• ঢাকা
  • সোমবার, ২৯ এপ্রিল, ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫

মরুর বুকে আকাশী-নীলদের দাপটে মেসির হাতে বিশ্বকাপ


পার্থ প্রতীম রায়
প্রকাশিত: ডিসেম্বর ১৯, ২০২২, ১২:২৬ এএম
মরুর বুকে আকাশী-নীলদের দাপটে মেসির হাতে বিশ্বকাপ
ছবি- গেটি ইমেজস

সৌদি আরবের কাছে হেরে শুরু বিশ্বকাপ মিশন। এরপরেই অনেকে ধরে নিয়েছিল আর্জেন্টিনার দৌড় হয়তো গ্রুপ পর্বেই থামবে। না সেই দৌড় থামেনি। তারা বিশ্বকাপ শিরোপা ছুঁয়ে দেখার সুযোগ পেয়েছে। তারাই এখন বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন। ভামোস আর্জেন্টিনা বলে চিল্লিয়ে উঠতেই পারেন। কারণ, আলবিসেলেস্তারাই যে আগামী চার বছর পরিচিতি পাবে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হিসেবে।

আকাশের দিকে তাকালেই দেখবেন আকাশী-নীলের আধিপত্য। সেই আকাশটাই যেন লুসাইল আইকনিক স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে ভর করেছিল। ইউরোপের শিল্প বিপ্লবীদের আকাশী-নীলের আধিপত্যে খুঁজে পাওয়াটাই ছিল দায়। লুসাইল যেন হয়ে উঠেছিল এক খণ্ড আর্জেন্টিনা। চারদিকে শুধুই ছিল আর্জেন্টিনা রব।

শুরুর দিকে মাঠের চিত্রও ওই একই। ভিনদেশে নিজেদের  ঘরের মাঠের মতো সমর্থন পেয়ে ফ্রান্সের ওপর ম্যাচের প্রথমার্ধে দেখাচ্ছিল আধিপত্য। দ্বিতীয়ার্ধে ঘুরে দাঁড়িয়ে নির্ধারিত সময় পেরিয়ে অতিরিক্ত সময়ের প্রতি মুহূর্তেই ছিল উত্তেজনার পারদ। সেই পর্যন্ত স্নায়ুচাপ ধরে রেখে টাইব্রেকারে ম্যাচ জিতে নিল আর্জেন্টিনা। এই জয়ে দীর্ঘ ৩৬ বছরের অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে শিরোপা ঘরে তুললো আর্জেন্টিনা। ডিয়েগো ম্যারাডোনার পর লিওনেল মেসির হাত ধরে আর্জেন্টিনা স্বাদ পেল বিশ্বকাপের।

রোববার (১৮ ডিসেম্বর) দোহার লুসাইল আইকনিক স্টেডিয়ামে মুখোমুখি হয় আর্জেন্টিনা ও ফ্রান্স। পুরো টুর্নামেন্টে ধীরে ধীরে উন্নতি করা আর্জেন্টিনা ফাইনালে হয়ে উঠেছিল আরও বেশি অপ্রতিরোধ্য। মেসি-ডি মারিয়াদের ভিড়ে তাদের ফরাসিদের খুঁজে পাওয়ায় দায় হয়েছিল। আক্রমণ তো তাদের জন্য হয়ে উঠেছিল স্বপ্নের মতো।

ম্যাচের ২২ মিনিটে পেনাল্টি থেকে গোল করেন লিওনেল মেসি। ম্যাচের শুরু থেকেই বামপ্রান্তে ছিলেন অ্যাঞ্জেল ডি মারিয়া। ফরাসি ডিফেন্ডার জুলস কুন্দেকে বারবার পরাস্ত করে বল নিয়ে ভেতরে ঢুকে যাচ্ছিলেন ডি মারিয়া। তাকে আটকাতে ব্যর্থ হওয়া দিয়েই শুরু বিশ্ব চ্যাম্পিয়নদের পিছিয়ে পরা।

