• ঢাকা
  • সোমবার, ০৬ মে, ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ শাওয়াল ১৪৪৫

বিরাট কোহলি: দ্য চ্যাম্পিয়ন


সৌরভ কুমার দাস
প্রকাশিত: নভেম্বর ৫, ২০২২, ০২:৩৩ পিএম
বিরাট কোহলি: দ্য চ্যাম্পিয়ন

‘কোহলি গোজ ডাউন দ্য গ্রাউন্ড, কোহলি গোজ আউট অফ দ্য গ্রাউন্ড’! এই লাইনটা নিশ্চয়ই এখনও সবার মনে গেথে আছে! থাকবেই না কেন! হার্শা ভোগলের কণ্ঠ থেকে বের হওয়ার লাইনটা তো এমনি এমনি আসেনি!

পাকিস্তানের বিপক্ষে বিশ্বকাপ ম্যাচ, খাঁদের কিনারায় ভারত! ১৯তম ওভারে পাকিস্তানি পেসার হারিস রউফের বুক সমান বলে লং অন দিয়ে কোহলির মারা এই ছক্কা যে অনেকেই এখনও বারবার দেখছেন ইউটিউব বা ফেসবুক ভিডিওতে!।

অবশ্য শুধু এই শটের কথা কেন  বলছি!  এক যুগের বেশি  সময়ের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে শুধু এরকম শট নয়, কত যে ইনিংস খেলেছেন এবং সেগুলো নিয়ে আলোচনা শুরু করলে হয়তো আরও গোটা কয়েক বিশ্বকাপ শেষ হয়ে যাবে তাও শেষ হবে না।

এখন আপনার মনে হতে পারে, হটাত কোহলিকে নিয়ে কেন পড়লাম! আসলে কোহলির মতো ক্রিকেটারকে নিয়ে আলোচনা করতে তো কোনো উপলক্ষ্যের প্রয়োজন হয়না। তারপরও বলি আজ বিরাট কোহলির ৩৪তম জন্মদিন।

১৯৮৮ সালের আজকের দিনে ভারতের রাজধানী দিল্লীতে প্রেমরাজ কোহলি ও সরোজ কোহলির কোলজুড়ে জন্ম নিয়েছিলেন আজকের বিরাট কোহলি।। যাকে ছোটবেলায় আদর করে বাবা-মা ডাকতেন চিকু নামে এবং যেটাই পরে তার ডাকনাম হয়ে ওঠে।

আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আসার আগেই ভারতীয় ক্রিকেটে বেশ আলোচনায় ছিলেন কোহলি। তবে প্রারম্ভিক জীবনটা খুব ভালো কাটেনি তার। যে বাবা চাইতেন ছেলে মস্ত বড় ক্রিকেটার হবেন, সেই বাবাকেই কোহলি হারান ক্রিকেট ম্যাচ চলাকালীন সময়েই!

২০০৬ সালে প্রথমবারের মতো রঞ্জি ট্রফি খেলতে নেমেছিলেন কোহলি। ম্যাচ চলাকালীন বাবার অসুস্থতার খবর পেয়ে ছুটে গিয়েছিলেন বাড়ি। রাত তিনটার সময় তার হাতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন বাবা।

রাতে বাবা হারানোর পর সকালেই আবার ব্যাটিং করতে নেমে গিয়েছিলেন তিনি। ব্যাট হাতে ৯০ রানের দুর্দান্ত ইনিংস খেলে দলকে হারের হাত থেকেই বাঁচিয়েছিলেন। পরবর্তীতে একাধিকবার বলেছেন বাবার আচমকা মৃত্যু তার ক্যারিয়ারটাকেই পাল্টে দিয়েছে।

এরপর অধিনায়ক হিসেবে ২০০৮ সালে যুব বিশ্বকাপে ভারতকে শিরোপা জেতালেন। ওই বছরই ওয়ানডে ফরম্যাট দিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক হলো। শুরুর দিকে বেশ সমস্যায় ভূগলেন, নিন্দুকেরা বললো একে দিয়ে চলবে না!

তবে অল্প বয়সে বাবাকে হারানো কোহলি ততদিনে মানসিকভাবে বেশ শক্তপোক্ত হয়ে গিয়েছিলেন। ২০০৯ সালে কলকাতার বিখ্যাত ইডেন গার্ডেনসকেই বেঁছে নিলেন নিজের প্রথম আন্তর্জাতিক সেঞ্চুরি করার জন্য। প্রতিপক্ষ শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সেদিন ব্যাট হাতে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ভবিষ্যতে কি পেতে চলেছে! এরপর একে একে করেছেন আরও ৪২টি সেঞ্চুরি, রান করেছেন ১২৩৪৪ (এখন পর্যন্ত)।

টেস্টেও একই অবস্থা! অবস্থা এতটাই খারাপ ছিল, ভারতের সাবেক ক্রিকেটার সঞ্জয় মাঞ্জেরাকার তো বলেই দিয়েছিলেন, ‘ওকে আর একটা সুযোগ দাও যাতে ও বুঝতে পারে টেস্ট ক্রিকেট ওর জন্য নয়।’ বিরাট কোহলি এবারেও হারলেন না, কারণ তিনি হারার জন্য ক্রিকেট খেলেন না।

দুর্দান্ত প্রতাপে ঘুরে দাড়ালেন লাল বলের ক্রিকেটেও! অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে অজি বোলারদের পিটিয়ে অ্যাডিলেডের সেই সেঞ্চুরি তো ইতিহাসেরই অংশ হয়ে গেছে! একই সাথে মাঠে আগ্রাসী মনোভাব দেখিয়ে প্রতিপক্ষের চোখে চোখ রেখে লড়াই করার কথা না হয় আজ নাই-বা বললাম! একে একে ২৭ সেঞ্চুরিতে এই ফরম্যাটে কোহলির ব্যাট থেকে এসেছে ৮০৭৪ রান। 

একে একে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ৭০টি সেঞ্চুরি করলেন!। ততদিনে গ্রেট তকমা পেতে শুরু করেছেন। শচীন টেন্ডুলকারের ১০০ সেঞ্চুরি ভাঙতে পারবেন কিনা সেটা নিয়েও তুমুল আলোচনায় মত্ত পুরো ক্রিকেট বিশ্ব!

