• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ১২ ডিসেম্বর, ২০২৪, ২৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬
৪০ টাকায় ঢাকায় থাকা!

কষ্টে আছেন বোর্ডিং মালিকরা


আবদুল্লাহ আল মামুন
প্রকাশিত: জানুয়ারি ৯, ২০২২, ০৯:৫৫ পিএম
কষ্টে আছেন বোর্ডিং মালিকরা

‘এই শহর, যাদুর শহর প্রাণের শহর ঢাকা রে
এই শহর, যাদুর শহর প্রাণের শহর আহা রে!’

রাজধানী ঢাকা নিয়ে তৈরি গানটি শুনতে শুনতে বারবার একটি প্রশ্ন মনে পড়ে যায়, আচ্ছা, আজ থেকে শত বছর আগে ঠিক কেমন ছিল এই যাদুর শহর?

চিরচেনা ব্যস্ত এ শহরে প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মানুষ এসে ভিড় জমায়। তাদের মধ্যে স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য একমাত্র ভরসা বুড়িগঙ্গা নদীর ওপরে লঞ্চ আকৃতির ভাসমান হোটেল। অনেকেই ঢাকায় এসে এই ভাসমান হোটেলে সিটপ্রতি মাত্র ৪০ টাকা দিয়েই একদিন থাকতে পারছেন। আবার কেউ ১০০ টাকায় সিঙ্গেল কেবিন ভাড়া নিয়ে রাতযাপন করছেন।

একসময় সদরঘাটের পূর্ব পাশে ছিল হোটেলগুলো, এদের সবশেষ অবস্থান ছিল ওয়াইজঘাটে। ফলে লঞ্চ থেকে নেমেই যাত্রীরা সরাসরি হোটেলে চলে যেতে পারতেন।
ওয়াইজঘাটে নির্মাণকাজ চলার কারণে হোটেলগুলোকে সরিয়ে বাদামতলী মসজিদ ঘাটে স্থানান্তর করে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)। পরে বাবুবাজার সেতুর পশ্চিমে মিটফোর্ড হাসপাতাল সংলগ্ন ঘাটে হোটেলগুলোর জায়গা পরিবর্তন হয়। সেখানে কোনো যাত্রীবাহী লঞ্চ না থামায় বিপাকে পড়েছেন হোটেল ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, আগের তিনভাগের এক ভাগ বোর্ডার পাওয়া যাচ্ছে। আর যে আয় হচ্ছে, তাতে হোটেলের আনুষাঙ্গিক খরচ, কর্মচারীদের বেতন দেওয়ার পর নিজেদের সংসার চালানোই কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বাবুবাজার ব্রিজের নিচের দিকে তাকালেই বাড়ি সাদৃশ্য পাঁচটি লঞ্চ দেখা যায়। লঞ্চগুলো পুরাতন এবং জীর্ণ। পাঁচটি লঞ্চের মাত্র দুটিতে নাম লেখা আছে। ‘ফরিদপুর মুসলিম হোটেল’ আর ‘শরিয়তপুর মুসলিম হোটেল’।বাকিগুলোর নাম নেই। তবে খানিকটা পরই জানা গেল সেগুলো নাজমা বোর্ডিং, উমা উজালা বোর্ডিং ও বুড়িগঙ্গা বোর্ডিং।

ভাসমান এই হোটেলগুলো প্রায় প্রতিটিই দোতালা। উপর নিচে মিলিয়ে প্রতিটি হোটেলেই ৪৫ থেকে ৬০টি কক্ষ রয়েছে। তিন শ্রেণির কক্ষ সুবিধা বিশিষ্ট হোটেলের প্রথমটি ঢালাই বিছানা। এটি অনেকটা গণরুমের মতোই। কোনোরকম তোশক বা বিছানা বিহীন কাঠের পাটাতনের ওপর করা হয় এই বিছানা। ঢালাই বিছানায় থাকতে হলে নিজের বিছানাপত্র নিয়ে থাকতে হয়। ঢালাই বিছানার মূল্য মাত্র ৪০ টাকা। লঞ্চগুলোতে সিঙ্গেল কেবিনই বেশি। তবে রয়েছে ডাবল কেবিনও। এসব কেবিনের আকার দৈর্ঘ্যে ৫ ফুট আর প্রস্থে মাত্র ৩ ফুট। ডাবল কেবিন প্রস্থে কিছুটা বড়। ডাবল কেবিনে থাকতে হলে গুনতে হয় দৈনিক ১৫০ টাকা। কেবিনগুলোতে হোটেল কর্তৃপক্ষ থেকে বিছানার চাদর, বালিশ আর শীতকালে কম্বল দেওয়া হয়।

