• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

মার্কিন ব্যাংক দেউলিয়ায় বাংলাদেশের হিসাবনিকাশ


ড. মো. আইনুল ইসলাম
প্রকাশিত: মার্চ ১৫, ২০২৩, ১১:০২ এএম
মার্কিন ব্যাংক দেউলিয়ায় বাংলাদেশের হিসাবনিকাশ

বিশ্বের সর্ববৃহৎ অর্থনীতির দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে দুটি সুপ্রতিষ্ঠিত ব্যাংকের অবসায়ন, বন্ধ বা দেউলিয়া হওয়ার ঘটনায় বিশ্ব ব্যাংক ব্যবস্থায় বড় ধরনের অস্থিরতা ও আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। ক্যালিফোর্নিয়ার সিলিকন ভ্যালি ব্যাংক (এসভিবি) ও নিউইয়র্কের সিগনেচার ব্যাংকে বহু মানুষ অর্থ সঞ্চিত রেখেছিলেন, যাদের অনেকেই এখন প্রায় নিঃস্ব। দেশটির সরকার ও নীতিনির্ধারকেরা ব্যাংকিং ব্যবস্থায় জড়িত সব শ্রেণির মানুষকে বারবার আশ্বস্ত করতে চাইলেও যে আতঙ্ক ও সন্দেহ সৃষ্টি হয়েছে, তা যে সহসা কাটবে না তা সবাই বুঝতে পারছে। 

মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ব্যাংক বন্ধে দায়ীদের শাস্তির পাশাপাশি আমানতকারীদের অর্থের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। আমেরিকান ট্রেজারি, ফেডেরাল ডিপোজিট ইনসিওরেন্স করপোরেশন (এফডিআইসি) যৌথ বিবৃতিতে বলেছে, “আমেরিকার অর্থনীতি রক্ষায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। ব্যাংকিং ব্যবস্থার ওপর গ্রাহকদের আস্থা ফিরিয়ে আনার কাজ শুরু হয়েছে।”

এদিকে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাকের হস্তক্ষেপে দেউলিয়া সিলিকন ভ্যালির যুক্তরাজ্য শাখা প্রতীকী ১ পাউন্ডে (বাংলাদেশি ১২৭ টাকায়) কিনে নিয়েছে ‘এইচএসবিসি’। আর্থিকীকরণকৃত বিশ্বব্যাবস্থার মূল কারিগর আমেরিকার ব্যাংকিং ব্যবস্থায় এ ধরনের অস্থিরতায় বিশ্বের সর্বত্রই ব্যাংকিং ব্যবস্থার ওপর সন্দেহ-সংশয় ও আস্থাহীনতা কালো মেঘ জমেছে। বুঝে হোক, না বুঝে হোক, মার্কিন মুলুকের ঢেউ কমবেশি এখন সর্বত্রই অনুভূত হচ্ছে। স্বভাবতই বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। আর এমনিতেই ঋণখেলাপী ও আর্থিক অব্যবস্থাপনায় জর্জরিত বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা রয়েছে। সঙ্গত কারণেই এসএভিপি ও সিগনেচার ব্যাংকের প্রভাবে বাংলাদেশে কতটা লাভ-ক্ষতি তার হিসাবনিকাশ শুরু হয়েছে। এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আগে মার্কিন দুই ব্যাংকের পতনের কারণ পর্যালোচনা করা প্রয়োজন।

বিশ্বপ্রযুক্তির ভরকেন্দ্র ক্যালিফোর্নিয়ার সান্টা ক্লারায় ১৯৮৩ সালে প্রতিষ্ঠিত সিলিকন ভ্যালি ব্যাংক (এসভিবি) শুক্রবার তাদের সদর দরজায় টাঙানো এক বিজ্ঞপ্তি জানায়, “ক্যালিফোর্নিয়া আর্থিক সুরক্ষা ও উদ্ভাবন বিভাগ সিলিকন ভ্যালি ব্যাংক বন্ধের জন্য বলেছে। ব্যাংকটি ফেডারেল ডিপোজিট ইনস্যুরেন্স করপোরেশন অধিগ্রহণ করেছে। ব্যাংকের রেজ্যুলিউশন বাস্তবায়নের সুবিধার্থে ডিপোজিট ইনস্যুরেন্স ন্যাশনাল ব্যাংক অব সান্তা ক্লারা (ডিআইএনবি) প্রয়োজনীয় কার্যাবলী সম্পাদন করবে। ডিআইএনবি থেকে আমানতকারীরা তাদের বীমাকৃত আমানত উত্তোলন করতে পারবেন।”

