• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৮ জুলাই, ২০২৫, ৩ শ্রাবণ ১৪৩২, ২২ মুহররম ১৪৪৬

আজও থমথমে গোপালগঞ্জ , বাড়ল কারফিউ


সংবাদ প্রকাশ ডেস্ক
প্রকাশিত: জুলাই ১৮, ২০২৫, ০৮:৩১ এএম
আজও থমথমে গোপালগঞ্জ , বাড়ল কারফিউ
কারফিউ চলাকালে গতকাল গোপালগঞ্জ শহরে টহল দেন সেনা সদস্যরা। ছবি : এএফপি

জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) পদযাত্রা ও সমাবেশকে কেন্দ্র করে গত বুধবারের হামলা-সংঘর্ষের পর থেকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত গোপালগঞ্জ শহরে থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করে। সংঘর্ষ ও সহিংসতার পরিপ্রেক্ষিতে জেলায় জারি করা কারফিউয়ের সময়সীমা গতকাল আবারও বাড়ানো হয়েছে। ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে যৌথ বাহিনী গতকাল রাত পর্যন্ত অন্তত ২৫ জনকে আটক করেছে।

এদিকে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত গোপালগঞ্জে কারফিউ চলমান থাকবে বলে জানিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

গতকাল সন্ধ্যায় এক বিজ্ঞপ্তিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ তথ্য জানিয়েছে। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বুধবার রাত ৮টা থেকে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত গোপালগঞ্জে চলমান কারফিউ শুক্রবার সকাল ১১টা পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে। আজ শুক্রবার সকাল ১১টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত তিন ঘণ্টার জন্য কারফিউ শিথিল থাকবে। পরে দুপুর ২টা থেকে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত কারফিউ আবারও চলমান থাকবে বলে জানিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
তার আগে গত বুধবার দুপুরে গোপালগঞ্জে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সমাবেশকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষের পর আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে ওই দিন রাত ৮টা থেকে গতকাল সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত কারফিউ জারি করেছিল জেলা প্রশাসন। এই সময়সীমা শেষ হওয়ার আগেই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কারফিউয়ের সময়সীমা বাড়াল।

আহমদ চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, ‘বুধবার এনসিপির সভায় কিছু দুষ্কৃতকারী হামলা করেছে। এতে অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু ঘটনা ঘটে গেছে।
ওইসব দুষ্কৃতকারী এখন গোপালগঞ্জে অবস্থান করছে বলে আমাদের কাছে তথ্য আছে। তাদেরকে আমরা গ্রেপ্তারের জন্য চেষ্টা করছি। এ কারণে কারফিউয়ের সময়সীমা বাড়ানো হয়েছে।’ তিনি আরো বলেন, ‘এটা কোনো পরিকল্পিত হামলা ছিল না। আমাদের কাছে সব ধরনের তথ্য ছিল এবং আমাদের প্রস্তুতিও ছিল।
তবে এ ঘটনায় কারো গাফিলতি থাকলে খতিয়ে দেখা হবে এবং ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

ঢাকা রেঞ্জের উপমহাপুলিশ পরিদর্শক (ডিআইজি) রেজাউল করিম মল্লিক রেজা বলেন, এখন পর্যন্ত ২৫ জনের বেশি অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ ছাড়া এ ঘটনায় জড়িতদের গ্রেপ্তারে অভিযান অব্যাহত থাকবে। মামলা দায়েরের প্রস্তুতি চলছে বলে তিনি জানান। ডিআইজি বলেন, হামলার ঘটনায় চারজন নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে ৪০-৪৫ জন। এর মধ্যে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর ১০ জন সদস্য রয়েছেন।

পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, জেলার সার্বিক আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি রক্ষায় এক হাজার ৫০৭ জন পুলিশ সদস্যসহ সেনাবাহিনী ও বিজিবি মোতায়েন রয়েছে। গতকাল কারফিউ চলাকালে শহরের বিভিন্ন এলাকায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সদস্যদের টহল দিতে দেখা যায়। শহরের বিভিন্ন স্থানে মানুষ গ্রেপ্তার আতঙ্কে ছিল। কোনো জরুরি প্রয়োজন ছাড়া তারা ঘর থেকে বের হননি। শহরের সব ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল। তবে কাঁচাবাজার ও ওষুধের দোকান খোলা ছিল। যানবাহন চলাচল করেনি।

