• ঢাকা
  • সোমবার, ০৬ মে, ২০২৪, ২৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ শাওয়াল ১৪৪৫

যে পথে আলো ফুটিয়েছে মরক্কো ফুটবল


পার্থ প্রতীম রায়
প্রকাশিত: ডিসেম্বর ১১, ২০২২, ০৯:৫০ পিএম
যে পথে আলো ফুটিয়েছে মরক্কো ফুটবল

আফ্রিকার প্রথম দল হিসেবে বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল নিশ্চিত করেছে মরক্কো। টুর্নামেন্টে আফ্রিকার সেরা সাফল্যের পথে বিদায় করেছে স্পেন-পর্তুগালের মতো ইউরোপের শক্তিশালী দলগুলোকে। অথচ, চার বছর আগে রাশিয়া বিশ্বকাপের দল গোছাতে হিমশিম খাওয়া দলটি কিভাবে আমূল বদলে গেল? সেটাই এখন তাবৎ ফুটবল দুনিয়া চেষ্টা করছে জানার। শিকড়ে ফিরেই দলকে বদলে দেওয়া যায় সেটাই প্রমাণ করেছে মরক্কো।

বিশ্বকাপে মরক্কো স্কোয়াডে থাকা ২৬ ফুটবলারের ১৬জনই অভিবাসী। না অন্য দেশ থেকে মরক্কো পাড়ি জমায়নি। বরং, ভিনদেশে থাকা মরক্কোর শিকড়কে দেশে ফিরিয়ে পেয়েছে সাফল্য। নিজ দেশে জন্ম নেওয়া ফুটবলারদেরকেও গড়ে তুলেছে দারুণ এক শৃঙ্খলাবদ্ধ পরিবেশে।

স্পেনকে বিদায় করে দেওয়ার ম্যাচে মরক্কোর নায়ক ছিলেন আশরাফ হাকিমি। স্পেনের রাজধানী মাদ্রিদে জন্ম নেওয়া হাকিমি বয়সভিত্তিক দল থেকেই খেলেছেন মরক্কোর হয়ে। যদিও তার সামনে সুযোগ ছিল স্পেনের জার্সিতে লা রোজাদের প্রতিনিধিত্ব করার। কিন্তু বেছে নিয়েছিলেন বাবা-মায়ের দেশকেই।

পর্তুগালকে বিদায় করেছেন ইউসেফ এন নেসিইরি। তার একমাত্র গোলে পর্তুগিজদের একরাশ বেদনায় ডুবিয়ে আফ্রিকার প্রথম দল হিসেবে সেমি-ফাইনালে নাম লেখায় মরক্কো। তিনি অবশ্য ইউরোপের কোনো দেশ থেকে নিজ শিকড়ে ফেরেননি। ২৫ বছর বয়সী এই ফুটবলার উঠে এসেছেন মরক্কোর জাতীয় ফুটবল একাডেমি থেকে।

২০১৮ সালে ফিফার কাছে ভিনদেশে থাকা ভিন্ন জাতীয়তার মরক্কোর শিকড় থাকা ফুটবলারদের দলে ভেড়ানোর প্রক্রিয়া সহজ করতে ফিফার কাছে আবেদন করে আফ্রিকার দেশটি। দুই বছর পর ২০২০ সালে সেই আইন পাস হলে ইউরোপে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মরক্কোর অভিবাসী ফুটবলারদের দলে ভেড়ায় তারা। এর আগে থেকেই অবশ্য এই প্রক্রিয়া শুরু করেছিল তারা। তাই হাকিম জিয়েশ-আশরাফ হাকিমিদের মতো তারকাদের বহু আগেই দলে ভেড়াতে পেরেছিল তারা।

ইউরোপজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ফুটবলারদের দলে ভেড়াতেও বড় অঙ্কের অর্থও খরচ করেছে মরক্কো। ইউরোপের বিভিন্ন ক্লাবের যুব একাডেমিতে থাকা মরক্কোর ফুটবলারদের খুঁজে বের করতে নিয়োগ করেছে স্কাউট। পুরো ইউরোপ চষে বেড়িয়ে তারা খুঁজে এনেছে ফুটবলারদের। এখনও চালু আছে তাদের সেই প্রক্রিয়া। ইউরোপের ক্লাবগুলো রাস্তা থেকে তুলে আনা মরক্কোর প্রতিভাগুলো কড়ি থেকে ফুল হয়ে ফোটার আগেই স্কাউটদের নজরে এসে পাচ্ছেন মরক্কোকে প্রতিনিধিত্ব করার আশ্বাস। ফলে বাড়ছে তাদের ফুটবলের প্রতি মনোযোগ।

এর পাশাপাশি দ্য রয়্যাল মরক্কো ফুটবল ফেডারেশন (এফএমএফএফ) ২০০৯ সালে শুরু করেছিল যুব প্রকল্প। এর অধীনে একই বছর কিং মোহাম্মেদ সিক্স ফুটবল একাডেমি চালু করে। এছাড়াও দেশটির ক্লাব ফুটবলেও আমূল পরিবর্তন আনার সিদ্ধান্ত নেয়।

কিং মোহাম্মেদ সিক্স ফুটবল একাডেমি কতটা উন্নত তা অনেকটাই অকল্পনীয় আফ্রিকার দেশগুলোর জন্য। দেশটির রাজধানী রাবাদের ঠিক বাইরে তৈরি করা এই ফুটবল একাডেমির ঠিক পাশেই রয়েছে চারটি ফাইভ স্টার হোটেল, ফিফার মানদন্ড অনুযায়ী তৈরি করা মাঠ। তরুণ ফুটবলারদের জন্য প্রয়োজনীয় সকল সুযোগ-সুবিধাই রাখা হয়েছে এখানে। ফলে, ফুটবলারদের আর্থিক দিক নিয়ে চিন্তার কোনো কারণই নেই। বরং, তার পূর্ণ মনোনিবেশ করতে পারে ফুটবলেই। এই একাডেমি থেকেই উঠে এসেছেন নায়েফ আগুয়ের্ড ও ইউসেফ এন নাসেইরির মতো ফুটবলাররা।

এছাড়াও ঘরোয়া ফুটবলে আনা আমূল পরিবর্তনেও এসেছে সাফল্য। ক্লাব ফুটবলে আনা বড় পরিবর্তনের কারণে আফ্রিকান ক্লাব ফুটবলে এখন শুধুই মরক্কোর আধিপত্য। তিউনিসিয়া, মিশর কিংবা আলজেরিয়ার পাশাপাশি আফ্রিকান ক্লাব ফুটবল মরক্কোও হয়ে উঠেছে পরাশক্তি। মরক্কোর ক্লাবই আফ্রিকান চ্যাম্পিয়নস লিগ ও কনফেডারেশন লিগের (ইউরোপা লিগ সমতুল্য) বর্তমান শিরোপাজয়ী দল। মরক্কোর ঘরোয়া লিগ থেকে ফুটবলাররা নিয়মিতই যাচ্ছেন ইউরোপের লিগগুলোতে। ফলে মান বাড়ছে মরক্কো জাতীয় দল ও ঘরোয়া ফুটবলের।

এতো গেল, ছেলেদের দলের কথা। মেয়েদের ফুটবলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে যাচ্ছে মরক্কো। বিশ্বের একমাত্র দেশ হিসেবে নারীদের ঘরোয়া ফুটবলে দুই স্তরে পেশাদার লিগ চালু করেছে। এর ফলও অবশ্য হাতেনাতে পাচ্ছে। নারী আফ্রিকান নেশনস কাপে দ্বিতীয়বারের মতো খেলার সুযোগ পেয়েছে মরক্কো। এছাড়াও নারী বিশ্বকাপের পরবর্তী আসরে প্রথমবারের মতো খেলবে। হয়তো সেখানেও চমক দেখানো কিছু একটা উপহার দিতে পারেন মরক্কোর নারী ফুটবলাররা।