এসভিবি বন্ধের পেছনে নানা কারণ থাকলেও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গতবছর থেকে ক্রমাগত সুদের হার বাড়ানোই মূলত সবচেয়ে দায়ী। এসভিবি বিশ্বের সবচেয়ে নিরাপদ বিনিয়োগ হিসেবে বিবেচিত মার্কিন সরকারের বিপুল পরিমাণ বন্ড কিনে রেখেছিল। ক্রমাগত সুদের হার বাড়ানোয় বন্ড ভ্যালু কমে যায়। তারল্য সংকটে পড়ে গ্রাহক চাহিদা মেটাতে বুধবার এসভিবি লোকসান দিয়ে ২ হাজার ১০০ কোটি ডলারের বন্ড পোর্টফোলিও বিক্রি করে এবং পাশাপাশি ২২৫ কোটি ডলারের শেয়ারও বিক্রির ঘোষণা দেয়। আর এ ঘোষণার পরপরই ব্যাংকের গ্রাহক ও বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দেয়। ফলে একদিনের ব্যবধানে ব্যাংকটির শেয়ারের দরপতন ঘটে ৬০ শতাংশ। আতঙ্কগ্রস্ত আমানতকারীরা দীর্ঘসময় লাইনে দাঁড়িয়ে ১ দিনেই ৪২ বিলিয়ন ডলার তুলে নেন। সৃষ্টির শুরু থেকেই প্রযুক্তিভিত্তিক স্টার্টআপগুলিতে বিনিয়োগের মাধ্যমে অল্প সময়ে বিপুল অর্থ সঞ্চয় করেছিল ব্যাংকটি। করোনা ভাইরাসের দুই বছরে জমা হওয়া বিপুল তহবিল তারা মার্কিন বন্ডে বিনিয়োগ করেছিল। খুব সংক্ষেপে যদি এই ব্যাংকের মরণযাত্রা বিশ্লেষণ করি, তাহলে দেখা যায়, সিলিকন ভ্যালি ১.৭৯ শতাংশ হারে বন্ড কিনেছিল, ফেডারেল রিজার্ভ সুদের হার বাড়ানোয় ১ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলারের বন্ড ক্ষতি হয়, অবাস্তব লোকসানের ফলে প্রযুক্তি স্টার্টআপগুলি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে আরও নগদ ব্যবহার করতে বাধ্য হয়, শুক্রবার আমানতকারীরা ৪২ বিলিয়ন ডলার তুলে নেয়, তহবিল সংগ্রহে ব্যাংকের ১/৩ অংশ বিক্রির ঘোষণা দেওয়া হয়, শেয়ারমূল্য ৬০ শতাংশ পতন হয়, সিইও আমানতকারীদের আশ্বস্ত করতে ব্যাংক মালিকদের ফোন দেয়, সবকিছু জেনে মালিকেরা ব্যাংক বিক্রির চেষ্টা করে; আর ঠিক এ সময়ই নিয়ন্ত্রক সংস্থা ব্যাংকটি বন্ধের ঘোষণা দেয় এবং ব্যাংকের সমস্ত আমানত ডিপোজিট ইনস্যুরেন্স ন্যাশনাল ব্যাংক অব সান্তা ক্লারায় স্থানান্তর করে। এসভিবির গ্রাহকেরা এখন তাদের অ্যাকাউন্টে যত বেশি অর্থই থাকুক, বীমাকৃত ২ লাখ ৫০ হাজার ডলার পর্যন্ত অর্থই শুধু ফেরত পাবেন। এর বেশি অর্থের আমানতকারীরা তাদের বীমাহীন অর্থের জন্য রিসিভারশিপ সার্টিফিকেট পাবেন, যা ব্যাংকের সহায়-সম্পদ বিক্রি করার পর নগদায়ন হবে। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, ব্যাংকটির আমানতের মাত্র ২ দশমিক ৭ শতাংশ বীমাকৃত (২৫০,০০০ এর কম), বাকি ৮৩ দশমিক ৩ শতাংশই অবীমাকৃত।

