• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২০ মার্চ, ২০২৫, ৬ চৈত্র ১৪৩০, ১৯ রমজান ১৪৪৬
ডট বল

স্বর্গেও ঠিক ক্রিকেট চর্চা করছেন নাদির শাহ


অঘোর মন্ডল
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১২, ২০২১, ০৩:০৩ পিএম
স্বর্গেও ঠিক ক্রিকেট চর্চা করছেন নাদির শাহ

‘হাউ আর ইউ নাদির?’

‘আই অ্যাম মাচ বেটার টুডে।’ ৭ সেপ্টেম্বর ২০২১ তারিখে নাদির শাহর সঙ্গে মেসেঞ্জারে টেক্সটের মাধ্যমে কথোপকথন।

আর ১২ সেপ্টেম্বর যদি তাকে জিজ্ঞেস করা হয়, ‘নাদির, হাউ আর ইউ? কী উত্তর দেবেন! উত্তরটা প্রায় একই রকম থাকবে! দু-একটা শব্দ একটু এদিক-ওদিক হতে পারে। হয়তো বলবেন: ‘আই অ্যাম ফাইন। ইউ নো, নাউ আই অ্যাম ইন হ্যাভেন। ইট ইজ মাচ বেটার দ্যান ইউএসএ!’ কিন্তু জিজ্ঞেস করবেন কীভাবে। ফেসবুক, মেসেঞ্জার, টুইটার, হোয়াটসঅ্যাপ–জাগতিক এসবের সঙ্গে তার আর কোনো সম্পর্ক নেই। তবু নাদির শাহকে যারা কমবেশি চেনেন, জানেন তারা নিশ্চয়ই অনুমান করতে পারছেন, বাংলাদেশ ক্রিকেটের সদাহাস্য উজ্জ্বল নাদির যেখানেই থাকুন, সেখানে কী করতে পারেন। কী বলতে পারেন।

 নাদির জীবনটাকে তার নিজের মতো করেই দেখছেন। নিজেকে তিনি পৃথিবীর বুকে এক ক্রিকেট পর্যটকের বেশি কিছু ভাবতে পেরেছেন বলে মনে হয় না। ক্রিকেটের মাঝেই আনন্দ নিয়ে বেঁচেছেন। ঢাকার ধানমন্ডিতে বসবাস। ক্রিকেটকে ঘিরেই জীবনযাপন। তার কাছে ‘জীবনানন্দ’ মানেই ক্রিকেট। আর শেষ দিকে তার মহাবিরক্তির নাম ছিল ঢাকার যানজট! প্রায়ই নিজের মতো করেই বলতেন; ‘এটা কোন শহর? কোথায় লস অ্যাঞ্জেলস আর কোথায় ঢাকা! আমেরিকা না দেখলে সে পৃথিবীর কী দেখল!’

দেশে ক্রিকেট মৌসুম শেষ হলেই নাদির ছুটতেন  ইউএসএতে। ঢাকায় বসবাস করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিয়ে নাদিরের মতো কাউকে উচ্ছ্বসিত হতে দেখিনি। পায়ের কেডস, হাতের ঘড়ি, মাথার ক্যাপ সবই নাদির আনতেন আমেরিকা থেকে। হোক সেটা মেড ইন চায়না অথবা বাংলাদেশ। নাদিরের কাছে জিনিসটা আসতে হবে আমেরিকা থেকে। ঢাকায় বাস অথচ যুক্তরাষ্ট্র নিয়ে তার যা উচ্ছ্বাস ছিল, তাতে মার্কিন অভিবাসন দপ্তরের কর্তারা তাকে অনায়াসে তাদের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর হিসেবে নিয়োগ দিতে পারতেন। মার্কিন মুল্লুকে ক্রিকেটচর্চা শুরু করেছেন প্রবাসী ভারতীয়-পাকিস্তানি-বাংলাদেশি-শ্রীলঙ্কান আর ক্যারিবিয়ানরা। সেই ক্রিকেট নিয়েও দারুণ খুশি ছিলেন নাদির। আনোয়ার খান মডার্ন হাসপাতাল যার জীবনের শেষ কদিনের ঠিকানা হয়েছিল, সেখানেও বসে তিনি ছিলেন ক্রিকেটে মগ্ন। বাংলাদেশ-নিউজিল্যান্ড টি-টোয়েন্টি সিরিজ দেখেছেন হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে। কিন্তু তার মনটা পড়েছিল লস অ্যাঞ্জেলসে।

