‘কোথায় স্বর্গ, কোথায় নরক, কে বলে তা বহুদূর? মানুষেরি মাঝে স্বর্গ নরক, মানুষেতে সুরাসুর।’ এই অবিস্মরণীয় কবিতার রচয়িতা কবি শেখ ফজলল করিমের ৮৫তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ বৃহস্পতিবার (২৮সেপ্টেম্বর)। দিনটি অনেকটা নিরবে নিভৃতে পেরিয়ে গেছে। এদিন কবির পরিবারের পক্ষ থেকে কোনো আয়োজন না করে কবির স্মৃতিচিহ্নবিজড়িত কক্ষে ঝুলিয়ে রাখা হয় তালা। তাই প্রতি বছরের ন্যায় মৃত্যুবার্ষিকীতে দূরদূরান্ত থেকে কবির বাড়িতে আসা দর্শনার্থী ও কবিপ্রেমীরা ফিরে গিয়ে দুঃখ প্রকাশ করেছেন।
জেলা শহরের প্রায় ৩৫কিলোমিটার দূরে কালীগঞ্জ উপজেলার কাকিনা বাজার গ্রামে কবির বাড়ী। ঢাকা-বুড়িমারী মহাসড়কের পাশেই রয়েছে কবির দিকনির্দেশক স্মৃতিফলক। সেখান থেকে একটু দূরেই কবি শেখ ফজলল করিমের বাড়ি। আর বাড়ির পাশেই কবির সমাধি।
সরেজমিনে দেখা যায়, কবি শেখ ফজলল করিমের মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে নেই কোন আয়োজন। তার বাড়িতে দর্শনার্থীদের ভিড় জমেছে। এ সময় তারা কবির স্মৃতিচিহ্ন দেখতে কবির কক্ষটির তালা খুলে দেওয়ার অনুরোধ করেন। পরে কবির নাতবউ এসে বাড়ির গেট খুললেও কবির স্মৃতিবিজড়িত রুমটি খুলে না দিয়ে সাফ জানিয়ে দেন, ‘অরেকদিন আসবেন আজ ওই রুম খোলা যাবে না’।
তবে কবির মৃত্যুবার্ষিকী পালনের জন্য সরকারিভাবে কোনো নির্দেশনা না থাকলেও স্থানীয় সাহিত্য-সংস্কৃতি সংসদ ও উপজেলা প্রশাসন যৌথভাবে কবির স্মৃতি পাঠাগারে ছোট পরিসরে আলোচনা ও দোয়া অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, অযত্ন অবহেলায় নষ্ট হচ্ছে কবির ব্যবহৃত জিনিসপত্র। শৌখিন কারুকাজ করা কাঠগুলো উইপোকায় খেয়ে ফেলছে। কাঠের দেয়ালজুড়ে কবির বড় দুটো ছবি দিন দিন অস্পষ্ট হচ্ছে। কবির ব্যবহৃত জীর্ণ চেয়ার, খাট ও একটি গ্রামোফোন রাখা আছে তার পাশে। এক কোণে কাচের একটি শোকেস। কাচগুলো ফেটে চৌচির হয়ে গেছে। আছে কবির ব্যবহৃত টুপি, দোয়াত-কলম, ছোট্ট কোরআন শরিফ, ম্যাগনিফাইং গ্লাস ও তার ব্যবহৃত জামার বোতাম।
২০০৫ সালে কবির স্মৃতি রক্ষার্থে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে নির্মিত হয় ‘শেখ ফজলল করিম গণপাঠাগার’। তখন এটি রক্ষার্থে সব ধরনের ব্যবস্থা থাকলেও এখন আর তা নেই। কবির ওই স্মৃতি পাঠাগারে নেই নিরাপত্তা প্রহরী ও পাঠক মহলের পদচারণা। বই পুস্তকগুলোও হারিয়ে যেতে বসেছে। ফলে বইপ্রেমীরা এখন সেখানে যান না। এদিকে পাঠাগারের পাশের দোকানপাট নির্মাণ করায় নষ্ট হয়েছে এটির সৌন্দর্য্য।
কবি শেখ ফজলল করিম স্মৃতি গণপাঠাগারের সভাপতি শহীদুল হক বলেন, ২০০৫ সালে স্থাপিত হয় কবি শেখ ফজলল করিম স্মৃতি পাঠাগার। কিন্তু রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে এটি নষ্টের পথে। যেসব বইপুস্তক আছে, ওই সব দিয়ে পাঠক আকৃষ্ট করা সম্ভব নয়। এ ব্যাপারে তিনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আব্দুল মান্নান বলেন, কবির মৃত্যুবার্ষিকী পালনের জন্য সরকারিভাবে কোনো নির্দেশনা নেই। তবে সাহিত্য-সংস্কৃতি সংসদের সঙ্গে উপজেলা প্রশাসন যৌথ আয়োজন করে পাঠাগারে। তবে কবির কক্ষটি তালাবদ্ধ বিষয়টি জানা ছিল না। তবে দ্রুত সেটি দর্শনার্থী ও কবিপ্রেমীদের জন্য উন্মুক্ত করা হবে বলেও তিনি জানান।
শেখ ফজলল করিম ১৮৮২ সালের ৯ এপ্রিল লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ উপজেলার কাকিনা বাজার গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম আমিরউল্লাহ সরদার এবং মায়ের নাম কোকিলা বিবি। পাঁচ ভাই ও তিন বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয়। ১৯৩৬ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর কবি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। কবির প্রকাশিত ও অপ্রকাশিত প্রায় ৫০টি গ্রন্থ রয়েছে।
উল্লেখযোগ্য, কাব্যগ্রন্থের মধ্যে তৃষ্ণা (১৯০০), পরিত্রাণ কাব্য (১৯০৪), ভগ্নবীণা বা ইসলাম চিত্র (১৯০৪), ভুক্তি পুষ্পাঞ্জলি (১৯১১) অন্যতম। উপন্যাস- লাইলী-মজনু, শিশুতোষ সাহিত্য হারুন-আর-রশিদের গল্প, নীতিকথা চিন্তার চাষ, ধর্মবিষয়ক পথ ও পাথেয়।