অপরদিকে রোববার অবসায়নকৃত সিগনেচার ব্যাংক মূলত আমেরিকার অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু নিউইয়র্কের আবাসন খাতের অন্যতম জনপ্রিয় প্রতিষ্ঠান। এটি ২০০২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। ক্রিপ্টোকারেন্সি ডিপোজিট দিয়ে বিপুল অর্থ কামানোর জন্য ব্যাংকটি সম্প্রতি বড় উদ্যোগ নিয়েছিল, যাকে অনেকটা জুয়ার সঙ্গে তুলনা করা যায়। ১২ মার্চ হঠাৎ করে ব্যাংকটির সদর দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয়। এসভিবি ব্যাংক অনেকটা বাধ্য হয়ে বন্ধ হলেও সিগনেচার ব্যাংকটি নিয়ন্ত্রক সংস্থা স্ব-উদ্যোগে বন্ধ করে দেয়। সংস্থার মতে, সিগনেচার খোলা রাখলে পুরো আর্থিক ব্যবস্থার স্থিতিশীলতা হুমকির মুখে পড়বে। কারণ ব্যাংকটি ক্রিপ্টোকারেন্সি খাতে বিপুল বিনিয়োগ করেছিল। 

ক্রিপ্টোকারেন্সি শিল্পের কেন্দ্রীয় ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান সিলভারগেট ক্যাপিটাল তাদের কার্যক্রম বন্ধের ঘোষণা দেওয়ার কয়েক ঘণ্টা পরই নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিগনেচার ব্যাংকের অবসায়নের সিদ্ধান্ত নেয়। সিলিকন ভ্যালি ব্যাংকের গ্রাহকদের বড় একটি অংশ ক্রিপ্টো স্টার্টআপ ও ভেঞ্চার ক্যাপিটাল ছিল। এখানে বলে রাখা ভালো, ক্রিপ্টোকারেন্সি বা গুপ্তমুদ্রা আসলে একটি ডিজিটাল মুদ্রা, যা এনক্রিপশন অ্যালগরিদম ব্যবহার করে তৈরি। ভারচুয়াল কারেন্সি বা ডিজিটাল কারেন্সি নামেও পরিচিত ক্রিপ্টোকারেন্সি অর্থ লেনদেনের বিকল্প এক পদ্ধতি, যা বিশ্বের প্রথম ডিজিটাল সম্পদ এবং অনলাইন-অফলাইনে বৈধ অর্থপ্রদানের পদ্ধতি হিসেবে ব্যাপকভাবে গৃহীত। তবে বিশ্বের অনেক দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও সংস্থা ক্রিপ্টোকারেন্সিকে বৈধতা দেয়নি। বিশ্লেষকেরা বলছেন, ক্রিপ্টোকারেন্সি সিগনেচার ব্যাংকের পতনের পেছনে যত না বেশি দায়ী, তার চেয়ে বেশি দায়ী প্রযুক্তি খাতনির্ভর সিলিকন ভ্যালি ব্যাংকের পতনে সৃষ্ট আতঙ্ক ও গুজব। দুটি ব্যাংকেরই প্রযুক্তি খাতের সঙ্গে গভীর সংশ্লিষ্টতা ছিল। তবে সিলভারগেট ক্যাপিটাল তথ্য কারসাজিতে জড়িত ছিল। ১৯৮৩ সালে প্রতিষ্ঠিত এসভিবি ফাইন্যান্সিয়াল গ্রুপের মোট মূল্য ১০ মার্চ ২০২৩ অনুযায়ী ছিল ৬ দশমিক ২৮ বিলিয়ন ডলার। ৩১ ডিসেম্বর ২০২২ পর্যন্ত সিলিকন ভ্যালি ব্যাংকের মোট সম্পদ ছিল প্রায় ২০৯ বিলিয়ন ডলার এবং মোট আমানত ছিল প্রায় ১৭৫ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার। অপরদিকে ২০০১ সালে প্রতিষ্ঠিত সিগনেচার ব্যাংকের ২০২২ সালের শেষে এসে মোট সম্পদ ছিল ১১০ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলারের, আমানত ৮২ দশমিক ৬ বিলিয়ন এবং ২০২১ সালের হিসাবে ঋণস্থিতি ছিল ৬৫ দশমিক ২৫ বিলিয়ন ডলার।

