• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১, ৯ শাওয়াল ১৪৪৫

সমকামিতা : জনপ্রিয় হতে ইচ্ছুক সাহিত্যিকেরা যা এড়িয়ে চলেন


ফরিদ আহমেদ
প্রকাশিত: ডিসেম্বর ২৪, ২০২২, ০১:৪৯ পিএম
সমকামিতা : জনপ্রিয় হতে ইচ্ছুক সাহিত্যিকেরা যা এড়িয়ে চলেন

যারা স্থায়ীভাবে দেশ ছেড়ে ভিন্ন দেশে বসবাসের জন্য যান, তাদের বেশ কিছু সমস্যার মোকাবেলা করতে হয়। প্রথম যে সমস্যাটা আসে, সেটা হচ্ছে অর্থনৈতিক। নতুন দেশে জীবিকার জন্য নতুন করে সংগ্রাম শুরু করতে হয়। এই কাজটা বেশ কঠিন। এর সাথে যুক্ত হয় নতুন ভাষা শেখা, নতুন সমাজ ব্যবস্থায় নিজেকে খাপ খাইয়ে নেওয়া, নতুন সংস্কৃতির সাথে অভিযোজন করা কিংবা অভিযোজিত না হয়ে টিকে থাকার কৌশল রপ্ত করা। এইসব সমস্যাকে অতিক্রম করে যখন তারা একটু স্বস্তি পাবে ভাবে, ঠিক সেই সময় তাদের উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠার দ্বিতীয় স্তর আসে। আর সেটা আসে নিজেদের বাচ্চাদেরকে কেন্দ্র করে।

নতুন একটা দেশে স্থায়ী অভিবাসন নিলেও বেশির ভাগ বাংলাদেশি বাবা-মা চায় না যে তাদের ছেলেমেয়ে নিজেদের সংস্কৃতি থেকে সরে যাক, নিজেদের ধর্মকে বিসর্জন দিক। এর জন্য বাসাতে চলে কড়া এক শাসন। সেই শাসনে বিদেশের মাটিতে বড় হওয়া বাচ্চাদেরও বাঙালি হতে হয়, বাবা-মায়ের ধর্মের প্রতি একই ভক্তি জন্মাতে হয়। সমস্যা হচ্ছে, যে বাচ্চারা সারাদিন বাসায় থাকে না। স্কুলের জন্য কিংবা অন্য কোনো প্রয়োজনে তাদের বাড়ির বাইরে কাটাতে হয় দিনের একটা বড় সময়। সেই সময়টাকে স্থানীয় সংস্কৃতির সাথে তাদের যোগসূত্র তৈরি হয়। আর ফলে সেই সংস্কৃতিকে অভিযোজিত করে নেওয়ার মানসিকতাও তাদের জন্মে। এটাই স্বাভাবিক। বাবা-মায়ের মতো তাদের শিকড় বাংলাদেশে থাকে না। শিকড় এইখানে যেহেতু, এখানকার মাটি থেকেই পুষ্টি নেওয়ার চেষ্টা করে তারা।