পুরো শহরে ছিল থমথমে অবস্থা। শহরের ঘোনাপাড়া, এলজিইডি মোড়, গোপালগঞ্জ জেনারেল হাসপাতাল, কোর্ট চত্বর, লঞ্চঘাট, কাঁচাবাজার, পুলিশ লাইনস মোড়সহ বিভিন্ন স্থানে যানবাহন বা লোকজনকে চলাচল করতে দেখা যায়নি। সকালে গোপালগঞ্জ পৌরসভার সামনে গ্রাম পুলিশের কয়েকজন সদস্য ও পৌরসভার পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের দেখা যায়। বিভিন্ন মোড়ে চায়ের দোকান ও রেস্টুরেন্ট খোলা থাকতে দেখা গেছে। কাঁচাবাজার ও ফলের দোকানে কিছু লোককে দেখা যায়। এদিকে গতকাল সকাল থেকে পৌরসভার পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা শহরের বিভিন্ন সড়কে পড়ে থাকা ধ্বংসস্তূপ ও ইটপাটকেল সরায়। সড়কে পড়ে থাকা তোরণের বাঁশ ও পোড়া ময়লা-আবর্জনা অপসারণ করে। শহরের গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোতে পুলিশ সদস্যদের উপস্থিতি দেখা গেছে। সেনা সদস্যরাও টহল কার্যক্রম পরিচালনা করেন। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর অতিরিক্ত সদস্যদের উপস্থিতিও ছিল।

গোপালগঞ্জ সদর থানার ওসি মির মোহাম্মদ সাজেদুর রহমান জানিয়েছেন, গত বুধবার সংঘর্ষের সময় ও পরে আটক ব্যক্তিদের সেনা সদস্যরা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করেছেন। বুধবারের হামলা-সংঘর্ষের ঘটনায় মামলা দায়েরের প্রস্তুতি চলছে। মামলার পর আটক ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতের মাধ্যমে জেলহাজতে পাঠানো হবে।

উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি : গোপালগঞ্জে সংঘটিত সহিংস ঘটনার তদন্তে তিন সদস্যের একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠন করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। গতকাল প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এই তথ্য জানানো হয়েছে। তাতে জানানো হয়, গঠিত তদন্ত কমিটির আহবায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব নাসিমুল গনি। কমিটিতে আরো থাকবেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এবং আইন ও বিচার মন্ত্রণালয়ের একজন করে অতিরিক্ত সচিব। কমিটিকে পূর্ণাঙ্গ ও নিরপেক্ষ তদন্ত শেষে আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে প্রধান উপদেষ্টার দপ্তরে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

পুলিশ প্রতিবেদন : গতকাল গোপালগঞ্জের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি তুলে ধরে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ পুলিশ। বিকেলে প্রধান উপদেষ্টার অফিশিয়াল ফেসবুক পেজে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়। তাতে বলা হয়, গত ১৬ জুলাই ‘মার্চ টু গোপালগঞ্জ’ কর্মসূচিতে সকাল ১১টায় গোপালগঞ্জ পৌর উন্মুক্ত মঞ্চে জাতীয় নাগরিক পার্টি জনসমাবেশ অনুষ্ঠানের ঘোষণা দেয়। সমাবেশে অংশ নেওয়ার জন্য সকাল সাড়ে ১০টার দিকে বরিশাল মহানগরীর সদর থানার সার্কিট হাউস এলাকা থেকে দলের কেন্দ্রীয় নেতারা রওনা দেন। সমাবেশের নিরাপত্তার জন্য সকাল থেকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী, স্থানীয় প্রশাসন তৎপর থাকে। সকাল সাড়ে ৯টায় নিষিদ্ধ একটি সন্ত্রাসী দল গোপালগঞ্জ সদর থানার উলপুরে পুলিশ সদস্যদের ওপর হামলা করে গাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। তাতে একজন পুলিশ পরিদর্শকসহ তিনজন পুলিশ সদস্য আহত হন। সকাল ১১টায় গোপালগঞ্জ সদর থানার কংশুর বাসস্ট্যান্ডে গোপালগঞ্জ-টেকেরহাট সড়কে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের গোপালগঞ্জ পৌর শাখার যুগ্ম আহবায়ক মো. ওমর ফারুক খান রিপনের নেতৃত্বে ৪০-৫০ জন আওয়ামী লীগ সমর্থক সড়কে গাছ ফেলে এবং কাঠ দিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। এ সময় গোপালগঞ্জ ইউএনওর গাড়ি ওই স্থানে গেলে গাড়ি ভাঙচুর করে সড়ক অবরোধ করে রাখে তারা। প্রতিবেদনে বলা হয়, সকাল সাড়ে ১১টায় কোটালীপাড়া থানার অবদারহাটে কোটালীপাড়া উপজেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শামীমের নেতৃত্বে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা মিছিল করে কোটালীপাড়া-পয়সারহাট সড়কে গাছ ফেলে ব্যারিকেড দিয়ে দুই হাজার ৮০০ থেকে তিন হাজার নেতাকর্মী রাস্তা অবরোধ করে রাখেন।