সাধারণ লঞ্চের মতোই এসব হোটেলের পিছন দিকে ছোট একটি টয়লেটের ব্যবস্থা করা। বোর্ডাররা সাধারণত নদীর পানিতেই গোসল করেন। লঞ্চে যাতায়াতের জন্য একটি লম্বা কাঠের পাটাতন আছে। লঞ্চগুলোতে কোনো ইঞ্জিন নেই। একঘাট থেকে অন্য জায়গায় স্থানান্তরের প্রয়োজনে ইঞ্জিনচালিত ট্রলার ব্যবহার করা হয়। তবে, ঝড়বৃষ্টিতে হোটেলগুলোকে তীরের সঙ্গে শক্ত করে বেঁধে রাখাই যেন একমাত্র ভরসা।

জানা যায়, গত বছর থেকে শুরু হওয়া করোনা মহামারির কারণে হোটেল ব্যবসা ঝিমিয়ে পড়েছে। এখন আবারও ঘুরে দাঁড়ানো চেষ্টা হচ্ছে। করোনার কারণে ভাসমান এই হোটেলগুলোতে বোর্ডার একবারেই কম বলে নিজেদের সংসার চালাতে হিমশিম খাওয়ার কথা জানিয়েছেন মালিক-কর্মচারীরা। এছাড়াও কর্মচারীর বিল, কারেন্ট বিল, নিজের হাতখরচ রেখে বাড়িতে টাকা পাঠানো তাদের জন্য কষ্টের হয়ে পড়ে। তাই এখন চেষ্টা করছেন ক্ষতি পুষিয়ে নতুন উদ্যামে ব্যবসা করার।

প্রায় ৩৬ বছর আগে ফরিদপুর মুসলিম বোর্ডিয়ের সঙ্গে থাকা গোলাম মোস্তফা মিয়া তার মামা আব্দুস সাত্তার মিয়ার কাছ থেকে এই হোটেলের মালিকানা পেয়েছেন।
ফরিদপুর মুসলিম বোর্ডিংয়ের মালিক গোলাম মোস্তফা মিয়া বলেন, “আমাদের এই বোর্ডিংগুলো ছিল ওয়াইজঘাটে। ওই ঘাটে কাজ চলার কারণে আমাদের বাদামতলী মসজিদ ঘাটে স্থানান্তর করা হয়। কিন্তু এখন মিটফোর্ড ঘাটের পাশে নিয়ে আসা হয়েছে। যার কারণে লঞ্চ থেকে যাত্রীরা নেমে সরাসরি আমাদের এখানে আসতে চায় না। এই জায়গাতে আমাদের পানি ও গোসলসহ বিভিন্ন ধরনের সমস্যার কারণে তেমন বোর্ডার পাওয়া যায় না।”

গোলাম মোস্তফা মিয়া আরো বলেন, “আমার হোটেলে বর্তমানে সিট আছে ৪৫টি। তবে কমপক্ষে ৬০ জন লোক থাকার সক্ষমতা আছে। সেই জায়গায় এখন ৩০ থেকে ৩৫ জন মানুষ। রাত ১২টা পর্যন্ত এ হোটেলগুলোতে প্রবেশ করা যায় ও পরদিন সকাল ১১টার মধ্যে ছেড়ে দিতে হয়।”

এই বোডিং মালিক বলেন, “করোনায় আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য ছিল না। আর এখন এই জায়গাতে আসার পরও ব্যবসা ভালোভাবে চলছে না। অনেক অভাবে আছি ও কষ্টে আছি। তাই আগের জায়গা অর্থাৎ বাদামতলী ঘাটে ফেরার জন্য সরকারের কাছে আমরা জোর দাবি জানাচ্ছি।”

