• ঢাকা
  • শুক্রবার, ০৬ জুন, ২০২৫, ২৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ০৯ জ্বিলহজ্জ ১৪৪৬

মেরকেলের উত্তরসূরি কতটা তাঁর উত্তরসূরি হবেন


আলী রীয়াজ
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২৭, ২০২১, ০৯:১৩ এএম
মেরকেলের উত্তরসূরি কতটা তাঁর উত্তরসূরি হবেন

জার্মানিতে অ্যাঙ্গেলা মেরকেল যুগের অবসান ঘটছে। রোববার সংসদের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে জার্মানরা তাঁর উত্তরসূরি নির্বাচন করছেন। ১৬ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকার পরে মেরকেল ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়ালেও জার্মান রাজনীতিতে তাঁর লিগ্যাসি দীর্ঘদিন ধরেই থাকবে। এই ১৬ বছরে জার্মানি বহু ধরনের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলা করেছে; এর মধ্যে ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক সংকট, ২০১৫ সালে ইউরো জোন সংকট, একই বছরে সিরিয়া এবং ইরাক থেকে আসা শরণার্থীদের গ্রহণ করা এবং ২০২০ সালে কোভিড-১৯ অতিমারি। এই সময়ে জার্মান রাজনীতিতে যে বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটেছে, তার অন্যতম দিক হচ্ছে মেরকেল রাজনীতির আলোচনার কেন্দ্রে কূটচাল নয়, পলিসিকে রাখতে পেরেছেন। 

২০১৫ সালে শরণার্থী বিষয়ে তাঁর সিদ্ধান্ত খুব জনপ্রিয় ছিল, তা বলা যাবে না। এই প্রশ্নে তাঁর কোয়ালিশনের অন্য দল লিবারেলরা ভিন্নমত পোষণ করেছিল। কিন্তু তাঁর অবস্থান ছিল নৈতিক ও নীতিকেন্দ্রিক। এর জন্য তাঁকে মাশুলও গুনতে হয়েছে ২০১৭ সালের নির্বাচনে, খানিকটা পশ্চাদপসারণও; কিন্ত তাঁর সিদ্ধান্ত ইউরোপের কেন্দ্রে যে কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা না ঘটার ব্যবস্থা করেছে। রক্ষণশীল দলের প্রতিনিধিত্ব করেও তিনি যে পরিবর্তনগুলো করেছেন, সেটি একার্থে তাঁর নেতৃত্বের গুণকেই প্রকাশ করে, এমনকি তাঁর সঙ্গে একমত না হয়েও তা বলা যায়। কিন্তু সবচেয়ে বড় বিষয় যেটি সেটি হচ্ছে ইউরোপ এবং বিশ্ব রাজনীতিতে যখন অস্থিতিশীলতা চলেছে মেরকেল সেখানে স্থিতিশীলতার প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন—এই কারণে নয় যে তিনি বারবার বিজয়ী হয়েছেন, এই কারণে যে তাঁর অনুসৃত পররাষ্ট্রনীতি আস্থার জায়গা তৈরি করেছে। 

২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২১ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত পশ্চিমা বিশ্বের নেতৃত্ব তিনিই দিয়েছে, ‘লিডার অব দ্য ফ্রি ওয়ার্ল্ড’ বলে যে কথাটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ব্যবহৃত হয়, সেটি অন্তত এই সময়ে জার্মানির প্রাপ্য। 

কিন্তু রাজনীতির দৃশ্যপট থেকে মেরলের অনুপস্থিতির এই সূচনায় মেরলের নেতৃত্বের সাফল্যগাথা বর্ণনা আমার লক্ষ্য নয়, আমি বরঞ্চ সামনের দিকে তাকাবার তাগিদেই এই প্রসঙ্গের অবতারণা করেছি। সামনের দিনগুলোতে ইউরোপ বিশ্ব রাজনীতিতে কী ভূমিকা নেবে, মেরলের অবসর গ্রহণের প্রেক্ষাপটে সেটাই ভাবা দরকার। 

এর কারণ তিনটি। প্রথমত, বিশ্ব রাজনীতি এবং অর্থনীতির ভরকেন্দ্র এশিয়ায় সরে গেছে অনেক আগেই, কিন্তু এখন চীন সেই ভরকেন্দ্রের নেতৃত্ব দিতে উদ্যোগী; সেইখানে ইউরোপের সবচেয়ে বড় শক্তি হিসেবে জার্মানির ভূমিকা কী হবে? যুক্তরাষ্ট্র চীনকে সামরিক এবং অর্থনৈতিকভাবে মোকাবেলা করতে চায়। সেটা করতে হলে তার দরকার ইউরোপের সমর্থন ও সহযোগিতা। 

দ্বিতীয়ত, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইউরোপের যে মতপার্থক্যের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে, সেখানে জার্মানি সেতুবন্ধ হতে পারবে কিনা। ডোনাল্ড ট্রাম্পের আমলে দুই দেশের সম্পর্কের টানাপোড়েনের মুখে ন্যাটো এবং অন্যত্র জার্মানি ইউরোপকে একত্রে রেখেছে এবং নেতৃত্বে দিয়েছে। আগামীতে কী হবে? আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্র এবং ন্যাটোর পরাজয় এই বিষয়কে আরও জটিল করে তুলেছে।  

তৃতীয়ত, রাশিয়া ও জার্মানির সম্পর্ক। ইউক্রেনের যুদ্ধে রাশিয়ার সম্পৃক্ততা, দেশের ভেতরে রাজনৈতিক ভিন্ন মতাবলম্বীদের ওপর দমন-পীড়ন এবং জার্মানিতে গণতন্ত্রকে ক্ষুণ্ণ করার প্রচেষ্টা দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটিয়েছে। কিন্তু দুই দেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ক অটুট আছে। নর্ড স্ট্রিম পাইপলাইন তাঁর একটি অন্যতম উদাহরণ।
 
জার্মানির নির্বাচনের প্রাথমিক ফলাফলের যে ইঙ্গিত এক্সিট পোলগুলোতে পাওয়া যাচ্ছে, যা জার্মান সময় মধ্যরাত পর্যন্ত জানা গেছে তাতে সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট -এসপিডি- এগিয়ে আছে, মেরকেলের দল রক্ষণশীল সিডিইউ/সিএসিউ পিছিয়ে পড়েছে। এটা মোটেই অপ্রত্যাশিত ফল নয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সরকার গঠনে গ্রিন পার্টির সমর্থন লাগবে বলেই বোঝা যাচ্ছে। রক্ষণশীলরা এখনো আশা করছেন যে, তাঁরা একটি কোয়ালিশন সরকার করতে পারবে। সেই সম্ভাবনা কম। 

ক্ষমতায় সেই দলই যাক না কেন তাঁদের বিশ্ব রাজনীতিতে জার্মানির ভূমিকার বিষয়গুলোকে খুব শিগগিরই মোকাবেলা করতে হবে। অ্যাঙ্গেলা মেরকেলের উত্তরসূরি কতটা তাঁর উত্তরসূরি হবেন আর কতটা নিজস্ব চিহ্ন রাখতে চাইবেন/পারবেন সেটা দেখার বিষয়। কেননা এর সঙ্গে বিশ্বের সকলের স্বার্থ এবং বৈশ্বিক রাজনীতির অনেক কিছুই নির্ভর করছে।

সামাজিক যোগাযোগ বিভাগের আরো খবর

Link copied!