৩ সেপ্টেম্বর থেকে ওখানে শেখ কামাল ক্রিকেট টুর্নামেন্টে আম্পায়ারিং করার কথা ছিল তার। এর আগেরবার ওই টুর্নামেন্ট শেষ করে দেশে ফির ধানমন্ডি চার নম্বর মাঠে বসে কত কথা সেখানকার ম্যাচ নিয়ে: “কামাল ভাইয়ের নামে ওরা টুর্নামেন্ট করছে। বাংলাদেশ মিডিয়ায় কেন সেটার একটু কাভারেজ দেওয়া হয় না?” এটা নিয়ে তার খানিকটা অনুযোগ ছিল।

যে ঢাকা শহরের যানজট, জলজট নিয়ে প্রচণ্ড বিরক্তি ছিল নাদিরের, সেখানে তাঁর সবচেয়ে বড় গর্ব ছিল ধানমন্ডিতে তিনি প্রধানমন্ত্রী, আওয়ামী লীগ সভাপতির প্রতিবেশী। কারণ, ধানমন্ডি পাঁচ নম্বরে ‘সুধাসদন’-এর আগেই নাদিরদের বাড়ি। প্রতিবেশী হিসেবে নাদির কেমন ছিলেন, সেটা তিনি চলে যাওয়ার পরে প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ এবং অর্থ ও পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. মশিউর রহমান নিজের ফেসবুক ওয়ালে ১১ সেপ্টেম্বর লিখেছেন, ‘ক্রিকেট জগতে সুপরিচিত নাদির শাহর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করছি।…। ১৯৮০ থেকে ১৯৯০-এর মাঝামাঝি পর্যন্ত ধানমন্ডিতে আমরা ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী ছিলাম।’ নাদির চলে যাওয়ার পর ক্রিকেটাঙ্গনের মানুষের ফেসবুক ওয়ালে ওয়ালে তার হাসিমাখা মুখের ছবি। অথবা আইসিসিরি আম্পায়ার হিসেবে সেই বিখ্যাত আঙুল তোলার ছবি ঘুরে বেড়াছে। কিন্তু নাদির শাহকে যে অন্য জগতের মানুষও চিনতেন ক্রিকেটাঙ্গনের মানুষ হিসেবে। তারাও সত্যিই শোকাহত।

নাদির শাহ, আইসিসিরি আম্পায়ার হিসেবে বিখ্যাত আঙুল তোলার ছবি।

লস অ্যাঞ্জেলসে যে টুর্নামেন্টে আম্পায়ারিং করতে যাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়েছিলেন নাদির শাহ, সেখানকার আয়োজকরাও দারুণ মর্মাহত। এই টুর্নামেন্টে অতিথি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রে গেছেন বিসিবির পরিচালক আহমেদ সাজ্জাদুল আলম ববি। ৩০ আগস্টও যিনি হাসপাতালে নাদিরকে দেখে পরদিন ইউএসের ফ্লাইট ধরেছেন। যাওয়ার আগেও তাকে নাদির বলেছিলেন, ‘বব ওদের বোলো একটু বেটার ফিল করলেই আমি চলে আসব।’

নাদির চলে গেলেন। তবে ইউএসএতে নয়। স্বর্গে। যা কিনা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চেয়েও অনেক ভালো। সেখানে নাদির অবশ্য ‘আগুন্তকে’র মতো হাজির হয়েছেন। ওখানকার ক্রিকেট জগতের বাঙালি কমিউনিটি নাদিরকে স্বাগত জানাতে হয়তো মোটেও প্রস্তুত ছিলেন না। মানজারুল রানা, সেতু, সালাউদ্দিন, কিংবা ক্রিকেট সংগঠক আমিনুল হক মনি, রইসউদ্দিন আহমেদ, রেজা-ই করিম, গোলাম ফারুক অপু আহমেদ, ফয়েজুর রহমান, কে জেড ইসলাম এরা নাদিরকে দেখে হয়তো চমকে গেছেন! হয়তো নাদির তাদের স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়েছেন এই বলে: ‘আরে আপনারা কি জানেন অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ডকে হারিয়েছে বাংলাদেশ টি-টোয়েন্টি সিরিজে! বাট মিরপুরের উইকেট ওয়াজ ভেরি ব্যাড!’