তিনি আরও বলেন, “১৯৭৫ সালে বিআইডব্লিউটিএ থেকে অনুমোদন নিয়েই এই হোটেল ব্যবসা চালু আছে। নিয়মিত পরিশোধ করেন ইজারার টাকাও। বাদামতলী মসজিদ সংলগ্ন ঘাট খালি পড়ে আছে। তাই আমাদের এই জায়গাটা যদি ‘বিআইডব্লিউটিএ’ দিতো তাহলে আমরা হোটেলগুলোকে আরও সুন্দর করতাম, যেন দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ এই ভাসমান হোটেল দেখতে আসে কিংবা আরামে থাকতে পারে।”

কী ধরনের মানুষ এই হোটেলে থাকেন এ বিষয়ে জানতে চাইলে গোলাম মোস্তফা মিয়া ‘সংবাদ প্রকাশ’-কে জানান, “আমাদের ভাসমান হোটেলগুলোতে ফল ব্যবসায়ী ছাড়াও এখানে হকার, মজদুর, ট্রাক ড্রাইভার, বাসের হেল্পার, অর্থাৎ নিম্ন আয়ের মানুষ বেশি থাকেন এবং আসেন।”

হোটেলের নিরাপত্তা নিয়ে তিনি বলেন, ‘বোর্ডারদের হোটেলে থাকার আগে সবার পরিচয়পত্র নিশ্চিত করেই এখানে থাকতে দেওয়া হয়। এজন্য চুরি হওয়ার ভয় নেই।”
উমা উজালা বোর্ডিংয়ের ব্যবস্থাপক পিন্টু চন্দ্র সাহা ‘সংবাদ প্রকাশ’-কে বলেন, “করোনার কারণে আগে বোর্ডার ছিল না। এখন এই মিটফোর্ড সংলগ্ন ঘাটে হোটেলগুলোর জায়গা পরিবর্তন হয়েছে বলে লোকজন তেমন আসতে চায় না। এখানে আমাদের গোসলের সমস্যা আছে।” 

তার হোটেলে ৪২টি সিটের মধ্যে মানুষ আছে বর্তমানে প্রায় ২০ জন বলে জানান তিনি। তিনি আরো বলেন, “এর আগে যখন বাদামতলী মসজিদ সংলগ্ন ঘাটে ছিলাম, সেখানে আমরা ভালো বোর্ডার পেতাম। আবার যদি পুনরায় সরকার আমাদের আগের জায়গাতে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিতো তাহলে আমরা এই হোটেল ব্যবসা চালিয়ে সংসার নিয়ে সুখে থাকতে পারতাম।”

নাজমা বোর্ডিংয়ের ভারপ্রাপ্ত ম্যানেজার মো. রিপন মিয়া ‘সংবাদ প্রকাশ’-কে বলেন, “করোনার সময় যারা ছিল হোটেলে, অনেকেই ভাড়া দিতে পারেনি। এমনও ছিল একমাস থেকে মাত্র ২০০ টাকা দেওয়ার পর আর সামর্থ্য নেই। তখন মালিক ভাড়া মওকুফ করে দিয়েছে। এখানে আমাদের স্থানান্তর করার পর ব্যবসা তেমন ভালো চলছে না। আমার এখানে সিঙ্গেল ও ডাবল মিলিয়ে ৩২টি কেবিন। কিন্তু লোক আছে ২০ থেকে ২২ জন। প্রতিদিনই ১০ থেকে ১২টা কেবিন খালি থাকে। আগের জায়গা অর্থাৎ বাদামতলী ঘাটে গেলে আমাদের ব্যবসা ভালো চলতো।”

স্বল্প আয়ের মানুষের ভরসা

উমা উজালা বোর্ডিংয়ে প্রায় ১০ বছর কেবিন নিয়ে থাকা শরীয়তপুরের ফল বিক্রেতা মুক্তার হোসেন বলেন, “আমার এখানে থাকলে সুবিধা হয়। ফল কিনে লঞ্চে নিয়ে রাখতে পারি। আবার খরচও কম, মাত্র ১০০ টাকায় কেবিন নিয়ে থাকতে পারি। বাড়িতে প্রতি মাসে কিছু টাকা পাঠাতে পারি।” 

