কায়েস চৌধুরী এক গরমের সকালে হাফপ্যান্ট পরে সলিমুল্লাহ রোডে পরোটা ডিম ভাজি খাচ্ছিলেন। আমি তাকিয়ে আছি চেনা মুখ দেখে, উনি খেতে খেতেই ডাক দিলেন, অর্ডার দিলেন, নাস্তার বিলও দিয়ে দিলেন। এটা আজ থেকে ১৩-১৪ বছর আগের গল্প। এখন হলে আমিও পুছতাম না, উনিও নিশ্চয় সলিমুল্লাহ রোডে নাস্তা করতেন না। নাটক সিনেমায় মার্জিত কিছুটা আপার মিডলক্লাস রোল করার একজন অভিনেতা ও খ্যাতিমান নির্দেশক চলে গেল। তবে যা মানুষজন জানে না তিনি বিদেশ থেকে ফিল্মের ওপর অনেক পড়াশোনা করা ‘সফিসটিকেটেড’ মানুষ।
ছোটবেলায় থেকে কায়েস চৌধুরী ছিলেন অত্যন্ত সাবলীল এক বক্তা, স্কুল বিতর্কে ভালো, চটপটে ছেলে। ক্লাস সেভেন এইট থেকেই একা একা মুভি দেখতেন। তার ভাই খুব উৎসাহ দিতো। এক মিলনায়নতেন কোস্টা গবরাসের ‘জেড’ দেখে তিনি খুব খুশী হলেন। তখন পরিবেশও ছিল দারুণ, সিনেমা শেষে তা নিয়ে আলাপ করলেন, আমজাদ হোসেন ও আব্দুস সামাদ। তিনি প্রি-টেস্টের ছাত্র, সাহস করে সামাদ সাহেবকে বললেন, তিনি কাজ করতে চান। সামাদ সাহেবও নিরাশ করলেন না, জানালেন, ম্যাট্রিকের পরে আসতে। তারপর দিন গেল। বিদেশ থেকে আসা এক ভদ্রলোক বললো অভিনয় করতে তার সিনেমায়। তিনি সামাদ সাহেব কাজ করবে বলে অভিনয়ে রাজী হলেন। পরে মাসুদুর রহমান সে ছবিতে কাজ করে। মাসুদুর রহমানের সহকারী হিসাবে তিনি কাজ করেন। অনেকদিন এসিস্ট্যান্ট ডিওপি ছিলেন। ইবনে মিজানের সহকারী দেওয়ান নজরুল, শোলের আন অফিশিয়াল রিমেক বানাবেন, ‘দোস্ত দুশমন’ প্রধান চিত্রগ্রাহক ছিলেন তিনি। দেওয়ান নজরুল তখন হিট মেশিন। খালি একটার পর একটা হিট করাচ্ছেন। তখনকার দেওয়ান নজরুল থাকতেন শহীদবাগের এক মেসে। কায়েস কাজ করতেন তার সাথেই। কায়েস চৌধুরী বেতন পেতেন হাউজ থেকে ২২০০ টাকা। তিন টাকা দিয়ে ইসলামিয়া রেস্টুরেন্টে খাসীর চাপ আর নান খাওয়া যেত। কিছুদিন পর দেওয়ান নজরুল বড় একটা বাসা নিবেন, খুঁজছেন। দেখেন চার হাজারের নিচে ভালো বাসা নেই। কায়েস চৌধুরীর মনে হলো, দেওয়ান নজরুল যে প্রযোজকদের লাখ লাখ টাকার ব্যবস্থা করে দেয়, এত ভালো গান লিখে, সে একটা চার হাজার টাকা বাসা নিতে পারে না। তিনি চিন্তা করলেন এদেশে থাকলে তো অনেক কষ্ট। পড়তে বিদেশে গেলেন। মাস্টার্স করলেন, পিএইচডি করলেন, ডকুমেন্টারি ফিল্ম মেকার হলেন।
প্রায় একুশ বছর পর তিনি দেশে এলেন। তার মনে হলো অনেক হয়েছে বাইরে থাকা। দেশে এসে দেখেন সিনেমার রমরমা নাই, হল বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। তিনি টিভি নাটক বানানো আর নাটক লেখা শুরু করলেন। অনুরোধে অভিনয়ও করলেন অনেক নাটকে। লেখালেখিতে তিনি কিশোর তারুণ্যেই বিখ্যাত। সে আমলে তার লেখা ৫০টা নাটক রেডিওতে গিয়েছে। কিডনি ডায়লাইসিস রোগী ছিলেন। অবশেষে আজ চলে গেলেন। তার স্বপ্ন ছিল সিনেমা বানিয়ে আবার মধ্যবিত্তকে ফেরাবেন হলে, সেসব আর হলো না। বিদায় কায়েস চৌধুরী!