নাদির, আপনি নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে চতুর্থ ম্যাচে জয় দেখে চলে গেছেন। শেষ ম্যাচটা হেরেছে বাংলাদেশ। কিন্তু সেই ম্যাচ শুরুর আগে বাংলাদেশ- নিউজিল্যান্ড দুদলের ক্রিকেটাররাই আপনাকে স্মরণ করেছেন শ্রদ্ধাবনত চিত্তে। আপনার জন্য এক মিনিট নীরবতাও পালন করা হয়েছে। যা আপনার প্রাপ্য। আপনার চলে যাওয়ার খবরে আপনার বন্ধু-বান্ধব-পরিচিতজনরা অনেকেই চোখের জল ফেলেছেন। টেলিফোনে কথা বলার সময়ও অনেকের কণ্ঠ বাষ্পরুদ্ধ হয়ে উঠেছে। আপনার প্রিয় আমেরিকাপ্রবাসী বন্ধু জি এম নওশের প্রিন্স, নাজিম সিরাজী মামুন সবাই চোখের জল ফেলেছেন। আর ঢাকায় থাকলে যে জায়গাটায় সবচেয়ে বেশি সময় আড্ডা দিতেন ধানমন্ডির সেই চার নম্বর মাঠে আপনার জন্য দোয়া মাহফিলের আয়োজন হচ্ছে।

নাদির, ব্যক্তিজীবনে আপনার সঙ্গে অনেক স্মৃতি। ক্রিকেট নিয়ে আলোচনা থেকে অনেক কিছু শিখেছি আপনার কাছ থেকে। প্রেসবেক্স আপনি চলে এলে একটা ম্যাড়মেড়ে ক্লাব ম্যাচও অন্য মাত্রা পেয়ে যেত আলোচনায়! আপনি প্রতিটি বলকে, প্রতিটি শটকে যেভাবে ব্যাখ্যা করতেন সেটা মন দিয়ে শুনলে কোনো শিক্ষানবিশ রিপোর্টারের ম্যাচ রিপোর্ট নিয়ে চিন্তার কোনো কারণ থাকত না।

আপনার কাছে একটি ঘটনার জন্য আমি কৃতজ্ঞ। একাধিকবার আপনার সঙ্গে ভারতে ক্রিকেট ম্যাচ কাভার করতে গিয়ে দেখা হয়েছে। ২০০৪ সালে একবার পাকিস্তান এসেছিল ভারত সফরে। আমি গিয়েছিলাম কভার করতে। আর আপনি গিয়েছিলেন খেলা দেখতে। কারণ, পাকিস্তান ভারতে, সেটা আপনি মিস করতে চাননি! কলকাতা টেস্ট শেষ হওয়ার পরে একদিন বলেছিলেন, “চলেন আজ আপনাকে ময়রা স্ট্রিটে আমার আন্টির বাসায় নিয়ে যাব। আন্টির বাড়ির পাশেই উত্তম কুমারদের বাড়ি।” সত্যি বলতে কি উত্তম কুমার যে বাড়িতে থেকে উত্তম কুমার হলেন, সেটা দেখার কৌতূহল হয়েছিল। তাই আপনার সাথে ট্যাক্সি চেপে চলে গিয়েছিলাম। উত্তম কুমারের সেই বাড়িটা প্রথম দেখেছিলাম আপনার সৌজন্যে।

আপনার সৌজন্যে আমার উত্তমের বাড়ি-দর্শন। কিন্তু স্বর্গে গিয়েই আপনি নিশ্চয়ই খুঁজতে শুরু করেছেন, স্যার ডন ব্র্যাডম্যান কোথায় থাকেন! শেষ জীবনের জন্য তিনি বেছে নিয়েছিলেন অ্যাডিলডেকে। শান্ত-নিরিবিলি এক শহর। ২ হোল্ডেন স্টিট্রের সেই বিখ্যাত বাড়ি খুঁজে পেতে কষ্ট হয় না। কষ্ট সেখানে শুধু ঢুকতে। স্বর্গেও ব্র্যাডম্যান আলাদা সরণির বাসিন্দা। ইভিনিং ওয়াকে বের হলে ডনের সাথে দেখা হলেও হয়ে যেতে পারে আপনার। আর আপনি হয়তো আপনার মতো করেই বলে ফেলবেন, ‘স্যার, আপনার নব্বইতম জন্মদিনের অনুষ্ঠানে শচীন-ওয়ার্নকে ডাকলেন। ব্রায়ান লারাকে কেন ডাকলেন না? ব্র্যাডম্যান হয়তো বিস্মিত চোখে তাকিয়ে থাকবেন। তারপর পাল্টা প্রশ্ন করবেন: ‘হু আর ইউ?’

