• ঢাকা
  • সোমবার, ২০ মে, ২০২৪, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১,

বার্বি ও মিডিয়ার চাতুর্য


তানিয়া কামরুন নাহার
প্রকাশিত: জুলাই ২৩, ২০২৩, ০৯:৩৯ এএম
বার্বি ও মিডিয়ার চাতুর্য

মিডিয়া নারীকে পণ্য হিসেবে ব্যবহার করে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। এখন মিডিয়া নারীর অধিকারের প্রশ্নের কিছুটা সচেতনতা প্রদর্শন করতে গিয়ে, নারী যে পণ্য নয়, বরং পরিপূর্ণ মানুষের অধিকার রাখে, সেসব প্রকাশ বা প্রচার করে। তবে কি না, মিডিয়ার চাতুর্য এখানেই যে, নারীর অধিকারের কথা বলতে গিয়েও নারীকে শেষ পর্যন্ত পণ্য হিসেবেই ব্যবহার করে। নারীকে পণ্য হিসেবে ব্যবহার করে অর্থ উপার্জন করে আর নারীরাও বিপুল উৎসাহে স্বেচ্ছায় এ ফাঁদে নিজেকে সঁপে দিচ্ছেন। কিছু উদাহরণ দেওয়া যাক বরং।

গত শতকের ৬০-এর দশকে ফ্যাশন ডল হিসেবে বার্বির জন্ম। পরবর্তী সময়ে শৈশব থেকেই নারীদের স্বপ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে, বার্বির মতো নিখুঁত সৌন্দর্যের অধিকারী হওয়ার। মেয়ে শিশুদের কাছে বার্বি ডল, ডলের সাজ পোশাক, ঘরবাড়ি থেকে শুরু করে যাবতীয় সরঞ্জাম বেশ জনপ্রিয়। এর ব্যাপকতা এমন যে শৈশব থেকেই শিশুরা বার্বির মতো সেজেগুজে থাকতে চায়। নিজেকে পণ্য বানানোর প্রক্রিয়ায় এখান থেকেই শুরু। ওদের আইডল কোনো জীবন্ত মানুষ নয়, কোনো বিজ্ঞানী বা লেখক বা অন্য কোনো ব্যক্তিত্ব নয়, বরং একটা জড় পুতুল! অথচ কোনো মানুষই নিখুঁত নয়। নিখুঁত নয় বলেই একজন মানুষ সুন্দর হয়ে ওঠে। কিন্তু মিডিয়ার মাধ্যমে নারীরা একটাই বার্তা প্রতিনিয়ত পাচ্ছে, তাকে হয়ে উঠতে হবে নিখুঁত সুন্দর। প্রয়োজনে নিজের আসল সৌন্দর্যকে নকল আইল্যাশ, উইগ, গাঢ় মেকাপ দিয়ে ঢেকে আরেক রকম সৌন্দর্যের রাণী হয়ে উঠতে চাইছে তারা। তাতেও তাদের শান্তি নেই। নিজেকে তারা তুলনা করছে মিডিয়ার জিরো ফিগারের নায়িকা বা মডেলদের সঙ্গে। ৩৬-২৬-৩৬ এমন এক অবাস্তব শারীরিক গঠনের বার্বির মতো তারা হতে চাইছে। নিজেকে নিয়ে নারীরা আজ এতটাই অসন্তুষ্ট যে, সার্জারি টেবিলে অনায়াসে শুয়ে পড়ছেন। নিজেকে সঁপে দিচ্ছেন ছুরি কাঁচির নিচে। একটা পুতুল হওয়ার, একটা পণ্য হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করার কত না প্রয়াস!