বাচ্চাকাচ্চাদের নিয়ে বাবা-মায়ের সবচেয়ে উৎকণ্ঠার সময়টা হচ্ছে তাদের টিন-এজ সময়। এই সময়টা বাচ্চারা বাবা-মায়ের ছায়া থেকে বের হওয়া শুরু করে, শারীরবৃত্তিক পরিবর্তনের ফলে দেহ এবং মনে চাহিদা জন্মায়, বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণবোধ করে, নানা ধরনের এডভেঞ্চারাস বিষয়ে অভিজ্ঞতা নেওয়ার আগ্রহ তৈরি হয় তাদের মধ্যে। বাচ্চাকাচ্চাদের এই নতুন আগ্রহ এবং আকাঙ্ক্ষাকে বাবা-মায়েরা দেখে আতঙ্কের দৃষ্টিতে। নিজদের ধর্ম, সমাজ, সংস্কৃতির গণ্ডির বাইরে চিন্তা করতে না পারার কারণে এই আতঙ্কটা তৈরি হয় তাদের মাঝে। ছেলেমেয়ে যদি নিজের সম্প্রদায়ের বাইরে, নিজেদের ধর্মীয় বৃত্ত অতিক্রম করে কাউকে পছন্দ করে ফেলে, তখন কী হবে? কীভাবে তারা নিজেদের সম্প্রদায়ের মানুষের কাছে মুখ দেখাবে?
বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষই ধর্ম দিয়ে, সংস্কার দিয়ে, সামাজিক বিধিনিষেধ দিয়ে বন্দি। ধর্মবিশ্বাস, কুসংস্কার, প্রেজুডিসের বাইরে যাওয়া তাদের পক্ষে যাওয়া সম্ভব হয় না। আর সম্ভব হয় না বলেই তারা বাসাতে বাচ্চাদের ওপরে বিধিনিষেধের শৃঙ্খল পরাতে থাকে। যদিও তাতে যে খুব বেশি একটা লাভ হয়, তা নয়। ছেলেমেয়েরা নিজেদের জাতির বাইরে কিংবা ধর্মবিশ্বাসের বাইরে কাউকে পছন্দ করলেই অদ্ভুত সব আচরণ করা শুরু করে তারা। সুমাইয়া মতিন তার স্মৃতিকথাতে লিখেছেন, তিনি একজন বাদামি ছেলেকে ভালোবাসলেও, সেই ছেলে ভারতীয় বলে আর মুসলমান না বলে তার মা তাকে নিয়ে বাংলাদেশে আটকে ফেলেছিল। সেখানে জোর করে তাকে বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চালিয়েছিল। সুমাইয়ার ভাগ্য ভালো। কানাডিয়ান হাই কমিশনের কারণে তিনি ঢাকা থেকে উদ্ধার পান। কানাডাতে ফিরে এসে নিজের মতো জীবন গড়ার সুযোগ তৈরি করেন।

সুমাইয়া মতিনের চেয়েও জটিল অবস্থা হচ্ছে রুখসানা আলীর। রুখসানা আলী অবশ্য বাস্তব চরিত্র না। বাংলাদেশি-কানাডিয়ান লেখক সাবিনা খানের উপন্যাস ‘দ্য লাভ এন্ড লাইজ অব রুখসানা আলী’-র মূল চরিত্র। এই উপন্যাসের পটভূমি হচ্ছে সিয়াটল। সিয়াটলে এসে বসতি গড়েছিল রুখসানার বাবা ইব্রাহিম আর মা জোবেদা। বেঁচে থাকার তাগিদে একটা বাংলাদেশি গ্রোসারি চালু করেছিলেন তারা। তাদের দুই ছেলেমেয়ে। একজন রুখসানা আর অন্যজন হচ্ছে আমির। ইব্রাহিম এবং জোবেদা খুবই রক্ষণশীল মানসিকতার মানুষ। এই যুগে এসে সন্তানদের মধ্যে তারা পার্থক্য করেন, বৈষম্যমূলক আচরণ করেন। মেয়ে রুখসানার চেয়ে ছেলে আমির অনেক বেশি সুযোগ সুবিধা পায়।
সুযোগ সুবিধা কম পেলেও রুখসানার অর্জন কম নয়। টুয়েলভ গ্রেডে পড়ে সে। ফল সেমিস্টার থেকে ইউনিভার্সিটিতে যাবে। ক্যালটেক থেকে ফুল স্কলারশিপের অফার পেয়েছে। কিন্তু বাড়ি থেকে অত দূরে গিয়ে মেয়ে পড়বে, এতে নারাজ তার বাবা-মা। যদিও এই সমস্যা তেমন জটিল হয় না। মানুষজনকে বলতে পারবে মেয়ের অর্জনের কথা, সেই ভাবনা থেকে রুখসানার পড়ার স্পৃহাকে মেনে নেয় তারা। সমস্যা জটিল হয়ে পড়ে অন্য জায়গায়।
রুখসানা প্রেমে পড়ে। সেই প্রেমের সমস্যা সুমাইয়া মতিনের চেয়েও অনেক জটিল। ভিনদেশি বা ভিন্ন ধর্মের কোনো ছেলের প্রেমে নয়, রুখসানা প্রেমে পড়ে তার সহপাঠী আরেক মেয়ের। তার নাম আরিয়ানা। আরিয়ানা এবং রুখসানা দুইজনেই সমকামী। আরিয়ানা এটা তার মায়ের কাছে প্রকাশ করে নির্দ্বিধায়। ঝামেলা তৈরি হয় রুখসানার জন্য। তার পক্ষে এই প্রেমের সম্পর্ক বাবা-মাকে জানানো সম্ভব নয়। সমকামিতা বাংলাদেশের সমাজে শুধু প্রেজুডিসের ব্যাপার না, এটা নিষিদ্ধ বিষয়, ট্যাবু।