এর চেয়ে স্বস্তির হাসি বোধহয় আগে হাসেননি কোহলি

মহেন্দ্র সিং ধোনীর বিদায়ের পর তিন ফরম্যাটের অধিনায়কত্বের ভারই পড়লো কোহলির কাঁধে। যে দলটা বিদেশের মাটিতে পেসারের অভাবে ভুগতো। সেই দলের পেস আক্রমণ বিশ্বের সেরা হলো কোহলির হাত ধরে। 

টেস্ট ক্রিকেটে ভারত র‍্যাঙ্কিংয়ে শীর্ষে উঠলো কোহলির অধিনায়কত্বেই। প্রতিপক্ষের উপর ভারত আগ্রাসী মনোভাব দেখানো শুরু করেছিল সৌরভ গাঙ্গুলির অধীনে। কোহলির অধিনায়কত্বে সেটাই যেন পুর্ণতা পেল।

এত এত সাফল্য, তবু নিন্দুকেরা বলে আইসিসির ট্রফি নেই ওকে সরাও! টি-টোয়েন্টি ও টেস্টের অধিনায়কত্ব নিজেই ছাড়লেন। অন্যদিকে ওয়ানডে থেকে তাকে রীতিমতো সরিয়ে দিল ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড। 

এরপরই কোহলি দেখলেন মূদ্রার অপর পিঠ!। ব্যাটে রান নেই, কাধ থেকে হুট করেই সরে গেল অধিনাকত্বের ভার! যে ব্যাটার কিনা সেঞ্চুরিকে ডালভাত বানিয়ে দিয়েছিল। যাকে নিয়ে অজি অধিনায়ক অ্যারণ ফিঞ্চ মজা করে বলেছিলেন, ‘কোহলি যেভাবে রান করে তাতে বিশ্বের বাকি ব্যাটারদের প্রতি অবিচার করা হয়’। ফিঞ্চের কথা মর্ম হচ্ছে, বাকিরা তো সমানভাবে রান করতে পারে না!

সেই কিনা ১ হাজার দিনের বেশি সময় ধরে সেঞ্চুরি পেলেন না! এমনকি একটা সময় রান করতেই হিমশিম খাচ্ছিলেন! নিন্দুকেরা আবার সরব হয়ে উঠলেন, বললেন অভিজ্ঞতা দিয়ে আর কত এবার ওকে ছেটে ফেলো! কোহলি নিজেও নাকি মানসিক অবসাদে ভুগেছিলেন! ভাবা যায়? যার চোখের দিকে তাকালে প্রতিপক্ষ ভয়ে কেপে উঠতো সেই-কিনা মানসিক অবসাদে?

এরপর বিশ্রাম নিলেন টানা এক মাস, পরে জানিয়েছিলেন ঐ সময়ে একবারের জন্যও ব্যাট ধরেননি এবং সেটাও নাকি ক্যারিয়ারে প্রথমবার। এরপর এশিয়া কাপে খেলতে নামলেন নিন্দুকের সমালোচোনার বন্দুকের নিশানায় থেকে!

প্রথম ম্যাচে পাকিস্তানের বিপক্ষে ইঙ্গিত দিলেন কিছুটা ছন্দে ফেরার। সুপার সিক্সের শেষ ম্যাচে আফগানদের বিপক্ষে করলেন টি-টোয়েন্টি ক্যারিয়ারের প্রথম সেঞ্চুরি! যেটা সেঞ্চুরির অপেক্ষা এক হাজার দিনের বেশি!

ভাগ্য কাকে কোথায় নিয়ে যায়! যে ফরম্যাটে তার সেঞ্চুরিই ছিল না সেটা দিয়েই ঘোছালেন সেঞ্চুরি খরা! এরপর টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে পাকিস্তানের বিপক্ষে নিশ্চিত করলেন ক্রিকেট বিশ্ব ফিরে পেয়েছে তাদের সেই চীরচেনা কোহলিকে!

৩১ রানে চার উইকেট হারিয়ে ধুঁকছে ভারত। উইকেটে তখনও কোহলি। পাকিস্তানের পেসারদের একের পর এক বুলেট গতির ডেলিভারি এগিয়ে এসেছে কোহলির দিকে। ভড়কে দিয়েছে বাউন্সারে, দ্বিধায় ফেলেছে সুইংয়ে! কিন্তু কোহলি ছিলেন অবিচল! তিনি জানতেন এই ম্যাচ তাকে শেষ করেই উঠতে হবে। এবং শেষ করেই উঠেছিলেন!

বিশ্ব তখন একটাই বুলি আওড়াচ্ছে, এই কোহলিকেই তো সবাই চায়। আপনি থাকবেন কোহলি, আপনি ক্রিকেট ইতিহাসে থাকবে আপনার বিখ্যাত কাভার ড্রাইভ, আপনি থাকবেন অজিদের বিপক্ষে মোহালির সেই ইনিংসে, আপনি থাকবেন অনবদ্য সব সেঞ্চুরিতে। আপনাকে কুর্নিশ হে বিরাট কোহলি।  

Link copied!