মরক্কোর এই ফুটবল বিপ্লবের পুরোটাই এসেছে পরিকল্পিত পথে। একের পর এক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেই বিশ্বকাপে দিচ্ছে একের পর এক চমক। মরক্কোর এই দল বিশ্বকাপের ফাইনাল খেলে ফেললেও তাই অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। কারণ একটাই, সঠিক পরিকল্পনামাফিক এগিয়েই তারা পা রেখেছে বিশ্বমঞ্চে।

এতো গেল, মরক্কোর মাঠের সেনানী তৈরির পরিকল্পনা আর বাছাইয়ের গল্প। সেনানীদের প্রস্তুত করতে কোচেও ভরসা রেখেছে নিজ দেশের লোকের ওপরই। মরক্কোর স্বপ্নের বিশ্বকাপ যাত্রার পেছনে বড় ভূমিকাটা রেখেছেন ওয়ালিদ রেগ্রাগুই। তার অধীনেই বিশ্বকাপের দলটি পেল নিজেদের সর্বোচ্চ সাফল্য।

অথচ এই রেগ্রাগুই দায়িত্ব পেয়েছেন খুব বেশিদিন আগে নয়। চলতি বছরের আগস্টে বসনিয়া-হার্জেগোভিনার ভাহিদ হালিহোভিচকে সরিয়ে রেগ্রাগুইয়ের হাতে দায়িত্ব তুলে দেয় মরক্কো। এই রেগ্রাগুইয়ের শরীরে মরক্কোর রক্ত বইলেও তার বেড়ে ওঠা ও ফুটবলে হাতেখড়ি কিন্তু ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে। মাতৃভূমির শিকড়ের টানে ফিরেছিলেন দেশটিতে। ফুটবল ক্যারিয়ার শেষে কোচিং করানোর শুরুটা উত্তর আফ্রিকার দেশটিতে।

কোচ হিসেবে পুরোটা সময় শুধুই সাফল্য দেখেছেন রেগ্রাগুই। মরক্কোর মধ্যমমানের দল এফইউএস রাবাদকে কোচিং করিয়ে জিতিয়েছিলেন প্রথম লিগ শিরোপা। এছাড়াও কাতারের আল দুহাইল এসসিকেও করিয়েছেন কোচিং। মূলত ওই অভিজ্ঞতার বিচারেই মরক্কোর জাতীয় দলের কোচ হওয়ার পথে অনেকটাই এগিয়ে ছিলেন। শেষ পর্যন্ত তার ওপর ভরসা করেই সাহসী পদক্ষেপ নিয়েছে মরক্কো। অথচ, বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের পুরো পথটাই মরক্কো পাড়ি দিয়েছে ভাহিদ হালিহোভিচের কাঁধে চেপে।

মরক্কোর দায়িত্ব নেওয়ার আগে দেশটির ঘরোয়া লিগের সবচেয়ে সফল দল ওয়াদাদ কাসাব্লাঙ্কার দায়িত্বে ছিলেন রেগ্রাগুই। দলটিকে জিতিয়েছিলেন লিগ শিরোপা ও আফ্রিকান চ্যাম্পিয়নস লিগ শিরোপা। সেই দায়িত্ব সামলেই যখন জাতীয় দলের বড় দায়িত্ব কাঁধে চেপেছে তখনও অবশ্য পথচ্যুত হননি। দলকে ঠিকই দেখিয়েছেন আলোর পথ।

আফ্রিকান ফুটবলে রেগ্রাগুইকে বিবেচনা করা হয় হোসে মরিনহোর সঙ্গে। ট্যাকটিক্যাল চিন্তাভাবনার সঙ্গে শৃঙ্খলা মেনে চলা। সব মিলিয়ে কড়া হেড মাস্টার রেগ্রাগুইয়েই সাফল্যমন্ডিত হয়েছে মরক্কোর ফুটবল।

দারুণ পরিকল্পনা আর দেশীয় মেধায় রাখা ভরসা, দুই মিলিয়েই এগিয়ে যাওয়ার পথে অনন্য মরক্কো এখন হতে পারে অন্যদের জন্য অনুকরণীয়।

Link copied!