সকাল ১১টা ৪০ মিনিটে গোপালগঞ্জ সদর থানার কাঠিবাজার এলাকায় গোপালগঞ্জ-কোটালীপাড়া সড়কে ছাত্রলীগের গোপালগঞ্জ পৌরসভার মামুনের নেতৃত্বে দু-তিন শ আওয়ামী লীগ সমর্থক দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে সড়কে গাছ ফেলে ব্যারিকেড দিয়ে অবরোধ করেন। এনসিপি নেতারা সভাস্থলে পৌঁছার আগে দুপুর আনুমানিক ১টা ৪০ মিনিটে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে ছাত্রলীগের ৫০-৬০ জনের সন্ত্রাসী দল ককটেল বিস্ফোরণ করে ঢাল, দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে মঞ্চে আক্রমণ করে। তারা মঞ্চের ব্যানার ও চেয়ার ভাঙচুর করে। দুপুর ২টায় এনসিপির কেন্দ্রীয় নেতারা মঞ্চে ওঠেন। দুপুর সোয়া ২টায় গোপালগঞ্জ সদর থানার সাতপাড় বাজারে দুর্বৃত্তরা দুটি ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটায় এবং দুটি মোটরসাইকেলে অগ্নিসংযোগ করে। উচ্ছৃঙ্খল জনগণ রাস্তায় গাছের গুঁড়ি ফেলে ব্যারিকেড দেয় এবং বিভিন্ন জায়গায় অগ্নিসংযোগ করে। বিকেল পৌনে ৩টায় পদযাত্রা শেষ করে এনসিপির আহবায়ক নাহিদ ইসলামের নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় নেতারা সভাস্থল ত্যাগ করেন। সভা শেষে তাঁদের গাড়িবহর পরবর্তী পদযাত্রা সভাস্থল মাদারীপুরের উদ্দেশে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর পাহারায় রওনা দিলে গোপালগঞ্জ পৌরসভার লঞ্চঘাটে আওয়ামী লীগ এবং এর নিষিদ্ধ অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের লোকজন দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে গাড়িবহর আটকে দেয়। সেনাবাহিনী ও পুলিশ উচ্ছৃঙ্খল জনতাকে বোঝানোর চেষ্টা করে।

প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, নাশকতাকারীদের আক্রমণের ফলে সেনাবাহিনী ও পুলিশ এনসিপির নেতাকর্মীদের পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে নিরাপদে নিয়ে আসে। পরে বিকেল ৫টার দিকে পুলিশ সুপারের কার্যালয় থেকে যৌথ বাহিনীর সহায়তায় জাতীয় নাগরিক পার্টির নেতারা গাড়িতে করে বাগেরহাট হয়ে খুলনার উদ্দেশে চলে যান।

নিহতদের দাফন সম্পন্ন : গত বুধবার গোপালগঞ্জে হামলাকারীদের সঙ্গে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সংঘর্ষে চারজন নিহত এবং কমপক্ষে আটজন গুলিবিদ্ধ হয়। আহত হয় অর্ধশতাধিক ব্যক্তি। জানা গেছে, সংঘর্ষে নিহত চারজনের দাফন ও সৎকার সম্পন্ন হয়েছে। নিহতদের মধ্যে দীপ্ত সাহাকে বুধবার রাতে গোপালগঞ্জ পৌর শ্মশানে সৎকার করা হয়। রমজান কাজীকে একই রাতে দাফন করা হয়। সোহেল রানা ও ইমন তালুকদারকে গতকাল সকালে পৌর কবরস্থানে দাফন করা হয়। হাসপাতাল সূত্র জানায়, নিহত এই চার ব্যক্তির শরীরে গুলির চিহ্ন ছিল। গোপালগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক জীবিতেষ বিশ্বাস গণমাধ্যমকর্মীদের বলেন, এ ছাড়া গুরুতর আহত তিনজনকে ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। পুলিশের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত বুধবার রাত আনুমানিক সাড়ে ৭টায় উচ্ছৃঙ্খল জনতা নিহত চারজনের মরদেহ ময়নাতদন্ত করতে না দিয়ে সংশ্লিষ্ট হাসপাতাল থেকে জোর করে নিয়ে যায়।

Link copied!