আপনার উত্তরও তৈরি। ‘আই অ্যাম নাদির শাহ। ফ্রম বাংলাদেশ।’ কথাগুলো শুনে হয়তো আর কিছু না বলেই হাঁটতে শুরু করবেন ভদ্রলোক। আপনাকে হয়তো আরও অপেক্ষা করতে হবে, অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে বাংলাদেশ টি-টোয়েন্টি সিরিজ জিতেছে এই তথ্যটা স্যার ডনকে জানাতে।

কিন্তু এই দেশে কজনে জানেন, স্যার ডনের দেশের এক বিখ্যাৎ ক্রিকেটারের নামে একসময় আপনাকে ডাকা হতো, ‘বিল লরি’ বলে। কারণ, বিলের চেহারার সাথে আপনার চেহারার খানিকটা মিল ছিল। অস্ট্রেলিয়ার সেই সাবেক অধিনায়ক বিল মরিস লরি এখনো এই পৃথিবীতেই আছেন। জীবনের ক্রিজে ৮৪-তে নট আউট। অথচ আপনি মাত্র ৫৭-তেই চলে গেলেন সবচেয়ে সুন্দর প্যাভিলিয়নে।

সেই প্যাভিলিয়নে আরও একজনের দেখা পেয়েছেন নিশ্চয়ই। তিনি রমন লাম্বা। জীবন দিয়ে যাকে প্রমাণ করতে হয়েছিল তিনি ক্রিকেটার ছিলেন। লাম্বা ভারতীয় ক্রিকেটার। একসময় ঢাকার মাঠে ক্রেজ ছিলেন। সেই ঢাকাতেই তাঁর মৃত্যু। ক্রিকেট মাঠে খেলতে খেলতে কোনো আন্তর্জাতিক ক্রিকেটারের বলের আঘাতে প্রথম মৃত্যু। লাম্বার থেকে একটা জায়গায় আপনি এগিয়ে ছিলেন। লম্বা দুঃসাহস দেখিয়েছিলেন আবাহনীর পক্ষে ফরোয়ার্ড শর্ট লেগে ফিল্ডিং করার সময় হেলমেট না পরে। ব্যাটসম্যান মেহেরাব অপির ব্যাট ছুঁয়ে যাওয়া বল তার মাথায় লেগেছিল। বাকিটা এখন ইতিহাস। কিন্তু আপনি? ঢাকার লিগে আবাহনীর মাঠে ম্যাটের উইকেটে ব্যাট করতে যাওয়ার সময় দেখেছিলেন প্রতিপক্ষের এক বোলারের বল খুব উঁচুতে উঠছিল। তখন কেবল হেলমেট জমানা শুরু হয়েছে। কিন্তু ঢাকার ক্রিকেটে কেউ ব্যবহার করেনি। আপনি আবাহনীর ম্যানেজার আহমেদ সাজ্জাদুল আলম ববির মোটরসাইকেলের হেলমেট মাথায় লাগিয়ে ব্যাট করতে নেমেছিলেন! ওটাই হেলমেট নামক বস্তুটা মাথায় লাগিয়ে ঢাকার ক্রিকেটে কোনো ব্যাটসম্যানের প্রথম খেলা!

নাদির আপনাকে নিয়ে লিখতে বসে মহাজাগতিক অনেক কিছুই মাথায় চলে আসে। কিন্তু টি-টোয়েন্টির জমানায়, আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির যুগে মানুষ খুব বেশি সময় নিতে চায় না পড়ার জন্য। তাই ল্যাপটপের কি-বোর্ড থেকে হাত সরিয়ে নিতে হচ্ছে।

তার আগে একটা কথা বলতে হচ্ছে, নাদির শাহ, ক্রিকেটকে ঘিরে ভরপুর আনন্দ নিয়ে বেঁচে গেছেন। মৃত্যুতেও ক্রিকেটকে আকড়ে ছিলেন। বাংলাদেশ ক্যাপ মাথায়, বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের লোগো লাগানো টি-শার্ট পরেই তো হাসপাতালের বিছানায় ছিলেন জীবনের শেষ কটা দিন। ক্রিকেট সমর্পিত এক প্রাণ মৃত্যুর বুকেও আশ্রয় নিলেন, ক্রিকেট স্মারককে বুকে নিয়ে। ওপারে ভালো থাকবেন নাদির শাহ। আমরা আপনাকে অনেক মিস করব। আপনার অবর্তমানে ক্রিকেট আড্ডায় স্বর্গীয় আনন্দ খুঁজে পাওয়া সত্যিই কঠিন।

 

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও কলাম লেখক

Link copied!