রুখসানা না জানালেও একদিন তার মা জেনে যায় তাদের সম্পর্কের ব্যাপারটা। তিনি নিজের চোখেই রুখসানা এবং আরিয়ানাকে চুম্বনরত অবস্থায় দেখেন। মেয়েকে এই সম্পর্ক থেকে ফেরানোর জন্য বকাবকি থেকে শুরু করে চড়-থাপ্পড়ের মতো শারীরিক নির্যাতনও করেন তারা। কিন্তু মেয়ে কিছুতেই আরিয়ানাকে ভুলবে না, বিষমকামী সম্পর্কে আসবে না, এটা বুঝতে পেরে তার নানির অসুস্থতার কথা বলে তাকে নিয়ে দেশে আসেন তারা। নানির সাথে রুখসানার একটা আন্তরিক সম্পর্ক ছিল। সেটাকে পুঁজি করেন তারা। ঢাকায় এসে রুখসানার পাসপোর্ট লুকিয়ে ফেলা হয়। তার বিয়ের তোড়জোড় চলতে থাকে।

রুখসানা একদিন তার পাসপোর্ট চুরি করে। মামাতো বোন শায়লার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে যাওয়ার টিকিট কেনে। কিন্তু পালানোর আগেই তার মায়ের কাছে ধরা পড়ে যায়। পাসপোর্ট চলে যায় আবার মায়ের দখলে।
রুখসানার জন্য একটা ছেলেকে ঠিক করা হয়। ছেলেটার নাম সোহেল। কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএ করে দেশে ফিরে এসেছে। ভালো একটা চাকরি করে। এই ছেলেটার সাথে দুই-একবার বাইরে দেখা করে রুখসানা। সেখানেই একদিন বিস্মিত রুখসানা জানতে পারে সোহেল নিজেও সমকামী। তার প্রেমিক আছে। সেই প্রেমিক ছেলেটা শিকাগোতে এমবিএ করছে। সোহেল তার বাবা-মাকে তার সেক্সসুয়াল অরিয়েন্টেশন বলার সাহস পায়নি। বাংলাদেশের সমাজ-ব্যবস্থাতে  সমকামিতা শুধু ট্যাবুই না, বিপদজনক একটা বিষয়ও। বিপদ জানার পরেও সোহেলরা বসে থাকেনি। কয়েক বন্ধু মিলে গড়ে তুলেছে একটা ব্লগ, যেখানে সমকামিতা নিয়ে লেখালেখি করে তারা। এটা যে বিষমকামিতার মতোই স্বাভাবিক একটা সেক্সসুয়াল অরিয়েন্টেশন, সেটা সম্পর্কে সচেতনতা জন্মানোর চেষ্টা করে।

সোহেলের সহযোগিতায় বাবা-মেয়ের হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার চেষ্টা চালায় রুখসানা। সোহেল নিজেও পালানোর সিদ্ধান্ত নেয়। বিয়ের দিনেই দুজনে আমেরিকা চলে আসবে সেই সিদ্ধান্ত হয়। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী রুখসানা এয়ারপোর্টে যায়। কিন্তু সোহেল আসে না। এয়ারপোর্টে থাকার সময়েই রুখসানা জানতে পারে সোহেলকে হত্যা করা হয়েছে।

অনেকেরই হয়তো জানা আছে, বাংলাদেশের প্রথম সমকামীদের পত্রিকা ছিলো ‘রূপবান’। এটা চালাতেন সমকামী অধিকারকর্মী জুলহাস মান্নান। ২০১৬ সালের ২৫ এপ্রিল কলাবাগানের লেক সার্কাস রোডে জুলহাস মান্নানের বাসায় ঢুকে তাকে এবং তার বন্ধু থিয়েটারকর্মী মাহবুব তনয়কে হত্যা করেছিল উগ্রবাদীরা। সাবিনা খানের উপন্যাসের এই সোহেল চরিত্রের উৎস খুব সম্ভবত জুলহাস মান্নান।