রাজধানীতে ঘুরে ঘুরে পুরোনো কাপড়ের ব্যবসা করা বরিশালের ফরিদ হোসেন প্রায় ১০ বছরে ধরে ফরিদপুর হোটেলে সিট নিয়ে থাকেন। তিনি বলেন, “৪০ টাকায় এই হোটেলে রাতযাপন করা যায়। সস্তায় এর চেয়ে ঢাকায় আর কোথাও থাকা যাবে না। আমার এখানেই ভালো লাগে।”

ফরিদপুর হোটেলে কেবিন নিয়ে থাকা মুরগি বিক্রেতা মো. শরীফ বলেন, “আমার এখানে থাকলে খরচ কম হয়। আর থাকার জন্য সব সুবিধাই পাওয়া যায়। তবে গোসলের জন্য একটু সমস্যা হয়।”

শরীয়তপুর মুসলিম বোর্ডিংয়ে কেবিনে থাকা ফল বিক্রেতা ভোলার ইমরান হোসেন বলেন, “এখানে থাকলে আমাদের সুবিধা ভালো। কারণ দৈনিক বা মাসিকভাবে ভাড়া দিতে পারি। করোনার সময় আমরা অনেক সমস্যায় ছিলাম। একদিন দুপুরে খাওয়ার টাকা ছিল না। একটা রুটি খাবো সেই টাকাও ছিল না। বাড়ি থেকে টাকা নিয়ে চলতে হয়েছে। অনেক কষ্টে দিন কাটিয়েছি। কেউ তো ১০ টাকা দিয়েও আমাদের সহযোগিতা করেনি। এখন যদি সরকার আবার লকডাউন দেয়, তাহলে বাড়িতে গিয়েও না খেয়ে থাকতে হবে।”

বুড়িগঙ্গার ভাসমান হোটেলের যাত্রা শুরু ১৯৬৮ সালে, ‘হিন্দু হোটেলের’ মাধ্যমে। সেসময় এই হোটেলে মাত্র চার টাকাতেই হয়ে যেত থাকা-খাওয়া। পঁচাত্তর সালে মালিকানার সঙ্গে হোটেলটির নামও বদলে যায়। সেটিই এখন ফরিদপুর মুসলিম হোটেল। এই হোটেলে শুরু থেকে খাওয়ার ব্যবস্থা থাকলেও ২০০২ সাল থেকে তা বন্ধ হয়ে যায়।

ঢাকায় ভাসমান হোটেলের ইতিহাস বেশ পুরোনো। নদী বিধৌত ঢাকায় বহু নবাবেরা শাসন করেছেন। ব্রিটিশ শাসনামলে ইংরেজ অফিসাররা এসেছেন। সেসময় আজকের মতো এতো হোটেল বা মেস ছিল না। মুঘল সেনাপতি সুবাদার ইসলাম খাঁ প্রথমবারের মতো ঢাকায় আসেন। তখন তাঁর থাকার জন্য তেমন কোনো বন্দোবস্ত ছিল না। তিনি থাকতেন তার বিশাল এক বজরা নৌকাতে। তাঁর বজরার নামানুসারে সেই ঘাটের নামও হয়েছিল ‘চাঁদনীঘাট’। ব্রিটিশ আমলেও অনেক অফিসারেরা ঢাকায় এসে এসব ভাসমান হোটেলে থাকতেন। মাঝেমধ্যে পরিবার নিয়ে রীতিমতো নৌকাবিলাস করতেন তারা। এসব ক্ষেত্রে স্থানীয় জমিদারদের বড় নৌকা ভাড়া করতে হতো। আজকের দিনে গাড়ি থাকাটা একরকম সামাজিক অবস্থার নির্দেশক। সেসময় জমিদারেরাও এসব নৌকার মালিকানাকে নিজেদের আভিজাত্যের প্রতীক হিসেবে দেখতেন। অবশ্য তখনকার বুড়িগঙ্গা আর আজকের বুড়িগঙ্গার মধ্যে বিস্তর ফারাক।

Link copied!