পরিহার করতে না পারলে নারী নির্যাতনের মতো ঘটনা ঘটতেই থাকবে।”
তিনি আরও বলেন, “নারী নির্যাতনের মামলাগুলি নিষ্পত্তির হার খুবই কম। আর ধর্ষণের মামলা নিয়ে কালক্ষেপণ হয়। ফলে অনেক দরিদ্র্য পরিবার মামলা চালাতে পারেন না, অথবা নানা চাপের শিকার হয়ে শেষ পর্যন্ত সুবিচার দেখতে পায় না।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান খন্দকার ফারজানা রহমান বলেন, “নারী নির্যাতন বেড়ে যাওয়ার পেছনে আমাদের সমাজ ব্যবস্থা দায়ী। এদেশের প্রায় প্রতিটি ঘরে নানাভাবে নারীরা নির্যাতিত হন। কোনো শিশু যখন দেখে তার মা, খালা, চাচী বা বোন নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন, তখন তার মধ্যে ছোটবেলা থেকে পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা নিয়ে বড় হয়। পরিবারে মা ও মেয়েদের প্রতি বাবার সহিংস আচরণ প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ছড়ায়।”
তিনি মনে করেন, বাংলাদেশ নারী নির্যাতনের ‘উর্বর’ ভূমি। এখানকার সামাজিক কাঠামো সেভাবেই তৈরি হয়েছে। এই কাঠামো ভাঙতে না পারলে নারীরা কখনো নির্ভয়ে জীবন-যাপন করতে পারবেন না।