ডি মারিয়াকে জুলস কুন্দে আটকাতে না পারলেও চেষ্টা করেছিলেন ওসমান ডেম্বেলে। তবে চেষ্টাটা ছিল ভয়ংকর। আটকাতে গিয়ে ডিবক্সে ডি মারিয়াকে ফাউল করে বসেন। ফলে পেনাল্টির বাঁশি বাজাতে বাধ্য হন রেফারি মার্চিয়ানিক। সেই পেনাল্টি থেকে ম্যাচের ২৩ মিনিটে দলকে এগিয়ে নেন লিওনেল মেসি।

এই গোলে ব্রাজিলের কিংবদন্তি রোনালদো, জার্মানির মিরোস্লাভ ক্লোসা ও জার্ড মুলারকে পেছনে ফেলেছেন মেসি। এতোদিন বিশ্বকাপে ১৯ গোলে অবদান রেখে তাদের সঙ্গে যৌথভাবে শীর্ষে ছিলেন মেসি। ফাইনালে পেনাল্টি থেকে গোল করেই তাদেরকে ছাড়িয়ে এককভাবে শীর্ষে উঠে যান মেসি। এখন ১৩ গোল ও ৮ অ্যাসিস্টে সবার উপরে লিওনেল মেসি।

ম্যাচের ৩৬ মিনিটে আর্জেন্টিনার হয়ে ম্যাচের দ্বিতীয় গোলটি করেন অ্যাঞ্জেল ডি মারিয়া। ফরাসি রক্ষণ ফাঁকা দেখে ডান দিকে জুলিয়ান আলভারেজকে বল বাড়ান লিওনেল মেসি। আলভারেজ অবশ্য নিজে গোল করার চেষ্টা করেননি। বামপ্রান্তে সুবিধাজনক স্থানে থাকা ডি মারিয়ার দিকে বল বাড়ান। সেখানে ডি মারিয়াকে আটকানোর চেষ্টা করেন ফরাসি অধিনায়ক হুগো লরিস। তবে ডি মারিয়ার দূর্দান্ত ফিনিশিং ব্যর্থ করে দেয় লরিসের সকল চেষ্টা। ব্যবধান দ্বিগুণ করেন ডি মারিয়া।

গোলের পর ডি মারিয়াকে কাঁদতে দেখা যায়। খেলছিলেন আর চোখ মুখছিলেন। হয়তো ২০১৪ বিশ্বকাপ ফাইনালের স্মৃতি মনে পড়ছিল তার। ঊরুর চোটে পড়ে সেবার আর্জেন্টিনার জার্সিতে ফাইনালে খেলা হয়নি। সেবার বিশ্বকাপ জিততে না পারলেও এবার ঠিকই শিরোপা জিতে নিয়েছে আর্জেন্টিনা।

ম্যাচের প্রথমার্ধে ২-০ গোলে এগিয়ে থাকা আর্জেন্টিনা অবশ্য এক মুহূর্তের জন্যও দেয়নি ছাড়। বিরতি থেকে ফিরে প্রথম দিকে একের পর এক আক্রমণের পসরা সাজিয়ে বসে আর্জেন্টিনা। আক্রমণের ধার কমিয়ে আর্জেন্টিনা মনোযোগী হয়ে রক্ষণে। তাই তো ম্যাচের ৬৪ মিনিটে অ্যাঞ্জেল ডি মারিয়াকে তুলে মার্কোস অ্যাকুইনাকে মাঠে নামান কোচ লিওনেল স্ক্যালোনি। তবে সেই সিদ্ধান্ত যে ভুল ছিল তা প্রমাণ হয় কিছুক্ষণ পরই।

ডি মারিয়া ওঠার পরই শুরু আর্জেন্টিনার খেই হারানোর। আর্জেন্টিনার দূর্বলতার সুযোগে ফরাসিদের বিপ্লবের সূচনা। বদলি নেমে শুরু থেকেই কোলো মুয়ানির শুরুটা ছিল বেশ আত্মবিশ্বাসী। ম্যাচের ৭৯ মিনিটে আসে তার ফলও। ডিবক্সে তাকে ফাউল করে ফ্রান্সকে এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দেন নিকোলাস ওটামেন্ডি। তাতেই বেজে ওঠে পেনাল্টির বাঁশি।