সাবিনা খান তার উপন্যাসে শুধু রুখসানার সমস্যাকেই চিহ্নিত করেননি, তিনি আরও বৃহৎ জায়গাকে ছুঁতে চেষ্টা করেছেন। বাংলাদেশে সমকামীরা যে এখনও অধিকারবিহীন, কেউ নিজেকে প্রকাশ করলে তাকে যে ঘৃণ্য এক পশুর মতো দেখা হয়, মেরে ফেলা হয় কোনো ধরনের বিচার ছাড়াই, সেই ইস্যুকে তিনি ছড়িয়ে দিয়েছেন তার উপন্যাসে। এটা একটা দারুণ সাহসের ব্যাপার। জনপ্রিয় হওয়ার ইচ্ছা আছে এমন কোনো সাহিত্যিক সাধারণত এইসব বিতর্কিত এবং অজনপ্রিয় ইস্যুকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করেন।

‘দ্য লাভ এন্ড লাইজ অব রুখসানা আলী’ অবশ্য শুধু সমকামিতার গল্পই শোনায় না, নারীদের প্রতি বাংলাদেশের সমাজের যে বৈষম্য, সেটাকে তুলে এনেছেন তিনি। নারীর যেন কোনো অধিকার নেই তার জীবনের বিষয়ে। সব সিদ্ধান্ত হয় বাবা-মা নেবে, নয়তো স্বামী নেবে কিংবা পরিবারের কোনো পুরুষ নেবে। এটা শুধু রুখসানার ক্ষেত্রেই না, রুখসানার মা এবং নানির জীবনেও ঘটেছে।

রুখসানার নানির প্রসঙ্গ যেহেতু এলো, তখন তাকে নিয়ে কিছুটা কথা বলা দরকার। এই উপন্যাসের সবচেয়ে উজ্জ্বল এবং সাহসী চরিত্র হচ্ছে রুখসানার নানি। বৃদ্ধ এবং ভঙ্গুর এই নারীই রুখসানাকে সাহস জুগিয়েছেন। যেখানে রুখসানার বাবা-মা থেকে শুরু করে মামা-খালা সবাই রক্ষণশীল, একটা মেয়ের নিজস্ব চিন্তাকে, স্বপ্নকে দুমড়ে-মুচড়ে দিতে প্রস্তুত, সেখানে এই নারীটি পরিষ্কারভাবে রুখসানাকে বলেছেন, তুমি যেটাতে আনন্দ পাও, সুখী হও সেটাই করো।

উপন্যাসের শেষে অবশ্য বড় ধরনের চমক রয়েছে। রুখসানা ফিরে আসার আগে নানি তার হাতে তুলে দিয়েছিলেন হাতে লেখা একটি ডায়েরি। সেই ডায়েরি পড়ে তার নানির এবং মায়ের জীবনের অন্ধকারাচ্ছন্ন এক সময়কে জানতে পারে রুখসানা। তার মা এবং নানি যে ধরনের পুরুষতান্ত্রিক অত্যাচারের মধ্যে দিয়ে গিয়েছে, সেটা জেনে নিজের কষ্টকে তার কোনো কষ্ট বলেই মনে হয়নি। সেই অন্ধকার জীবন থেকে বের হয়ে আসার জন্য নানি যা করেছিলেন, সেটা জেনে রুখসানা যেমন শিহরিত হয়েছে, একইভাবে মায়ের বদ্ধ মানসিকতার পিছনের কারণটাও সে খুঁজে পেয়েছে।

উপন্যাসে বাংলাদেশিদের দুই জীবনকে নিখুঁতভাবে তুলে ধরেছেন সাবিনা খান, বাংলাদেশের জীবন আর বাংলাদেশের বাইরের জীবন। এই কাজটা করতে গেলে লেখককে দুই জীবন, দুই সমাজ সম্পর্কেই যথেষ্ট ধারণা থাকতে হয়। সাবিনা খানের সেটা আছে। তিনি জন্মেছেন জার্মানিতে। কিন্তু টিন-এজ বয়সটা কাটিয়েছেন বাংলাদেশে। যুক্তরাষ্ট্রেও বসবাস করেছেন তিনি। এখন আছেন কানাডার ব্রিটিশ কলম্বিয়াতে।

Link copied!