• ঢাকা
  • সোমবার, ০৬ মে, ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ শাওয়াল ১৪৪৫

গারিঞ্চার তিন মিনিটের ‘ঝলক’, ব্রাজিলের নতুন গতিপথ


পার্থ প্রতীম রায়
প্রকাশিত: নভেম্বর ১৮, ২০২২, ০৪:৫৯ পিএম
গারিঞ্চার তিন মিনিটের ‘ঝলক’, ব্রাজিলের নতুন গতিপথ

১৯৫৮ সালে প্রথমবারের মতো ফুটবল বিশ্বকাপ জয়ের স্বাদ পায় ব্রাজিল। সেবার বিশ্বকাপ জয়ের পথে মোটেও ফেবারিট ছিল না ব্রাজিল। বিশ্বকাপে জেতার পথে তাদের গতিপথ বদলে দিয়েছে শক্তিশালী সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপক্ষে ম্যাচ। আরও সুনির্দিষ্ট করে বললে ওই ম্যাচে বল পায়ে গারিঞ্চার তিন মিনিটের ঝলকেই বিশ্বকাপ ইতিহাসে প্রথমবারের মতো লেখা হয়েছে ব্রাজিলের নাম।

গারিঞ্চা মানেই ফুটবলের ঝলক, সব দর্শকদের চোখ থাকতো গারিঞ্চার পায়ের দিকে। তার পায়ের জাদুতেই মুগ্ধ হয়ে থাকতো স্টেডিয়াম কিংবা টিভি সেটের সামনে থাকা দর্শকরা। বিশ্বকাপে নিজের অভিষেক ম্যাচে শক্তিশালী সোভিয়েতের বিপক্ষে নিজেকে প্রমাণ করেছিলেন। জানান দিয়েছিলেন বিশ্ব ফুটবলে আধিপত্য করবেন।

১৯৫৮ সুইডেন বিশ্বকাপে ব্রাজিলের গ্রুপ সঙ্গী ছিল অলিম্পিক চ্যাম্পিয়ন সোভিয়েত ইউনিয়ন, বিশ্বকাপের আগের আসরে তৃতীয় হওয়া অস্ট্রিয়া ও ফুটবলের প্রবর্তক ইংল্যান্ড। নামের ভারে সোভিয়েত কিংবা অস্ট্রিয়ার মতো শক্তিশালী হলেও মিউনিখ ট্রাজেডিতে ফুটবলারদের হারানোয় শক্তিমত্তা বিবেচনায় পিছিয়ে পড়েছিল ইংলিশরা।

অস্ট্রিয়াকে ৩-০ গোলে উড়িয়ে বিশ্বকাপ মিশন শুরু করেছিল ল্যাতিন দেশটি। দ্বিতীয় ম্যাচে ইংলিশদের বিপক্ষে গোলশূন্য ড্র করে ইতিহাসের পাতায় উঠে যায় ব্রাজিল। কারণ, এটাই ছিল বিশ্বকাপের ইতিহাসে গোলশূন্য ড্র হওয়া প্রথম ম্যাচ। এদিকে ইংলিশদের বিপক্ষে ২-২ গোলে ড্র করে হোঁচট খেয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়নও।

ম্যাচ জিতলেই কোয়ার্টার ফাইনাল এমন সমীকরণে গ্রুপ পর্বে নিজেদের শেষ ম্যাচে মুখোমুখি হয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ব্রাজিল। বিজ্ঞান নির্ভর ফুটবলের কারণে নিশ্চিতভাবেই ব্রাজিলের বিপক্ষে এগিয়ে ছিল সোভিয়েত। কারণ, অন্য দেশগুলোর বিপক্ষে জয় হয়েছিল সোভিয়েতের এই বিজ্ঞান নির্ভর ফুটবলের। এমন দলের বিপক্ষে জিতে পরের রাউন্ড নিশ্চিত করা ব্রাজিলের জন্য ছিল কঠিন। শুধু তাই নয় সোভিয়েতে ফুটবলাররা এতোটাই শক্তিশালি যে তারা মাঠে ১৮০ মিনিট লড়াইয়ের সামর্থ্য রাখে। প্রতিপক্ষ বিচারে তাই ব্রাজিল ছিল এক রকম দুধ-ভাত।