আর্থিক খাত বিশ্লেষকেরা বলছেন, দুটি বড় ব্যাংকের এভাবে মুখ থুবড়ে পড়ায় বিশ্ব ব্যাংকিং ব্যবস্থায় শঙ্কা-উদ্বেগ সৃষ্টি হওয়াটাই স্বাভাবিক। তারা বলছেন, আর্থিক সংকটে আভাস অনুধাবনের পরও প্রয়োজনীয় উদ্যোগ না নিয়ে আগ্রাসী ও ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগে উঠেপড়ে লাগলে বিশালদেহী গোলিয়াথ ও পুঁজিখেকোদের কারণে ছোট ও মাঝারি ব্যাংকের মাধ্যমে আমানতকারীরা এভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতেই থাকবেন। পুরোনো ধাঁচে ব্যাংক পরিচালনা ও ব্যাংক দুর্বল ব্যবস্থাপনা ব্যাংকের মরণযাত্রাকে তরান্বিত করেছে।

নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ যোসেফ স্টিগলিজ ‘অ্যানাদার প্রেডিক্টেবল ব্যাংক ফেইলিওর’ শীর্ষক নিবন্ধে বলেছেন, “সিলিকন ভ্যালি ব্যাংকের পতন নিয়ন্ত্রক ও মুদ্রানীতি উভয় ক্ষেত্রেই গভীর ব্যর্থতার প্রতীক। যারা এই জগাখিচুড়ি তৈরিতে সাহায্য করেছে, তারা কি ক্ষতি কমাতে গঠনমূলক ভূমিকা পালন করবে এবং আমরা সবাই অর্থাৎ ব্যাংকার, বিনিয়োগকারী, নীতিনির্ধারক এবং জনসাধারণ কি অবশেষে সঠিক পাঠ শিখব?”

আমেরিকায় ব্যাংক দুটিতে যেসব কারণে সংকট তৈরি হয়েছে, তা বাংলাদেশে বিদ্যমান ৬টি রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংক, ৪৩টি বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক, ৩টি বিশেষায়িত ব্যাংক ও ৯টি বিদেশি ব্যাংকসহ মোট তালিকাভুক্ত ৬১টি ব্যাংকের ক্ষেত্রে খুব একটা প্রযোজ্য নয়। তবে বাংলাদেশের আমানতকারীদের সতর্ক ও সচেতন হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। কেননা, বাংলাদেশের ব্যাংক খাতের অন্যতম বড় সমস্যা হচ্ছে অনাদায়ী বা খেলাপি ঋণ। বছরের পর বছর ধরে এই অবস্থা চললেও সমস্যার সমাধানে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। বাংলাদেশ ব্যাংকের ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত হিসাব অনুযায়ী, দেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ৩৪ হাজার কোটি টাকা। যা মোট প্রদত্ত ঋণের ৯ দশমিক ৩৬ শতাংশ। আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী, কোনো দেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ২-৩ শতাংশের বেশি হওয়া উচিত নয়।

রিজার্ভ সংকটে পড়ে ৪ দশমিক ৫০ বিলিয়ন ডলার ঋণ পেতে মরিয়া বাংলাদেশ আইএমএফের চাপে খেলাপি ঋণ কমাতে দুই দফা বড় ধরনের ছাড় ঘোষণা করে অংকের মারপ্যাঁচে খেলাপি ঋণ কমিয়েছে ঠিকই, তবে তা এখনো বিপদসীমার অনেক ওপরে। আমাদের ব্যাংক খাতের ব্যালেন্স শিটে কতটা ভালো ঋণ আর কতটা মন্দ ঋণ, তার হিসাবও প্রায়ই ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়। অর্থাৎ ফাঁকি থাকে। আগে এ সংক্রান্ত তথ্য প্রকাশ করা হলেও বাংলাদেশ ব্যাংক এখন তা জানায় না। এখানে রাষ্ট্রায়ত্তসহ নতুন কিছু ব্যাংক দুর্দশাগ্রস্ত ঋণকে ভুলভাবে প্রভিশন করে অতিরিক্ত মুনাফা দেখায়। প্রভিশন করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অনেক ব্যাংক যেখানে ৫ শতাংশ টাকা সঞ্চয় করার কথা, সেখানে ২ শতাংশ করে। ফলে একদিকে যেমন অতিমুনাফা দেখায় ব্যাংকগুলো, অন্যদিকে ব্যাংকের সম্পদের মানও কমে যায়।