আজকাল যেকোনো বিয়ের অনুষ্ঠানে গেলে আলাদা করে কনেকে চেনা যায় না। সব মেয়েই একইরকম সাজে সেজে আসেন। বিয়ে ছাড়াও যেকোনো অনুষ্ঠানে যাবেন, যেকোনো কাজে কোথাও যাবেন, দেখবেন, প্রায় প্রত্যেক নারী একইরকম ভাবে মেকাপ করা, একইরকম ভাবে তাদের চুল রিবন্ডিং করা, একই রকম লম্বা নখ... সবাই যেন একই রকম রং করা পুতুল। মানুষ তো ম্যানিকুইন নয় যে, সবাই একই রকম দেখতে হবে! নিজের শ্যামলা রং, কোঁকড়া চুল, গালে ব্রণের দাগ, মোটা ভ্রূ নিয়ে কেউই সুখী নয়।

১৯৯৭ সালে একুয়া ব্যান্ডের ‘বার্বি’ গানটি তুমুল জনপ্রিয়তা পায়। দুযুগ পেরিয়ে আজও গানটি সমান জনপ্রিয়। গানটিতে প্লাস্টিক দুনিয়ার প্রেমের কথা বলা হয়েছে, যেখানে মেয়েটি শুধুই এক পুতুল, তাকে নিয়ে যা খুশি তাই করা যায়। বর্তমানে সময়ের প্রেমের এক নিদারুণ বাস্তবতা বার্বি ডলের মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়। এর প্রায় দুযুগ পরে এই গানেরই সুরে নতুন লিরিকে এভা ম্যাক্স আরেকটি গান প্রকাশ করেন, ‘নট ইউর বার্বি গার্ল’। গানে নারীর নিজস্বতা দুর্দান্তভাবে প্রকাশ করা হয়েছে। কিন্তু হলে কী হবে? মিডিয়ার এমনই চতুর যে, এ গান নিয়ে যত রিলস আর টিকটক, প্রায় সবখানে মেয়েরা সেই গতানুগতিক পুতুল সেজে বসে আছে। একই কথা প্রযোজ্য কলবি ক্যালের ‘ট্রাই’ গানের ক্ষেত্রেও। নারীর পুতুল সেজে থাকার বাইরে নিজস্বতা নিয়ে দারুণ লিরিকের এই গান বার্তা যেমনই দিক, নারীরা এ গানের সঙ্গে টিকটক করছে, কিন্তু সেই মিডিয়ার শেখানো পথে, পণ্য হয়েই। ম্যাগান ট্রেইনরের ’মেইড ইউ লুক’ গানের বক্তব্যও কিন্তু নারীর নিজস্বতা নিয়ে। কিন্তু চতুর মিডিয়া এ গানের মিউজিক ভিডিও ঠিকই করলো নারীকে পণ্যের মতো উপস্থাপন করে। নারীও মিডিয়ার শেখানো মতে পণ্য সেজে খুশি হলো। ভুলে গেলো, তার নিজস্বতা, গান ও মুভির মূল বার্তার কথা। বরং নিজেকে নিয়ে সবাই বিব্রত।

বাস্তবের মেয়েরা বার্বির মতো নিখুঁত হতে চায়। সম্প্রতি বিশ্বজুড়ে মুক্তি পেয়েছে ’বার্বি’ মুভিটি। মুভির বার্বি চরিত্রটি কিন্তু শেষ পর্যন্ত তার কাল্পনিক বার্বিল্যান্ড থেকে বাস্তব জগতে বাস করার ইচ্ছে প্রকাশ করেছে। মিডিয়ার চাতুর্য এখানে কোথায়? চাতুর্য এখানেই, মুভির সমাপ্তি যেভাবেই ঘটাক না কেন, যতই বাস্তব জগতের মাহাত্ম্যের বার্তা দেওয়া হোক না কেন, শেষ পর্যন্ত সব বয়সের নারীদের মনে বার্বির মতো গোলাপি রাজ্যে বাস করার ইচ্ছাটাকেই উস্কে দেওয়া হচ্ছে। বিশ্বব্যাপী এ মুভির প্রচারণায় যত মডেল, তারকা, সোশাল মিডিয়ার সেলিব্রেটিদের আমন্ত্রণ করা হয়েছে, তারা সবাই কাল্পনিক এক পুতুলের সাজেই গিয়েছেন। কেউ কিন্তু ভুল ভ্রান্তিতে ভরা, খুব সাধারণ বাস্তব জীবনকে উপস্থাপন করতে যায়নি। দর্শকদের মধ্যেও তুমুল উত্তেজনা, কে কেমন ভাবে বার্বি সাজে মুভি দেখতে যাবে। শেষ পর্যন্ত একটা কাল্পনিক পুতুলই মানুষের আইডল হয়ে উঠছে।

লেখক : শিক্ষক ও লেখক। 

Link copied!