সোভিয়েতকে ঘায়েল করতে ব্রাজিলিয়ান কোচ ভিনসেন্ট ফিওলা নিয়ে ফেলেন একটু ঝুঁকি। দুই তরুণ তুর্কি পেলে ও গারিঞ্চাকে মাঠে নামিয়ে দেন। ফিওলা আগে থেকে জানতেন শারীরিক শক্তি কিংবা বিজ্ঞান নির্ভর ফুটবল খেলে সোভিয়েতকে ঘায়েল করা সম্ভব না।

তাই ড্রিবলিং ও ফুটবলীয় দক্ষতায় অসাধারণ কাউকে খুঁজছিলেন ফিওলা। সমস্যা সমাধানে গারিঞ্চার উপর ভরসা রেখেছিলেন। সোভিয়েতের খেলার ধারায় ছেদ ফেলতে গারিঞ্চা একাই যথেষ্ট ছিলেন। তার সাথে যুক্ত হয়েছিলেন পেলে। পরীক্ষিত খেলোয়াড়দের বদলি হিসেবে দুই তরুণ তুর্কির উপর ভরসা করাটা ছিল কোচ ফিওলার জন্য সাহসী সিদ্ধান্ত। শেষ পর্যন্ত তারা সফল না হলে হয়তো কঠোর সমালোচনার মুখোমুখি হতে হতো।

মাঠে খেলা শুরুর আগে কোচ ফিওলার নির্দেশনা ছিল বল পাওয়া মাত্রই গারিঞ্চাকে পাস দিতে হবে। ম্যাচ শুরুর আগে মূল তারকা ডিডিকে স্পষ্ট ভাবে কোচ ফিওলা বলেছিলেন, “ভুলে যেও না, প্রথম বলই গারিঞ্চাকে দিতে হবে।”

কিক অফে সোভিয়েত খেলা শুরু করলেও বলের দখল পেতে খুব বেশি সময় অপেক্ষা করতে হয়নি ব্রাজিলিয়ানদের। বল পেয়েই গারিঞ্চার দিকে বাড়িয়ে দিয়েছিলেন  ডিডি।

বল পাওয়ার ৩ সেকেন্ডের মাথায় দারুণ ড্রিবলিংয়ে একের পর রাশিয়ান ডিফেন্ডারকে বোকা বানাতে শুরু করেন। ম্যাচের ৪০ সেকেন্ডের মাথায় প্রতিপক্ষের গোলবার লক্ষ্য করে শট নেন। লক্ষ্যভেদ না হওয়ায় বল চলে যায় মাঠের বাইরে। তাতে প্রতিপক্ষ গোল কিক পেলে বলের নিয়ন্ত্রণ হারান গারিঞ্চা।

মধ্যমাঠে ফিরে আসা গারিঞ্চা আবারও ফিরে পান বলের নিয়ন্ত্রণ। এর আগে লেভ ইয়াশিনের নেওয়া গোল কিক থেকে বল পান ডিডি। সেখান থেকে ইগোর নেত্তোর মাথার উপর দিয়ে বল চলে যায় পেলের পায়ে। পেলে থেকে ভাভা, ভাভা থেকে ডিডি হয়ে বল আসে গারিঞ্চার পায়ে। সেখান থেকে আবারও পেলে বল পেয়ে রাশিয়ার জাল লক্ষ্য করে আরেকটি শট নেন। এবারও ব্রাজিলের ডেরা থেকে নেওয়া শটে ব্যর্থ হয়। বল লক্ষ্যভেদ না হয়ে বারের উপর দিয়ে চলে যায়।  

গারিঞ্চা ও পেলে জুটির গতিময় ফুটবলের সাথে কোনোভাবেই কুলিয়ে উঠতে পারছিল না সোভিয়েত ফুটবলাররা। ম্যাচের প্রথম তিন মিনিটেই সোভিয়েতের ভিত নাড়িয়ে দিয়েছিল এই দুই তরুণ তুর্কি। পরে ম্যাচে আরও কয়েকবার সোভিয়েতের জালে শট নিয়ে লেভ ইয়াশিনকে ভীত সন্ত্রস্ত করে তুলেছিলেন দুই তরুণ তুর্কি।