বিধি অনুযায়ী, ব্যাংকগুলোতে ক্যাপিটাল অ্যাডুকোয়েসি রেশিও বা পর্যাপ্ত মূলধনের হারও মোট সম্পদের ১২ শতাংশ মূলধন থাকতে হয়। আর এটি দিতে হয় ব্যাংকের মালিককে। কিন্তু বাংলাদেশের অনেক ব্যাংকেরই এ ধরনের পর্যাপ্ত মূলধন নেই। তারপরও তারা অবলীলায় ব্যবসা করে যায়। বাংলাদেশে জাল-জালিয়াতি করে ব্যাংকের টাকা চিরতরে লুটে নেওয়ার প্রবণতাও জেঁকে বসেছে। ব্যাংকের উদ্যোক্তা, পরিচালক ও ক্ষমতাশালী ব্যক্তিরা প্রভাব-প্রতিপত্তি খাটিয়ে একে অপরে মিলেমিশে নামে-বেনামে ঋণ সৃষ্টি করছেন বা আমানতের অর্থ নয়-ছয় করছেন, যা আসলে দিনেদুপুরে ডাকাতি। বিগত কয়েক বছরে এ রকম করে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট করা হয়েছে। এমনকি শুধু নিজের সম্পত্তি একাধিক ব্যাংকের কাছে জামানত রেখেই নয়, সরকারি জমি বন্ধক রেখেও এ দেশে ঋণ নিতে দেখা যায়। এ দেশে নীতিসহায়তায় ছাড়ের কারণে অনেক ব্যাংকই সুদ আদায় না করেই কাগজে-কলমে আদায় করা সুদ আয় খাতে নিয়ে মুনাফা বাড়ায়, যা আবার জেনেশুনে কুঋণ খাতেও বিতরণ করে। এমনকি এখানে শীর্ষ ১০ ঋণখেলাপি সমৃদ্ধ একটি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ নিয়ন্ত্রক সংস্থার নীতিসহায়তার সুযোগ নিয়ে একজন গ্রাহকের সাড়ে ২২ কোটির টাকার ঋণ আবেদন সন্ধ্যা ৬টা ৫০ মিনিটে নবায়ন ও অনুমোদন করে রাত ৯টায় নগদায়নেরও নির্দেশনা দেয়; আর নিয়ন্ত্রক সংস্থা শুধু কারণদর্শানোর নোটিশ দিয়েই তার দায় সারে।

সত্যি কথা বলতে কি, বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত চরম বিশৃঙ্খল এক ট্রাফিক জটে আটকে আছে। এ অবস্থায় আমানতকারীদের অর্থ কতটা নিরাপদ তা আমানতকারী নিজেরই বিবেচনা করা যুক্তিসঙ্গত। তা ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংক তো বলেই দিয়েছে, বাংলাদেশে মাত্র ৮ শতাংশ আমানতকারী ঝুঁকিতে আছেন। বাকি ৯২ শতাংশ আমানতকারীর হিসাব বীমাকৃত। ব্যাংক আমানত বীমা আইন ২০০০ (২০০০ সনের ১৮ নম্বর আইন)-এর ধারা ৭ এর সংশোধন: মতে, “(১) কোনো বীমাকৃত ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান-এর অবসায়নের আদেশ প্রদান করা হইলে, অবসায়িত ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রত্যেক আমানতকারীকে তাহার আমানতের সমপরিমাণ অথবা ২ লাখ টাকা—এই দুই এর মাঝে যাহা কম অথবা সরকারের পূর্বানুমোদনক্রমে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক নির্ধারিত টাকা আমানত সুরক্ষা তহবিল হইতে প্রদান করা হইবে।”