সেখান থেকেই ব্যবধান কমিয়ে আনেন কিলিয়ান এমবাপে। বল এমিলিয়ানো মার্তিনেজের হাত ছুঁয়ে গেলেও আটকাতে পারেনি। ফলে ব্যবধান কমে আসে ফ্রান্সের।

গোলের এই ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই আরও একবার ফরাসিদের আক্রমণ। প্রথম গোল হজমের পরের মিনিটেই গোল করে দলকে সমতায় ফেরান এমবাপে। বিশ্বকাপে এটি এমবাপের ৭ম গোল। এই গোল করেই ক্লাব সতীর্থ লিওনেল মেসিকে পেছনে ফেলে গোল্ডেন বুটের লড়াইয়ে সবার উপরে উঠে যান কিলিয়ান এমবাপে।

নির্ধারিত সময়ে আর কোনো গোল না হওয়ায় তাই খেলা গড়ায় অতিরিক্ত সময়ে। ম্যাচের ১০৮তম মিনিটে ডিবক্সে জটলার মধ্য থেকে দলকে আবারও এগিয়ে নেন লিওনেল মেসি। এই গোলে এমবাপের সমান সাতটি গোল করে বসেন আর্জেন্টাইন ক্ষুদে জাদুকর।

মিনিট দশেক পর আবারও স্কোরশিটে নাম তোলেন কিলিয়ান এমবাপে। এবার মেসিকে ছাড়িয়ে আবারও কাতার বিশ্বকাপের সর্বোচ্চ গোলদাতা হন এমবাপে। কাতারে এটি ছিল তার ৮ম গোল। শুধু তাই নয়, জিওফ হার্স্টের পর দ্বিতীয় ফুটবলার হিসেবে বিশ্বকাপের মঞ্চে হ্যাটট্রিকের দেখা পান এমবাপে।

বিশ্বকাপের ফাইনালে গোল পাওয়া ফুটবলারদের জন্য স্বপ্নই বটে। সেই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিয়ে বিশ্বকাপ ফাইনালে সবচেয়ে বেশি গোলের মালিক হয়েছেন কিলিয়ান এমবাপে। দুই ফাইনাল মিলিয়ে তার গোলসংখ্যা এখন চার।

এই গোলেই ম্যাচ সমতায় ফেরে, খেলা গড়ায় টাইব্রেকারে। সেখানে স্নায়ুচাপের লড়াইয়ে আর টিকে থাকতে পারেনি ফ্রান্স। প্রথম শটে কিলিয়ান এমবাপে লক্ষ্যভেদ করলেও পরের কিংসলে কোম্যান ও আরিলিয়েন চুয়ামেনি বল জালে জড়াতে পারেননি। বিপরীতে মেসির সঙ্গে পাওলো দিবালা ও লিয়ান্দ্রো পারদেসরা ঠিকই জালে বল জড়ান। ফলে তখনই হারে শঙ্কা যুক্ত হয় ফ্রান্স শিবিরে। ৩-১ গোলে পিছিয়ে থাকা ফরাসিদের আশার আলো দেখিয়েছিলেন কোলো মুয়ানি। তবে মন্তিয়েলের শট আটকাতে না পারায় সেখানেই শেষ ফরাসিদের শিরোপা ধরে রাখার স্বপ্ন। নতুন বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হিসেবে শুরু হয় আর্জেন্টিনার জয়োল্লাস।

সৌদি আরবের কাছে হেরে শুরু বিশ্বকাপ মিশন। তখনই অনেকেই আর্জেন্টিনাকে বাদ দিয়েছিলেন হিসেবের খাতা থেকে। তবে মেক্সিকোর বিপক্ষে ঘুরে দাঁড়িয়ে যেভাবে বিশ্বকাপ শিরোপা ছিনিয়ে নিলো, তাতে একটা স্যালুট পেতেই পারেন লিওনেল স্ক্যালোনি, লিওনেল মেসিরা।

Link copied!