প্রথম তিন মিনিটের ওই ঝড় সামলে ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ মেলেনি সোভিয়েতের সামনে। ফলে নির্ধারিত সময় শেষে স্কোরলাইন দাঁড়ায়, ব্রাজিল ২-০ সোভিয়েত ইউনিয়ন। বিজ্ঞান নির্ভর ফুটবলকে বিদায় জানিয়ে সাম্বার তালে তালে দর্শকদের বিনোদন দিয়ে কোয়ার্টার ফাইনাল নিশ্চিত করে ব্রাজিল। শুধু তাই নয়, ওই বিশ্বকাপে প্রথমবারের মতো শিরোপাও ঘরে তোলে ল্যাতিন আমেরিকার দেশটি।

ব্রাজিল-সোভিয়েত ইউনিয়ন ম্যাচ কাভার করতে সুইডেনের গোথেবার্গের ওই প্রেসবক্সে ছিলেন সাংবাদিক নেইয় বিনাচি। ম্যাচ রিপোর্টে শুরুতেই তিনি লিখেন, “মনসিয়ের গুইগেই ম্যাচের বাঁশি বাজানোর সাথে সাথে ম্যাচের ১৫তম সেকেন্ডে ডিডি বল গারিঞ্চাকে পাস দেন। আর এতেই নির্ধারিত হয়ে যায় পুরো ম্যাচের ভাগ্য।”

আরেক সাংবাদিক কাস্ত্রোর মতে, “ম্যাচে আরও ৮৭ মিনিট বাকি ছিল। কিন্তু ওই তিন মিনিটই বদলে দিয়েছে খেলার গতিপথ। এর আগে কখনই সোভিয়েতের গর্বের বৈজ্ঞানিক ফুটবলকে এতটা হতাশ হতে দেখা যায়নি। ব্রাজিলিয়ানরা বৈজ্ঞানিক ফুটবলের বিপক্ষে এইভাবে খেলবে এটা রুশদের কল্পনাতেও ছিল না।”

ম্যাচের প্রথম তিন মিনিটের পর সোভিয়েত ঘুরে দাঁড়ালেও সেদিন ব্রাজিলের গলাতেই উঠতো জয়মাল্য এমনটাই মনে করেন এই সাংবাদিক। তার ভাষ্যমতে, “ভয়ঙ্কর ওই তিন মিনিটের পর সোভিয়েতরা তাদের সমস্যা ধরতে পেরেছিল। কিন্তু ওরা নিজেদের শুধরে নিয়ে এগিয়ে যেতে পারেনি। ভুল শুধরে খেলা শুরু করলেও পারত না। কারণ, ওইদিন গারিঞ্চা নিজেকে প্রমাণ করছিল। মজার বিষয় হলো, সামনে কিংবা পিছনে কোনো দিক থেকেই আক্রমণ করে তাকে থামানো সম্ভব হচ্ছিল না।”

ওই ম্যাচ নিয়ে ফরাসি সাংবাদিক গ্যাব্রিল হ্যাননোট বলেন, “এটা ফুটবল বিশ্বের সেরা তিন মিনিট। রাশিয়া-ব্রাজিলের ম্যাচের ভাগ্য ওই তিন মিনিট পরেই নির্ধারিত হয়েছিল।”

সোভিয়েত-ব্রাজিল ম্যাচের ওই তিন মিনিটে গারিঞ্চা ঝলকে বদলে গেছে সেলেকাওদের ফুটবলও। তিন মিনিটের ওই দারুণ ফুটবলে পাওয়া আত্মবিশ্বাসে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল ব্রাজিল। পরের আসরেও ঘরে তুলেছিল বিশ্বকাপ শিরোপা। একে একে নিজেদের  তুলে নিয়েছিল ফুটবল বিশ্বের শিখরে। নিজেদের প্রতিষ্ঠা করেছিল অন্যতম ফুটবলীয় পরাশক্তি হিসেবে। সেই পথে এখনও আছে ব্রাজিলের ফুটবল।

Link copied!