১৮২৯ সালে উপমহাদেশের প্রথম বাণিজ্যিক ইউনিয়ন ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দাদা প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের উদ্যোগে। যা ১৮৩০-৪৭ সময়কালে কলকাতার সবচেয়ে বড় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ছিল। ব্যবসায়ীদের মূলধন জোগানো, ঋণবৃদ্ধি, এক্সচেঞ্জ ব্যাংকিং, ব্যাংক নোট ইস্যু, কৃষিপণ্যের মূল্যকে নিয়ন্ত্রণ করাই ছিল এর প্রধান উদ্দেশ্য। সর্বোচ্চ ৭০০ শেয়ারের মালিক দ্বারকানাথ মূল কর্তৃত্ব নিজের হাতে রেখে ঘনিষ্ঠ রমানাথ ঠাকুরকে কোষাধ্যক্ষ করেন। নীলচাষে জড়িত দ্বারকানাথ নীলকর সাহেবদের পৃষ্ঠপোষকতা ও অর্থ সংস্থানের পাশাপাশি কৃষিপণ্য আমদানি-রপ্তানির হুন্ডি বিল কেনাবেচায়ও ইউনিয়ন ব্যাংককে সম্পৃক্ত করেছিলেন। ব্যাংকের পরিচালকেরা দ্বারকানাথের ঋণের অনুরোধ ফেরাতে পারতেন না। তদবির করে ব্যাংকের মোট সম্পদের অর্ধেক অর্থাৎ ৬ লাখ রুপি ঋণ জন পালমার অ্যান্ড কোম্পানিকে দিয়েছিলেন। ১৮৩০ সালের জানুয়ারিতে জন পালমার ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হলে ইউনিয়ন ব্যাংকের ব্যবসা লাটে ওঠে। দ্বারকানাথের জমিদারি অটুট থাকলেও নিঃস্ব হন আমানতকারীরা। পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় আমানতকারীর এহেন ভাগ্যবরণই অনিবার্য।

এখনো কোনো ব্যাংক অবসায়ন, বন্ধ বা দেউলিয়া হলে কপাল পোড়ে আমানতকারীদের। দীর্ঘ অপেক্ষার পর শুধু বিমাপ্রতিশ্রুত অংশটুকু আমানতকারী ফেরত পেলেও বেশির ভাগকেই শূন্য হাতেই ফিরতে হয়। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বাইডেন এ জন্যই কদিন আগে বলেছেন, ‘দিস ইজ হাউ ক্যাপিটালিজম ওয়ার্কস’। ১৯৪৭ সালে দেউলিয়া হওয়া পাইওনিয়ার ব্যাংক ও ক্যালকাটা মডার্ন ব্যাংকের লিকুইডেশনের সমস্যা এখনও সমাধান হয়নি। মালিকপক্ষের লুটপাটের কারণে ২০০৬ সালে বাংলাদেশে দেউলিয়া ওরিয়েন্টাল ব্যাংকের (পরে আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক) গ্রাহকেরা এখনও টাকা ফেরত পাননি। ১৯৯২ সালে দেউলিয়া ব্যাংক অব ক্রেডিট অ্যান্ড কমার্স ইন্টারন্যাশনাল, বিসিসিআই (পরে ইস্টার্ন ব্যাংক) গ্রাহকেরাও এখনও দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন। শুধু ব্যাংকই নয়, অনেক ব্যাংকবহির্ভুত আর্থিক প্রতিষ্ঠানে টাকা রেখেও অনেকে নিঃস্ব হয়েছেন। আমেরিকার ব্যাংক কেলেঙ্কারির ফল কিনা কে জানে, ১২ মার্চ বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে সকাল ১১টা পর্যন্ত ব্যাংক খাতের ৩৪টি শেয়ারের মধ্যে ক্রেতাহীন ছিল ২৮টি ব্যাংকের শেয়ার।

পরিশেষে বলব, দেশের অনেক ব্যাংকই এখন অতিরুগ্ন, নিয়ন্ত্রক সংস্থার দেওয়া অক্সিজেনে নামে মাত্র টিকে আছে। পাঁচ ডজন ব্যাংক থাকলেও আন্তর্জাতিক মানের কোনো ব্যাংকই নেই এ দেশে। অথচ মার্জার বা একুইজিশন করে এক ডজন ভালো ও বড় ব্যাংকই এখানে যথেষ্ট ছিল। অনৈতিকতা ও সুশসানহীনতা প্রশ্রয় দিয়ে ব্যাংকিং ব্যবসা করানো বাংলাদেশে এখন অনেকটা রীতিতে পরিণত হয়েছে। এতে ব্যাংকিং খাতের ভবিষ্যৎ ঝুঁকিতে না থাকার কোনো কারণ নেই। আর এ অবস্থায়, বালিশ-লেপ আর বাঁশের কঞ্চিতে টাকা রেখে যেহেতু শান্তি নেই, সেহেতু দেখে-শুনে-বুঝে আমানত অপেক্ষাকৃত ভালো ও ন্যূনতম নীতিনৈতিকতাসম্পন্ন ব্যাংকে নিজ দায়িত্বেই সুরক্ষিত রাখাই বুদ্ধিমানের কাজ।

লেখক : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ও সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি।

Link copied!